৩০১. সাঙ্খ্য ও মোগবিষয়ক বিচার-মীমাংসা

৩০১তম অধ্যায়

সাঙ্খ্য ও মোগবিষয়ক বিচার-মীমাংসা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনার অপরিজ্ঞাত কিছুই নাই; অতএব আপনি সাঙ্খ্যমত ও যোগ এই দুইটির মধ্যে কোন্‌টি উৎকৃষ্ট, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা সাঙ্খ্যের এবং যোগীরা যোগেরই সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন। যোগিগণ ঈশ্বর ব্যতীত মুক্তিলাভের উপায়ান্তর নাই বলিয়া আপনাদিগের মতের শ্রেষ্ঠতা সম্পাদন করেন; কিন্তু সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা কহেন যে, ঈশ্বরে ভক্তি করিবার কোন প্রয়োজন নাই। যিনি সমুদয় তত্ত্ব অবগত হইয়া বিষয় হইতে বিমুক্ত হয়েন, তিনি দেহনাশের পর নিশ্চয়ই মুক্তিলাভে অধিকারী হইয়া থাকেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ঐ মুক্তিলাভকে সাঙ্খ্যমতোক্ত মোক্ষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে। হে ধৰ্ম্মরাজ! এই উভয়বিধ যুক্তি, উভয়পক্ষসমর্থক হিতবাক্য ও শিষ্টব্যক্তিদিগের মত গ্রহণ করা ভবাদৃশ ব্যক্তিমাত্রেরই অবশ্য কৰ্ত্তব্য। যোগ প্রত্যক্ষপ্রমাণ ও সাঙ্খ্যমত শাস্ত্রপ্রমাণ। এই উভয় মতই যথার্থ ও সাধুসম্মত। শাস্ত্রানুসারে ঐ উভয়ের মধ্যে অন্যতরের অনুষ্ঠান করিলেই মোক্ষপদ লাভ হইয়া থাকে। এই উভয় মতেই পবিত্রতা অবলম্বন, জীবগণের প্রতি দয়াপ্রকাশ ও বিবিধ ব্রতধারণ করা বিহিত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে; কিন্তু ঐ উভয় মতের শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট পথ সমান নহে।’

যোগবলের প্রশংসা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যখন উভয় মতেই ব্রত, শৌচ ও দয়া তুল্যরূপে নির্দ্দিষ্ট এবং উভয় মতেরই ফল সমান হইল, তখন ঐ উভয় মতের শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট পথ সমান হইল না কেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! মানবগণ যোগবলে কাম, ক্রোধ, মোহ, অনুরাগ ও স্নেহ এই পাঁচ দোষ পরিত্যাগ করিতে পারিলেই মোক্ষলাভে অধিকারী হয়। বৃহৎ বৃহৎ মৎস্যসমুদয় যেমন জালবিদারণপূর্ব্বক জলমধ্যে প্রবেশ করে এবং বলবান্ মৃগগণ যেমন বাগুরা [পাশ—বন্ধনরজ্জু] ছিন্ন করিয়া নিরাপদ পথে সমুত্তীর্ণ হয়, তদ্রূপ যোগবলান্বিত যোগিগণ লোভজনিত বন্ধনসমুদয় ছেদনপূর্ব্বক যোগবলে অনায়াসে অতি সুবিমল মঙ্গলকর মোক্ষমার্গে গমন করিতে সমর্থ হইয়া থাকেন। কিন্তু যে যোগিগণের যোগবল না জন্মে, তাহাদিগকে বাগুরাপতিত দুর্ব্বল মৃগের ন্যায়, জালনিবদ্ধ বলহীন মৎস্যের ন্যায় ও পাশবদ্ধ ক্ষীণবল বিহঙ্গমের ন্যায় কৰ্ম্মপাশে বদ্ধ হইয়া বিনষ্ট হইতে হয়। যোগবলই মুক্তিলাভের অদ্বিতীয় উপায়। যোগবলবিহীন যোগীরা বৃহত্তর কাষ্ঠসমাক্রান্ত অল্পমাত্র অগ্নির ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু যেসকল 
যোগী যোগবলসস্পন্ন, তাহারা অনায়াসে সমীরণসঞ্চালিত প্রদীপ্ত হুতাশনের ন্যায়, কল্পান্তকালীন মার্কণ্ডের ন্যায় সমুদয় জগৎ দগ্ধ করিতে পারেন। দুর্ব্বল ব্যক্তিরা যেমন স্রোতঃ প্রভাবে দূরে অপনীত হয়, তদ্রূপ যোগবলবিহীন অজিতেন্দ্রিয় যোগীরা বিষয়কর্ত্তৃক আকৃষ্ট
হইয়া থাকেন। কিন্তু স্রোত যেমন মাতঙ্গগণকে সঞ্চালিত করিতে পারে না, তদ্রূপ বিষয়সমুদয় যোগসম্পন্ন যোগীদিগকে কোনক্রমেই বিচলিত করিতে সমর্থ হয় না। যোগবলান্বিত মহাত্মারা কাহারও বশীভূত না হইয়া প্রজাপতি, ঋষি, দেবতা ও মহাভূতগণের অধরে প্রবিষ্ট হইতে পারেন। ভীমপরাক্রম কাল, যম ও মৃত্যু ক্রুদ্ধ হইয়াও তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে সমর্থ হয়েন না। তাঁহারা যোগবলে অসংখ্য দেহ ধারণ করিয়া সমুদয় পৃথিবী পর্য্যটন করিতে পারেন। যোগবলান্বিত যোগিগণের মধ্যে কেহ কেহ যোগৈশ্বর্য্যমাত্ৰ লাভ করিয়া নিরস্ত হয়েন, আর কেহ কেহ সূৰ্য্য যেমন কিরণজাল বিস্তার করিয়া ক্রমে ক্রমে উহা সঙ্কুচিত করেন, তদ্রূপ কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়া ক্রমে ক্রমে উহাতে শিথিলপ্রযত্ন হইয়া থাকেন। সংসারপাশচ্ছেদনে সমর্থ, যোগবলপরিপূর্ণ যোগীরা অনায়াসে মোক্ষলাভ করিতে পারেন, সন্দেহ নাই।

