৩০২. সাঙ্খ্যমতের সারসঙ্কলন

৩০২তম অধ্যায়

সাঙ্খ্যমতের সারসঙ্কলন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! এই ত্রিলোকমধ্যে আপনার অবিদিত কিছুই নাই। আপনি আমার নিকট সাধুসম্মত যোগমার্গ বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিলেন; এক্ষণে সাঙ্খ্যমতানুযায়ী বিধিসমুদয় আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! কপিলাদি মহর্ষিগণ এই সূক্ষ্ম সাঙ্খ্যমত যেরূপে নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এই সাঙ্খ্যমত অভ্রান্ত ও বহুবিধ গুণযুক্ত। ইহাতে দোষের লেশমাত্র নাই। যাঁহারা জ্ঞানবলে মানুষ, পিশাচ, রাক্ষস, যক্ষ, উরগ, গন্ধৰ্ব্ব, পিতৃলোক, তির্য্যযোনি, গরুড়, বায়ু, রাজর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, অসুর, বিশ্বদেব, দেবর্ষি, যোগী ও প্রজাপতিগণের এবং ব্রহ্মার বিষয়সমুদয় সদোষ বলিয়া বিবেচনা করেন, যাঁহারা জীবিতকাল, সুখের যথার্থ তত্ত্ব, বিষয়াভিলাষী, তির্য্যযোনিসম্ভূত ও নরকনিপতিত ব্যক্তিদিগের দুঃখ এবং স্বর্গ, বৈদিক কাৰ্য্য, জ্ঞানযোগ, যোগ ও সাঙ্গণের গুণদোষসমুদয় বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন; যাঁহারা আনন্দ, প্রীতি, উদ্বেগ, খ্যাতি, পুণ্যশীলতা, সন্তোষ, শ্রদ্ধা, সরলতা, দানশীলতা ও ঐশ্বৰ্য্য এই দশগুণযুক্ত সত্ত্বগুণ,—আত্মতত্ত্ববোধ, নির্দ্দয়তা, সুখদুঃখসেবা, ভেদ, পুরুষত্ব, কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার ও দ্বেয় এই নবগুণযুক্ত। রজোগুণ,—মোহ, মহামোহ, তম, তামিস্র, অন্ধতমিস্র, নিন্দা, প্রমাদ ও আলস্য এই অষ্টগুণযুক্ত তমোগুণ,—অহঙ্কার, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দযুক্ত বুদ্ধি, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়যুক্ত মন এবং বায়ু প্রভৃতি চারিভূতযুক্ত আকাশের যথার্থ তাৎপর্য্য অবধারণে সমর্থ হয়েন; যাঁহারা মতান্তরোক্ত সংশয়, নিশ্চয়, গৰ্ব্ব ও স্মরণ এই চতুৰ্ব্বিধ গুণযুক্ত বুদ্ধি,অপ্রতিপত্তি, বিপ্রতিপত্তি ও বিপরীতপ্রতিপত্তি এই ত্রিবিধ গুণযুক্ত তমোগুণ,—প্রবৃত্তি ও দুঃখ এই দ্বিবিধ গুণযুক্ত রজোগুণ এবং প্রকাশরূপ একমাত্র গুণযুক্ত সত্ত্বগুণের যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইয়াও প্রলয় ও আত্মতত্ত্ব পৰ্য্যালোচনে সমর্থ হয়েন; তাঁহারাই মঙ্গলকর মোক্ষপদলাভে সমর্থ হইয়া থাকেন। রূপ দৃষ্টিকে, গন্ধ ঘ্রাণকে, শব্দ কর্ণকে, রস জিহ্বাকে, স্পর্শ ত্বকে, বায়ু আকাশকে, মোহ তমোগুণকে, লোভ অর্থকে, বিষ্ণু গমনকে, ইন্দ্র বলকে, অনল জঠরকে, পৃথিবী সলিলকে, সলিল তেজকে, তেজ বুদ্ধিকে, বুদ্ধি বায়ুকে, বায়ু আকাশকে, আকাশ মহত্তত্ত্বকে, মহত্তত্ত্ব বুদ্ধিকে, বুদ্ধি তমোগুণকে, তমোগুণ রজোগুণকে, রজোগুণ সত্ত্বগুণকে, সত্ত্বগুণ আত্মাকে, আত্মা দেবদেব নারায়ণকে এবং নারায়ণ মোক্ষকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছেন।

