৩০৪তম অধ্যায়
অতিথি বিপ্রের নিকট কুন্তীর মন্ত্রসহ বরলাভ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ব্ৰতপরায়ণা সেই কন্যা পরিশুদ্ধচিত্তে নিয়তীব্রত ব্ৰাহ্মণের সেবা করিতে লাগিলেন। ব্ৰাহ্মণ ‘প্ৰাতঃকালেই আগমন করিব’ বলিয়া কখন সায়ংকালে, কখন বা রাত্রিকালে প্রত্যাবৃত্ত হইতেন, তথাপি ঐ কন্যা সকল সময়েই ভোজ্য, শয়ন, আসন প্রভৃতি প্রদান করিয়া তাঁহাকে পূজা করিতেন। তিনি প্রতিদিন উত্তমোত্তম ভোজ্য ও ভোগ্যসামগ্ৰী ব্যতীত কদাপি তাঁহাকে অপকৃষ্ট বস্তু প্ৰদান করিতেন না এবং তিরস্কার, অপবাদ বা অপ্ৰিয়বাক্যদ্বারা তাঁহার অপ্ৰিয়াচরণে কদাপি প্রবৃত্ত হইতেন না। ভোজকন্যা কুন্তী যে সময়ে ব্যস্ত থাকিতেন, ব্ৰাহ্মণ সেই সময়েই তাঁহাকে নানাবিধ আদেশ এবং তাঁহার নিকট অতিদুর্লভ সামগ্ৰীসকল প্রার্থনা করিতেন। কুন্তী তৎক্ষণাৎ শিষ্যের ন্যায়, পুত্রের ন্যায়, ভগিনীর ন্যায় অবহিত হইয়া ব্ৰাহ্মণকে তাঁহার প্রাথিত সামগ্ৰীসকল প্ৰদানপূর্ব্বক পরিতুষ্ট করিতেন। ফলতঃ ব্রাহ্মণ কন্যারত্ব কুন্তীর যত্ন, স্বভাব ও আচরণে প্রীতির পরাকাষ্ঠা প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন।
কুন্তিুভোজ প্রতিদিন প্ৰভাতে ও সায়ংকালে কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “পুত্রি! ব্রাহ্মণ কি তোমার পরিচর্য্যায় পরিতুষ্ট হইতেছেন?” তিনি উত্তর করিতেন, “যারপরনাই আনন্দিত হইতেছেন।” মহানুভব কুন্তিভোজ তৎশ্রবণে আনন্দসাগরে প্লবমান হইতেন।
এইরূপে একবর্ষ অতিক্রান্ত হইলে সৌহার্দ্যপরায়ণ ব্ৰাহ্মণ যখন দেখিলেন, রাজকন্যার কিঞ্চিম্মাত্রও দোষ নাই, তখন প্রীতিপ্ৰফুল্লচিত্তে কহিলেন, “কল্যাণি! আমি তোমার পরিচারণায় [সেবায়] পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি, তুমি অনন্যসূলভ বাঞ্ছিত বর প্রার্থনা কর, তুমি সেই বরপ্রাপ্তিনিবন্ধন যশোদ্বারা সমস্ত সীমন্তিনীর অগ্রণী হইবে।”
কুন্তী কহিলেন, “হে বিপ্র! আপনি ও আমার পিতা উভয়েই যখন আমার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়াছেন তখন আমার বরলাভের আর কিছুই অবশিষ্ট নাই; অতএব অন্য বরে প্রয়োজন কি?”
ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, “হে চারুহাসিনি! তুমি আমার নিকট বর গ্রহণ করিতে অনভিলাষিণী হইলেও আমি তোমাকে দেবগণকে আহ্বান করিবার নিমিত্ত এই মন্ত্র প্রদান করিতেছি, গ্ৰহণ কর। তুমি এই মন্ত্রদ্বারা যে যে দেবতাকে আহ্বান করিবে, তাঁহারা অকামই হউন আর সকামই হউন, মন্ত্রপ্রভাবে ভৃত্যের ন্যায় তোমার বশবর্ত্তী হইবেন।”
অনিন্দিতা কুন্তী দ্বিজবরকে প্রত্যাখ্যান করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি তাঁহাকে অথর্ব্ববেদবিহিত মন্ত্ৰসকল গ্ৰহণ করাইলেন। অনন্তর দ্বিজবর কুন্তিভোজকে কহিলেন, “রাজন! আমি তোমার কন্যাকর্ত্তৃক পরিতোষিত হইয়া তোমার গৃহে পরমসুখে বাস করিয়াছি এবং সর্ব্বদা যথাবিধি সম্মান প্রাপ্ত হইয়াছি, এক্ষণে ইষ্টসাধন করিতে চলিলাম।” এই কথা বলিয়া ব্ৰাহ্মণ অন্তর্হিত হইলেন। রাজা কুন্তিভোজ, তাঁহাকে সেই স্থানে অন্তর্হিত হইতে দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন এবং তদবধি পৃথাকে সাতিশয় সমাদরসহকারে সম্মান করিতে লাগিলেন।