যোগীর সমাধি-অবস্থা—জীব ব্রহ্মের ঐক্য

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট যোগবলের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আত্মসমাধি ও যোগধারণাবিষয়ক সূক্ষ্ম নিদর্শনসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ধনুর্দ্ধারী ব্যক্তিরা যেমন অপ্রমত্ত ও সমাহিত হইয়া লক্ষ্য ভেদ করে, তদ্রূপ যোগিগণ অনন্যমনে যোগসাধন করিয়াই মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন। লোকে যেমন স্নেহপূর্ণ পাত্র মস্তকে সংস্থাপিত করিয়া অনন্যমনে সোপানে আরোহণ করে, তদ্রূপ যোগশীল ব্যক্তি সাবধান হইয়া আত্মাকে সূর্য্যের ন্যায় তেজঃপুঞ্জ, নিৰ্ম্মল ও নিশ্চল করিয়া ক্রমে ক্রমে যোগসম্বন্ধীয় উচ্চপদে অধিরূঢ় হইয়া থাকেন। কর্ণধারগণ যেরূপ সতর্কচিত্তে অবিলম্বে অর্ণবগত পোত লইয়া পরপার প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ যোগবিৎ মহাত্মারা জীবাত্মাকে পরমাত্মার সহিত ঐক্য করিয়া দুর্ল্লভ ব্রহ্মপদ লাভ করিয়া থাকেন। সারথি যেমন রথে লক্ষণাক্রান্ত অশ্বগণকে সংযোজনপূৰ্ব্বক একাগ্রচিত্তে সত্বর রথীকে অভীষ্টদেশে লইয়া যায়, তদ্রূপ যোগিগণের মন ইন্দ্রিয়সমুদয়ের সাহায্যে তাঁহাদের দেহস্থিত আত্মাকে পরমস্থানে নীত করে। সুশিক্ষিত রথীর হস্তনির্ম্মুক্ত শর যেমন লক্ষ্যে নিপতিত হয়, তদ্রূপ যোগবলসমন্বিত যোগীর আত্মা অচিরাৎ ব্রহ্মপদ লাভ করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি জীবাত্মাকে পরমাত্মাতে সংযোজনপূৰ্ব্বক অচলের ন্যায় স্থির হইয়া যোগসাধন করিতে পারেন, তিনিই পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া জ্ঞানীদিগের লভ্য সনাতন মোক্ষপদলাভে সমর্থ হয়েন। যে যোগী অহিংসাদি ব্রতপরায়ণ হইয়া নাভি, মস্তক, কণ্ঠ, হৃদয়, বক্ষঃস্থল, চক্ষু, কর্ণ ও নাসিকা এই সমুদয় স্থানে জীবাত্মার সহিত পরমাত্মাকে সম্যকরূপে সংযোজিত করিতে পারেন, তিনি রাশি রাশি পুণ্যপাপ দগ্ধ করিয়া উৎকৃষ্ট যোগবলে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।”