“মোক্ষ কাহারও আশ্রিত নহে। এই বিষয়ে বিশেষরূপে জ্ঞাত হওয়া মোক্ষার্থীদিগের নিতান্ত আবশ্যক। যে মহাত্মা এই বৃত্তান্ত সবিশেষ অবগত হয়েন এবং যিনি সত্ত্বগুণের কার্য্য, ইন্দ্রিয়াদি ষোড়শগুণে পরিবৃত মানবদেহ, দেহসমাশ্রিত স্বভাব ও চেতনা, উদাসীনস্বরূপ পাপবিহীন পরমাত্মা, পুণ্যপাপের ফলভোগী জীবাত্মা, আত্মসমাশ্রিত ইন্দ্রিয় ও বিষয়সমুদয়, মোক্ষের দুর্ল্লভ,-প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান এবং অধঃস্থিত ও ঊৰ্দ্ধগত এই সপ্তবিধ বায়ুর গতি,—প্রজাপতি ও ঋষিদিগের চরিত্র, পুণ্যের বিবিধ পথ, সপ্তর্ষি, রাজর্ষি, সুরর্ষি ও সূর্য্যের ন্যায় ব্রহ্মর্ষিদিগের কালক্রমে ঐশ্বৰ্য্যনাশ,—প্রাণীগণের বিনাশ, পাপাত্মাদিগের অশুভ গতি, বৈতরণীনদীতে নিমগ্ন পতিত ব্যক্তিদিগের দুর্গতি, বিবিধ যোনিতে জন্মগ্রহণ,শ্লেষ্ম, মূত্র পুরীষ, শোণিত, শুক্র, মজ্জা ও স্নায়ুপরিপূর্ণ দুর্গন্ধময় গর্ভে বাস,—শিরাশতসমাকীর্ণ অপবিত্র নবদ্বারপুরে অবস্থিত আত্মার বিবিধ যোগ,—সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস এই ত্রিবিধ প্রাণীর তত্ত্বজ্ঞানী মহাত্মাদিগের নিন্দিত মোক্ষবিরোধী ব্যবহার, রাহুকর্ত্তৃক চন্দ্র-সূৰ্য্যের গ্রাস, তারা ও নক্ষত্রগণের পরস্পর হিংসা, বাল্যনিবন্ধন মোহ [বাল্যকালের বুদ্ধির তুল্য], দেহের ক্ষয়, রাগ ও মোহাক্রান্ত ব্যক্তিদিগের ক্ষণিক সত্ত্বগুণ আশ্রয়, সহস্র সহস্র ব্যক্তির মধ্যে একজনের মোক্ষবুদ্ধি অবলম্বন, অলব্ধ পদার্থে অনুরাগ, লব্ধ বস্তুতে ঔদাসীন্য, বিষয়ের বন্ধহেতু, মৃতপুরুষদিগের দেহ, প্রাণীদিগের গৃহে অবস্থান ও দুঃখ, ব্রহ্মহত্যাকারী, পতিত, পামর, গুরুদারাপহারী, দুরাত্মা, সুরাপাননিরত ব্রাহ্মণগণের নরকগমন, মাতৃসেবাবিহীন, দেবার্চ্চনপরাঙ্মুখ, অশুভকৰ্ম্মনিরত ও তিৰ্য্যগযোনিগত প্রাণীগণের নানাবিধ দুর্গতি, বেদসমুদয়ের তত্ত্ব, সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ ও দিবসের ক্ষয়, চন্দ্র, সমুদ্র ও ঐশ্বর্য্যের হ্রাসবৃদ্ধি, সংযোগ, যুগ, পৰ্ব্বত, নদী ও বণর্সমুদয়ের ক্ষয়, মনুষ্যগণের জরা, মৃত্যু, জন্ম, দুঃখ ও দেহদোয দুর্গন্ধ এবং স্বীয় আত্মা ও দেহের দোষসমুদয়ের বিষয় বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনিই মোক্ষলাভে অধিকারী হয়েন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্যের দেহে কোন্ কোন্ দোষ বিদ্যমান আছে, তাহা আমি বিশেষরূপে জানিতে পারি নাই; অতএব আপনি উহা আমার নিকট সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! কপিলমতানুযায়ী সাঙ্খ্যাচাৰ্য্যগণ কহিয়া থাকেন যে, সমুদয় প্রাণীর শরীরেই কাম, ক্রোধ, ভয়, নিদ্রা ও শ্বাস এই পাঁচ দোষ বিদ্যমান আছে। ক্ষমাশীল হইলে