৩০৩. ক্ষর ও অক্ষর ব্যাখ্যা—করাল-বশিষ্ঠসংবাদ

৩০৩তম অধ্যায়

ক্ষর ও অক্ষর ব্যাখ্যা—করাল-বশিষ্ঠসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অক্ষর-পদার্থ লাভ করিলে পুনর্জ্জন্ম গ্রহণ করিতে হয় না এবং ক্ষর-পদার্থ লাভ করিলেই পুনৰ্ব্বার ইহলোকে আগমন করিতে হয়। এক্ষণে সেই অক্ষর ও ক্ষর-পদার্থ বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। বেদবেত্তা ব্রাহ্মণ ও মহাত্মা যোগিগণ আপনাকে জ্ঞাননিধি বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। সম্প্রতি উত্তরায়ণ আগত হইতে আর অধিক দিন বিলম্ব নাই। ভগবান্ ভাস্কর উত্তরদিকে যাত্রা করিলেই আপনার পরমগতি লাভ হইবে। আপনি কুরুকুলের প্রদীপস্বরূপ। আপনার পরলোকপ্রাপ্তির পর আমরা আর কাহার নিকট হিতজনক নীতিবাক্য শ্রবণ করিব? আপনার মুখে এই সমুদয় অমৃতময় বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার শ্রবণেচ্ছা ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হইতেছে; অতএব আপনি আমার নিকট ক্ষর ও অক্ষরের বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! এই উপলক্ষে আমি জনকবংশসম্ভূত রাজর্ষি করাল ও মহর্ষি বশিষ্ঠের পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে একদা মহারাজ করাল অধ্যাত্মবিদ্যাবিশারদ, সূৰ্য্যের ন্যায় তেজস্বী, তপোধনাগ্রগণ্য, আসনোপবিষ্ট ভগবান বশিষ্ঠকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতবাক্যে কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি পণ্ডিতগণের মোক্ষলাভের কারণ মঙ্গলময় অক্ষর পরমব্রহ্ম ও বিনাশহেতু ক্ষর-পদার্থের বিষয় শ্রবণ করিতে নিতান্ত বাসনা করিতেছি, আপনি উহা কীৰ্ত্তন করুন।’

“বশিষ্ঠ কহিলেন, ‘মহারাজ! সমুদয় জগৎকে ক্ষর-পদার্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। দেবমানের দ্বাদশ সহস্র বৎসরে এক যুগ, চারি যুগে এক কল্প, দুই সহস্র কল্পে ব্রহ্মার দিবাবসানে রাত্রি হইলেই পৃথিবীর ক্ষয় হইয়া যায়। পরে ব্রহ্মার রাত্রি প্রভাত হইলে অণিমা, লঘিমা প্রভৃতি অষ্টসিদ্ধিসম্পন্ন জ্যোতির্ম্ময় ভগবান নারায়ণ জাগরিত হইয়া ব্রহ্মার সৃষ্টি করেন। ভগবান্ নারায়ণের হস্ত, পদ, চক্ষু ও মস্তক সৰ্ব্বত্র বিরাজিত রহিয়াছে এবং তিনি সৰ্ব্বস্থান আচ্ছাদনপূৰ্ব্বক অবস্থান করিতেছেন। পণ্ডিতেরা সেই নারায়ণকেই হিরণ্যগর্ভ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। বেদে ঐ মহাত্মা মহান, বিরিঞ্চি ও অজনামে এবং সাঙ্খ্যশাস্ত্রে উনি বিচিত্ররূপ, বিশ্বাত্মা, এক, অক্ষর প্রভৃতি বিবিধ নামে অভিহিত হইয়া থাকেন। এই ত্রৈলোক্য উহা হইতেই সমুৎপন্ন হইয়াছে। উহার রূপ নানাপ্রকার বলিয়া উনি বিশ্বরূপনামে বিখ্যাত। উনি বিকারযুক্ত হইয়া আপনি আপনার সৃষ্টি করিবার মানস করিলে সত্ত্বপ্রধানা প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ত্বের উৎপত্তি হয়। তৎপরে ঐ মহত্তত্ত্ব বিকারযুক্ত হইয়া তমঃপ্রধান অহঙ্কারের সৃষ্টি করে। ঐ অহঙ্কার হইতে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পঞ্চ সূক্ষ্মভূত এবং ঐ সূক্ষ্মভূতসমুদয় হইতে ক্রমশঃ আকাশ, বায়ু, তেজ, জল ও পৃথিবী এই পাঁচ মহাভূত উৎপন্ন হইয়া থাকে; এই দশটিকেই ভৌতিক সৃষ্টি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। অনন্তর মনের সহিত কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও ঘ্রাণ এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাক্য, হস্ত, পদ, পায়ু ও মেদ এই পাঁচটি কৰ্ম্মেন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। এই চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বসমুদয় দেহেই অবস্থান করিতেছে। তত্ত্বদর্শী ব্রাহ্মণগণ এই। তত্ত্বসমুদয় পরিজ্ঞাত হইতে পারিলে তাঁহাদিগকে কখনই শোকের বশীভূত হইতে হয় না। এই চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বই দেব, দানব, নর, যক্ষ, ভূত, পিশাচ, গন্ধৰ্ব্ব, কিন্নর, মহোরগ, চারণ, দেবর্ষি, নিশাচর, দংশ, কীট, মশক, পূতি, কৃমি, মূষিক, কুক্কুর, চণ্ডাল, চৈনেয়, পুক্কস, হস্তী, অশ্ব, খর, শার্দ্দুল, বৃক্ষ ও গো প্রভৃতি মূৰ্ত্তিমান্ জীবগণের দেহরূপে পরিণত হইয়াছে। জল, স্থল ও আকাশ এই তিন প্রদেশেই প্রাণীগণের আবাসস্থান। ঐ তিন প্রদেশে প্রাণীগণের যেসমুদয় মূৰ্ত্তি বিদ্যমান আছে, তৎসমুদয়ই ঐ চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বের বিকার। ঐ চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বে বিনির্ম্মিত পদার্থসমুদয় প্রতিদিন বিনষ্ট হইতেছে; এই নিমিত্তই উহাদিগকে ক্ষর বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই জগৎ মোহাত্মক, ইহা প্রথমে অব্যক্ত থাকিয়া পরে ব্যক্ত হয়; সুতরাং উহাকে অবশ্যই নশ্বর বলিতে হইবে।