যোগিগণের আহারাদি আচরণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যোগশীল মহাত্মারা কীদৃশ আহার করিলে ও কি কি জয় করিতে পারিলে যোগবল লাভ করিতে পারেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যোগিগণের মধ্যে যাঁহারা তৈলঘৃতাদি-ভক্ষণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তিলকল্ক ও তণ্ডুলকণা আহার করেন, যাঁহারা বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া দিবাভাগের মধ্যে একবারমাত্র রূক্ষ [শুষ্ক-নির্জিব] যবান্ন ভোজন করেন, যাঁহারা দুগ্ধমিশ্রিত জল পান করিয়া ক্রমে ক্রমে এক দিন, এক পক্ষ, এক মাস, এক ঋতু ও এক সংবৎসর যাপন করিতে পারেন এবং যাঁহারা বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া সম্পূর্ণ এক মাস উপবাসী থাকিতে পারেন, তাঁহারাই যোগবল লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। বিষয়রাগবিহীন যোগশীল মহাত্মারা কাম, ক্রোধ, শীত, গ্রীষ্ম, বৃষ্টি, ভয়, শোক, শ্বাস, শব্দাদি বিষয়, তৃষ্ণা, অপ্রীতি, স্পর্শসুখ, নিদ্রা ও তন্দ্রা পরাজয়পূৰ্ব্বক বুদ্ধিপ্রভাবে ধ্যান ও অধ্যয়নদ্বারা পরমাত্মাকে প্রকাশিত করিয়া থাকেন। পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ এই যোগমার্গকে অতি দুর্গম বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। কোন ব্যক্তিই অনায়াসে এই পথে গমন করিতে পারেন না। যেমন দুই একজন যুবা পুরুষ বিবিধ সর্প, কণ্টক, দগ্ধবৃক্ষ, গৰ্ত্ত ও তস্করে সমাকীর্ণ দুর্গম অরণ্যপথ নির্ব্বিঘ্নে অতিক্রম করিয়া গমন করিতে পারেন, তদ্রূপ দুই একজন যোগশীল ব্রাহ্মণ। অব্যাঘাতে [বিনা বাধায়] যোগমার্গ অতিক্রম করিয়া পরমপদ লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

“যোগপথে অনেক বিঘ্ন আছে, এই নিমিত্ত সমুদয় যোগী উহা অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন না। বরং সুশাণিত ক্ষুরধার অবলম্বনপূর্ব্বক অবস্থান করা যায়, কিন্তু যোগধারণা অবলম্বন, করিয়া অবস্থান করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। কর্ণধারবিহীন অর্ণবপোত যেমন আরোহী পুরুষদিগকে অর্ণবমধ্যে বিপদ্‌গ্রস্ত করে, তদ্রূপ অসাধু ব্যক্তির আচরিত যোগধারণা তাহাকে বিপদসাগরে নিমগ্ন করিয়া থাকে। যে মহাত্মা বিধিপূৰ্ব্বক যোগানুষ্ঠান করিতে পারেন, তিনিই জন্মমরণ ও সুখদুঃখ পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়েন। আমি তোমার নিকট বিবিধ যোগশাস্ত্রনিষ্পন্ন যোগধৰ্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। এই যোগধৰ্ম্মে দ্বিজাতিগণেরই অধিকার আছে। ব্রহ্মস্বরূপ হওয়াই যোগের পরম ফল। যোগিগণ যোগবলে রজ ও তমোগুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ধৰ্ম্ম, ষড়ানন, ব্রহ্মার কপিলাদি ছয় পুত্র, বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণ, মূলপ্রকৃতি, বরুণের পত্নী সিদ্ধিদেবী, সমুদয় তেজ, সুমহৎ ধৈৰ্য্য, চন্দ্র, তারকাগণমণ্ডিত নিৰ্ম্মল আকাশ, বিশ্বদেবগণ, পিতৃলোক এবং যাবতীয় শৈল, সাগর, নদী, পবন, দিক, নাগ, যক্ষ, গন্ধৰ্ব্ব, স্ত্রী ও পুরুষে প্রবেশ করিয়া পুনরায় ঐ সমুদয় হইতে বহির্গত হইতে পারেন। ঈশ্বরবিষয়ক কথার আন্দোলন করিলে অবশ্যই শুভফলাফল হয়। যোগিগণ ঈশ্বরোপাসনাপ্রভাবেই সৰ্ব্বলোক হইতে শ্রেষ্ঠ ও নারায়ণস্বরূপ হইয়া অনায়াসে সমুদয় পদার্থের সৃষ্টি করিতে পারেন, সন্দেহ নাই।”