ক্রোধকে, সঙ্কল্পত্যাগী হইলে কামকে, সত্ত্বগুণাবলম্বী হইলে নিদ্রাকে, অপ্রমত্ত হইলে ভয়কে ও অল্পাহারনিরত হইলে শ্বাসকে জয় করিতে পারা যায়। বিজ্ঞতম সাঙ্খাচাৰ্য্যগণ গুণসমুদয়দ্বারা গুণ, দোষসমুদয়দ্বারা দোষ ও কারণসমুদয়দ্বারা কারণসমুদয় বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইয়া জ্ঞানযোগপ্রভাবে এই সংসারকে সলিলফেনের ন্যায় বিনশ্বর, বিষ্ণুর মায়ায় সমাচ্ছন্ন চিত্রিত ভিত্তির ন্যায় অকিঞ্চিৎকর, তৃণের ন্যায় অসার, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিবরের ন্যায় ভয়ঙ্কর, সুখবিহীন, অবশীভূত, রজ ও তমোগুণে পরিপূর্ণ বিবেচনা করিয়া অপত্যস্নেহাদি পরিত্যাগ এবং তপোরূপ দণ্ড ও জ্ঞানরূপ শস্ত্রদ্বারা সত্ব, রজ ও তমোগুণ-সমুৎপন্ন গুণ-দোষ সমুদয় উচ্ছেদপূৰ্ব্বক সংসারসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়া থাকেন।

“সংসারসমুদ্র নিরন্তর দুঃখরূপ জল, চিন্তা ও শোকরূপ মহাহ্রদ, ব্যাধি ও মৃত্যুরূপ জলজন্তু, মহাভয়রূপ মহাসর্প, তমোগুণরূপ কুৰ্ম্ম, রজোগুণরূপ মৎস্য, স্নেহরূপ পঙ্ক, জরারূপ দুর্গমস্থান, কৰ্ম্মরূপ গভীরতা, সত্যরূপ তীর, হিংসারূপ মহা তরঙ্গ, বিবিধ রস ও প্রীতিরূপ মহারত্ন, দুঃখ ও জ্বররূপ বায়ু, শোক ও তৃষ্ণারূপ মহাবৰ্ত্ত, তীক্ষ্ণ [কঠিন] ব্যাধিরূপ মহাগজ, অস্থিরূপ সোপান, শ্লেষ্মরূপ ফেন, শোণিতরূপ বিদ্রুম [রক্তপ্রবাল], দানরূপ মুক্তার আকর, হাস্য ও চীৎকাররূপ নির্ঘোষ, নানা জ্ঞানরূপ দুস্তরতা, অশ্রুরূপ ক্ষার, সঙ্গত্যাগরূপ পরম আশ্রয়, জন্ম ও মরণরূপ তরঙ্গ, পুত্র ও বান্ধবরূপ পতন, অহিংসা ও সত্যরূপ সীমা, প্রাণত্যাগরূপ মহাপ্রবাহ, বেদান্তজ্ঞানরূপ দ্বীপ ও মোক্ষরূপ দুর্ল্লভ বিষয়ে সমাকীর্ণ রহিয়াছে। যে মহাত্মারা এই সংসারসমুদ্রের তত্ত্ব অবগত হইয়া স্থূলদেহাভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আত্মাকে হৃদয়াকাশস্থ বলিয়া বিবেচনা করিতে পারেন, সৰ্ব্বপ্রথমে সূৰ্য্য মৃণালতন্তুদ্বারা জলাকর্ষণের ন্যায়, কিরণজালদ্বারা চতুর্দ্দশ ভুবনস্থ ঐশ্বৰ্য্যসমুদয় আকর্ষণপুৰ্ব্বক -সেই সুকৃতিদিগকে প্রদান করিয়া থাকেন। তৎপরে সূক্ষ্ম, শীতল, সুগন্ধ, সুখস্পর্শ বায়ু তাঁহাদিগকে বহন করে। তদনন্তর সপ্তমারুতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাত তাঁহাদিগকে পবিত্র লোকসমুদয় প্রদর্শনপূৰ্ব্বক হৃদয়াকাশে নীত করিয়া থাকে। তৎপরে তাঁহারা হৃদয়াকাশ হইতে রজোগুণ, রজোগুণ হইতে সত্ত্বগুণ, সত্ত্বগুণ হইতে ভগবান্ নারায়ণ ও নারায়ণ হইতে পরমাত্মাকে লাভ করিয়া বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয়েন। হে ধৰ্ম্মরাজ! সত্য আর্জ্জবসম্পন্ন, সৰ্ব্বভূতে দয়াবান, বিষয়রাগশূন্য মহাত্মাদিগেরই এইরূপ পরমগতিলাভ হয়, সন্দেহ নাই।”

