৩০২তম অধ্যায়
কর্ণের অবধ্যত্ববিধায়ক কুণ্ডলাদির বিবরণপ্রসঙ্গে কুন্তীর অতিথিসেবা বর্ণন
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে তপোধন! ভগবান সূৰ্য্য কর্ণের নিকট যে গূঢ় বৃত্তান্ত গোপন করিলেন, তাহা কি? সেই কুণ্ডলদ্বয় ও কবচই বা কিরূপ এবং তিনি কোথা হইতেই বা ঐ কবচ ও কুণ্ডলযুগল প্রাপ্ত হইলেন? উহা সবিশেষ শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক কীর্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূর্ব্বে মহাতেজাঃ শ্মশ্রুবিশিষ্ট, দণ্ডধারী, প্ৰাংশু [উন্নত—দীর্ঘকায়] ও জটিল এক ব্রাহ্মণ রাজা কুস্তিভোজের নিকট উপনীত হন। তিনি পরমদর্শনীয়, মধুরভাষী ও তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন; দেখিলে সাক্ষাৎ অগ্নির ন্যায় বোধ হয়। সেই মহাতপাঃ কুন্তিভোজকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি ভিক্ষার্থী, আপনার গৃহে ভোজন করিতে অভিলাষ করি; কিন্তু আপনি বা আপনার অনুচরবর্গ আমার কোন প্রকার অপ্রিয় কাৰ্য্য করিতে পরিবেন না, আমার যখন যে স্থানে ইচ্ছা হইবে, গমন করিব এবং আমি স্বেচ্ছাক্রমে প্রত্যাগত হইব। আমার শয়ন ও উপবেশনকালে কেহ কোন প্রকার অপ্ৰিয়াচরণ করিতে পরিবে না। যদি ইহাতে সম্মত হন, তাহা হইলে আমি আপনার গৃহে বাস করি।”
রাজা কুন্তিভোজ প্রীতমনে ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া ব্রাহ্মণের বাক্যে অনুমোদন করিলেন; পরে বিনীতভাবে কহিলেন, “হে মহাপ্রাজ্ঞ! পৃথানামে আমার এক যশস্বিনী কন্যা আছেন; তিনি অতি সচ্চরিত্রা, সাধবী ও ধর্ম্মপরায়ণা। তিনি ভক্তিপূর্ব্বক আপনার পরিচর্য্যা করিবেন; আপনি তাঁহার সদ্ব্যবহার ও সুশীলতায় পরম পরিতুষ্ট হইবেন, সন্দেহ নাই।”
রাজা এই কথা বলিয়া ব্রাহ্মণের যথাবিধি সৎকারপূর্ব্বক পৃথুলোচনা [আয়তনেত্ৰা] পৃথার নিকট উপনীত হইয়া কহিলেন, “বৎসে! ঐ ব্রাহ্মণ আমার গৃহে বাস করিতে অভিলাষী, আমিও উহার ইচ্ছাপূরণে প্রতিশ্রুত হইয়াছি; অতএব তুমি সাবধানে ঐ ব্রাহ্মণের পরিচর্য্যায় নিযুক্ত হও; দেখ, যেন আমার বাক্য কদাপি মিথ্যা না হয়। ঐ মহাতেজঃ স্বাধ্যায়সম্পন্ন তপস্বী যখন যাহা বলিবেন, নির্ম্মৎসর হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহা প্ৰদান করিবে। বৎসে! ব্ৰাহ্মণই পরমতেজ ও ব্রাহ্মণই পরমতপঃস্বরূপ, ব্রাহ্মণের নমস্কারপ্রভাবে ভগবান উষ্ণরশ্মি অন্তরীক্ষে বিরাজমান রহিয়াছেন। মহাসুর বাতাপি ও তালজঙ্ঘ পূজনীয় ব্রাহ্মণগণের সম্মানরক্ষা না করিয়া ব্ৰহ্মদণ্ডে নিহত হইয়াছে। সম্প্রতি ঐ মহাভাগ ব্রাহ্মণের শুশ্রূষার ভার তোমাতেই অৰ্পিত হইল; তুমি সর্ব্বদা সংযতচিত্তে উহার সেবা কর।
“ব্রাহ্মণ, গুরু ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি বাল্যাবধি তোমার যে বিশেষ ভক্তি আছে, তাহা আমি জানি; তুমি ভৃত্যবৰ্গ আত্মীয়স্বজন, মাতৃগণ ও আমাকে যথোচিত সমাদর করিয়া থাক। তোমার সদ্ব্যবহারে নগরস্থ ও অন্তঃপুরস্থ সমস্ত লোক এবং দাসদাসীগণ সর্ব্বদা সন্তুষ্ট রহিয়াছে। বৎসে! তুমি বালিকা ও আমার কন্যা; এ নিমিত্ত তোমাকে আদেশ করিতেছি যে, অতি সাবধানে ঐ ব্রাহ্মণের পরিচর্য্যা করিবে; কারণ, ব্ৰাহ্মণজাতি সহজেই অতি কোপনস্বভাব। তুমি বৃষ্ণিকুলসম্ভূত রাজা সহজেই প্রিয়তমা কন্যা, বাসুদেবের ভগিনি, তোমার পিতা প্রীত হইয়া স্বয়ং বাল্যকালে তোমাকে আমায় প্ৰদান করিয়াছেন; তুমি আমার সন্তানসন্ততির মধ্যে শ্রেষ্ঠ; অগ্ৰে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া আমার দুহিতা হইয়াছ। তুমি বৃষ্ণিবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া আমাদিগের কুলে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছ, অতএব যেমন পদ্মিনী হ্রদ হইতে হ্রদন্তরে নীত হয়, সেইরূপ তুমিও সুখ হইতে সুখাস্তর প্রাপ্ত হইয়াছ। দুষ্কুলজাত প্রমদারা আবদ্ধ হইয়াও প্রায় বালস্বভাবসুলভ দোষাচরণ করিয়া থাকে; কিন্তু হে কল্যাণি! তুমি রাজকুলে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছ, অসাধারণ গুণসকল তোমাতে বিদ্যমান রহিয়াছে, তোমার রূপলাবণ্য অলোকসামান্য, সম্প্রতি তুমি অহঙ্কার ও অভিমান পরিহার করিয়া বরপ্ৰদ ঐ ব্রাহ্মণের আরাধনা কর, অবশ্যই শ্রেয়োলাভ হইবে, কিন্তু ঐ দ্বিজশ্রেষ্ঠের ক্ৰোধানল প্রজ্জ্বলিত হইলে আমার বংশ ধবংস হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”