৩০৩তম অধ্যায়
কুন্তিভোজকর্ত্তৃক অতিথিসেবার্থ কুন্তীর নিয়োগ
কুন্তী কহিলেন, “হে রাজেন্দ্র! সত্য বলিতেছি, আপনি ব্ৰাহ্মণের নিকট যেরূপ প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছেন, আমি সংযত হইয়া অবশ্যই সেইরূপে তাহাকে আরাধনা করিব। বিপ্রের সেবা করা আমার স্বাভাবিক ধর্ম্ম, বিশেষতঃ আপনার প্রিয়কাৰ্য্য, অতএব উহা আমার পক্ষে পরম শ্রেয়স্কর, তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি যদি সায়াহ্নে, প্ৰাতে, রাত্রিকালে অথবা নিশীথসময়ে আগমন করেন, তথাপি আমাকে ক্রোধান্বিত করিতে পরিবেন না, আমি অবিরক্তভাবে তাঁহার পরিচর্য্যা করিব। মহারাজ! একে ত’ ব্ৰাহ্মণসেবা, তাহাতে আবার আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন ও হিতানুষ্ঠান, ইহার পর আমার আর শ্রেয়োলাভ কি আছে? আপনি বিশ্বস্ত হউন, আমি সত্য কহিতেছি, আপনার গৃহে বাস করিলে কোনক্রমেই সেই দ্বিজোত্তমের অপ্ৰিয়কাৰ্য্য বা সেবার ত্রুটি হইবে না। যাহা তাঁহার প্রিয় ও আপনার হিতকর, আমি তৎসাধনে সতত যত্ন করিব, আপনি কদাচ চিন্তিত হইবেন না।
“হে পৃথিবীনাথ! ব্রাহ্মণ পরমপূজনীয়, তাঁহার প্রসাদে অনায়াসে উদ্ধার হওয়া যায়, কিন্তু ব্ৰাহ্মাণের ক্রোধানল প্ৰজ্বলিত হইলে অবশ্যই বিনষ্ট হইতে হয়। ব্রাহ্মণের নিকট অপরাধী হইলে রাজাদিগেরও নানাবিধ অমঙ্গল ঘটিয়া থাকে। স্মরণ করিয়া দেখুন, পূর্ব্বে সুকন্যার অপরাধে তপোধন চ্যবন ক্রোধান্বিত হইলে রাজা শর্য্যাতির কিরূপ দুর্দ্দশা ঘটিয়াছিল। আমি এই সমস্ত বৃত্তান্ত বিশেষরূপে অবগত আছি, অতএব যাহাতে দ্বিজোত্তমের সন্তোষ জন্মে, তাহাই করিব, আমার নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণ হইতে আপনার কোন প্রকার অপকার হইবে না। আপনি যেরূপ অনুমতি করিয়াছেন, আমি বিশিষ্টরূপে নিয়মাবতী হইয়া তদনুসারে বিপ্ৰর্ষির সেবা করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
রাজা কন্যার এবম্প্রকার বাক্য শ্রবণ করিয়া আলিঙ্গনপূর্ব্বক তাঁহাকে ইতিকর্ত্তব্যতার উপদেশ প্ৰদান করিয়া কহিলেন, “ভদ্রে! যাহাতে আমার, তোমার ও বংশের হিত হয়, তাহাই করিবে।”
দ্বিজবৎসল কুন্তিভোজ এই কথা বলিয়া পৃথাকে ব্রাহ্মণসেবায় নিযুক্ত করিয়া সেই বিপ্রশ্রেষ্ঠকে কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! এই আমার কন্যা, ইনি অতি বালিকা, চিরকাল সুখে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছেন, কদাপি এরূপ বৃত্তি অবলম্বন করেন নাই, অতএব যদি ইহা হইতে কখন কোন অপরাধ হয়, তাহা হইলে আপনি কিছু মনে না করিয়া বরং ক্ষমা করিবেন। বাল, বৃদ্ধ ও তপস্বিগণ অত্যন্ত অপরাধী হইলেও ভবাদৃশ মহাভাগ ব্ৰাহ্মণেরা তাঁহাদিগের প্ৰতি কখন ক্ৰোধ প্রকাশ করেন না। গুরুতর অপরাধ হইলেও ব্রাহ্মণের ক্ষমা করা উচিত এবং যথাশক্তি পূজা করিলে তাহা গ্রহণ করা কর্ত্তব্য।”
ব্রাহ্মণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া রাজবাক্যে সম্মত হইলে রাজা কুন্তিুভোজ প্রীতমনে তাহাকে সুধাধবলিত এক প্রাসাদ প্রদান করিলেন এবং তত্ৰস্থ অগ্নিশরণে [অগ্নিহোত্র স্থানে—যেস্থানে যজ্ঞের অগ্নি স্থাপিত করা হয়] রুচির আসন ও আহারাদি দ্রব্য-সামগ্ৰী-সকল নিবেদন করিয়া দিলেন।
অনন্তর রাজপুত্রী পৃথা শুচি হইয়া দ্বিজোত্তমের নিকট গমন করিলেন। তিনি আলস্য ও অভিমান পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রযত্নাতিশয়সহকারে দেবতার ন্যায় তাঁহার সেবা করিয়া পরম পরিতুষ্ট করিতে লাগিলেন।