মুক্তির পরবর্ত্তী অবস্থা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মুমুক্ষু ব্যক্তিদিগের মোক্ষপদলাভ হইলে আর জন্মমৃত্যুবৃত্তান্ত স্মরণ হয় কি না? কোন বেদে কহে, মোক্ষাবস্থাতেও বিশেষ জ্ঞান বিদ্যমান থাকে; আর কোন বেদে কহে, মোক্ষলাভ হইলে জ্ঞানের লেশমাত্র থাকে না। এক মোক্ষবিষয়ে এইরূপ দ্বিবিধ মত প্রকটিত হওয়াতে বেদবিরোধরূপ মহাদোষ উপস্থিত হইতেছে। যাহা হউক, যদি জীব জীবন্মুক্ত হইলেও বিশেষজ্ঞান বিদ্যমান থাকে, তাহা হইলে কষ্টসাধ্য মোক্ষকামনার প্রয়োজন কি? সুখসাধ্য স্বর্গাদিসাধক কৰ্ম্মানুষ্ঠানই ত’ শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে। আর যদি জ্ঞানমাত্রও বিদ্যমান না থাকে, তাহা হইলে সুষুপ্তির ন্যায় পুনরায় ত’ বিশেষ জ্ঞানের আবির্ভাব হইতে পারে? এক্ষণে আপনি এই বিষয়ের যথার্থ তত্ত্ব কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি অতি দুরূহ প্রশ্ন করিয়াছ; এ প্রশ্নে মহাত্মা পণ্ডিতগণেরও মহামোহ উপস্থিত হইয়া থাকে। এক্ষণে আমি ইহার যথার্থ তত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কপিলাদি মহর্ষিগণই এ বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছেন। অতি সূক্ষ্ম জীবাত্মা মানবগণের দেহমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক স্বপ্রকাশিত ইন্দ্রিয়াদিদ্বারা পদার্থসমুদয় সন্দর্শন করিতেছেন। জীবাত্মা না থাকিলে ইন্দ্রিয়সমুদয় কাষ্ঠের ন্যায় চেষ্টাশূন্য ও অর্ণবসমুত্থিত ফেনার ন্যায় ক্ষণকালমধ্যে বিনষ্ট হয়, সন্দেহ নাই। মানবগণ নিদ্রিত হইলে ইন্দ্রিয়সমুদয় কার্য্যক্ষম হইয়া বিষহীন সর্পের ন্যায় স্থিরভাবে স্ব স্ব স্থানে লীন হইয়া থাকে। ঐ সময় একমাত্র জীবাত্মা আকাশসঞ্চারী সমীরণের ন্যায় মনুষ্যগণের সৰ্ব্বশরীরে বিচরণ করে এবং সূক্ষ্মগতিদ্বারা ইন্দ্রিয়গণের স্থানসমুদুয়ে গমনপূর্ব্বক জাগ্ৰদবস্থার ন্যায় সেই নিদ্রিতাবস্থাতেও দর্শনস্পর্শনাদি সমুদয় কাৰ্য্যসম্পাদন করিয়া থাকে। সত্ত্ব, রজ, তম, বুদ্ধি, মন, আকাশ, বায়ু, স্নেহ, জল ও পৃথিবীর গুণসমুদয় জীবাত্মাতে সন্নিহিত রহিয়াছে। পরমাত্মা ঐ সকল গুণদ্বারা জীবাত্মাকে ব্যাপ্ত করিয়া অবস্থান করিতেছেন। জীবাত্মা ঐ সমুদয় গুণ ও শুভাশুভ কাৰ্য্যসমূহে পরিবৃত রহিয়াছে। ইন্দ্রিয়নিচয় শিষ্যের ন্যায় উহার নিকট অবস্থান করিতেছে। জীবাত্মা যখন সমুদয় কাৰ্য্যকারণ অতিক্রম করিয়া দ্বন্দ্ববিহীন নারায়ণাত্মক পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হয়, তখন আর তাহার পুণ্য বা পাপের লেশমাত্র থাকে না এবং আর তাঁহাকে পরমাত্মা হইতে পৃথক হইতে হয় না। জ্ঞানী ব্যক্তি এইরূপে নারায়ণাত্মক পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হইয়া জীবন্মুক্ত হইলেও পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন দেহনিপাত পর্য্যন্ত তাঁহার শরীরমধ্যে অবস্থান করিয়া তাঁহাকে জন্মান্তরীণ পাপপুণ্যের ফলভোগ করায়। কিন্তু সেই ফলভোগদ্বারা জীবন্মুক্তের সুখদুঃখের আবির্ভাব হয় না। মুমুক্ষু ব্যক্তিরা এইরূপ জ্ঞানলাভ করিতে পারিলে অতি অল্পকালমধ্যে অনায়াসেই দেহবিমুক্ত হইয়া শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হইয়া থাকেন।