‘হে মহারাজ! তুমি ক্ষর-পদার্থের বিষয় যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম; এক্ষণে অক্ষর-পদার্থের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত সনাতন বিষ্ণুই অক্ষর-পদার্থ। তিনি তত্ত্বমধ্যে পরিগণিত নহেন, যথার্থ বটে; কিন্তু ঐ সমুদয় তত্ত্বে অবস্থান করিতেছেন বলিয়া পণ্ডিতেরা তাঁহাকে পঞ্চবিংশতত্ত্ব বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। ঐ নিরাকার সর্ব্বশক্তিমান মহাত্মা চেতনরূপে সৰ্ব্বশরীরে অবস্থান করিতেছেন। ঐ মহাত্মা নির্গুণ হইয়া যখন সৃষ্টিসংহারকারিণী প্রকৃতির সহিত একীভাব অবলম্বন করেন, তখনই তিনি শরীরিরূপে পরিণত হইয়া সকলের গোচরে বর্ত্তমান ও জন্মমৃত্যুর বশীভূত হয়েন। প্রকৃতির সহিত একীভাবনিবন্ধনই ঐ মহাপুরুষের দেহে আত্মাভিমান জন্মে। উনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণযুক্ত হইয়া সাত্ত্বিকাদি-দেহে অভিন্নভাবে অবস্থানপূৰ্ব্বক সাত্ত্বিকাদি গুণের অনুরূপ কার্য্য করেন। তমোগুণদ্বারা তামসিক, রজোগুণদ্বারা রাজসিক ও সত্ত্বগুণদ্বারা সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হইয়া থাকে। প্রকৃতিসৃষ্ট যাবতীয় প্রাণী সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণপ্রভাবে শুক্ল, লোহিত ও কৃষ্ণবর্ণ বলিয়া অভিহিত হয়। উহাদের মধ্যে তমোগুণাবলম্বীরা নরকে, রজোগুণাবলম্বীরা মনুষ্যলোকে এবং সত্ত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা পরমসুখে দেবলোকে অবস্থান করে। যাহারা কেবল পাপানুষ্ঠান করে, তাহারা তিৰ্য্যগযোনি, যাহারা পুণ্য ও পাপ উভয় কাৰ্য্যে রত হয়, তাহারা মনুষ্যলোকে এবং যাহারা নিরন্তর পুণ্যসঞ্চয় করে, তাহারা দেবলোক প্রাপ্ত হইয়া থাকে।

‘হে মহারাজ! পণ্ডিতেরা মায়াসমুদ্ভূত বস্তুকেই ক্ষর এবং চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত মায়াতীত পদার্থকেই অক্ষর বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। তত্ত্বজ্ঞানদ্বারাই সেই অক্ষর-পদার্থ লাভ করা যায়, সন্দেহ নাই।’ ”