“বিজ্ঞতম সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা এই জ্ঞানবলেই পরমগতি লাভ করেন। ইহার তুল্য উৎকৃষ্ট জ্ঞান আর কিছুই নাই। তুমি ইহাতে কিছুমাত্র সংশয় করিও না। মহাত্মা মনীষিগণ এই সাঙ্খ্যমতকে অক্ষর, ধ্রুব, পূর্ণব্রহ্ম, সনাতন, নির্ব্বন্দ্ব, নির্ব্বিকার, নিত্য এবং আদি, অন্ত ও মধ্যবিহীন বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। উহা যোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, উহা হইতে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় উপস্থিত হয়। পরম ঋষিরা শাস্ত্রমধ্যে সাঙ্খ্যমতকেই উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রশংসা করিয়া থাকেন। দেবতা, ব্রাহ্মণ, যোগী, সাঙ্খ্যমতাবলম্বী ও শান্তিগুণাবলম্বী ব্যক্তিরা যে পরমাত্মার প্রতিনিয়ত স্তব করিয়া থাকেন, সাঙ্খ্যশাস্ত্রই সেই নিরাকার পরব্রহ্মের মূর্তিস্বরূপ।

“এই পৃথিবীতে স্থাবর ও জঙ্গম এই দ্বিবিধ পদার্থ বিদ্যমান। রহিয়াছে, তন্মধ্যে জঙ্গম পদার্থই শ্রেষ্ঠ। বেদ, যোগশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, ইতিহাস ও পুরাণে যে লৌকিক ও পরমাত্মিক জ্ঞানের দৃষ্ট হইয়া থাকে, সমুদয়ই সাঙ্খ্যশাস্ত্র হইতে গৃহীত হইয়াছে। সাঙ্খ্যশাস্ত্রে শান্তি, বল, সূক্ষ্ম তপস্যা ও সুখের বিষয় বিশেষরূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা আপনাদিগের মতানুযায়ী কাৰ্য্যসমুদয় সম্যকরূপে অনুষ্ঠান করিতে না পারিলেও তাঁহাদের অধোগতি হয় না। প্রত্যুত তাঁহারা দেবতোক পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক কৃতার্থ হইয়া পুনরায় ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন। উঁহারা দেহ পরিত্যাগ করিয়া উত্তরোত্তর উৎকৃষ্ট লোকেই প্রবিষ্ট হয়েন। যাঁহারা সাঙ্খ্যমত অবলম্বনপূৰ্ব্বক জ্ঞানান্বেষণে যত্নবান হয়েন, তাঁহারা জ্ঞানের সম্যক্ উৎকর্ষসাধন করিতে না পারিলেও তাঁহাদিগকে তির্য্যযোনিগমন, অধঃপতন বা পাপাত্মাদিগের সহবাসজনিত ক্লেশ সহ্য করিতে হয় না। যিনি মহার্ণবতুল্য অতিবিশাল এই পুরাতন সাঙ্খ্যমত সম্যক্‌রূপে অবগত হইতে পারে, তিনিই নারায়ণস্বরূপ।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট সাঙ্খ্যমত কীর্ত্তন করিলাম। সাঙ্খ্যতত্ত্ব ভগবান নারায়ণের স্বরূপ। ঐ মাহাত্ম সৃষ্টিসময়ে এই বিশ্বসংসার নির্ম্মাণ করেন এবং প্রলয়সময়ে সমুদয়ের সংহারপূৰ্ব্বক স্বশরীরে বিলীন করিয়া পরমসুখে নিদ্রিত হয়েন।”