৩০০তম অধ্যায়
সৎকৰ্ম্ম নির্ণয়—হংসরূপী ব্রহ্মার উপদেশ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বিদ্বান্ ব্যক্তিরা সত্য, দম, ক্ষমা, প্রজ্ঞার প্রশংসা করিয়া থাকেন; এক্ষণে ঐ সমূদয় বিষয়ে আপনার অভিপ্রায় কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই উপলক্ষে আমি পূৰ্ব্বকালে সাধ্যগণের সহিত হংসের যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদী অনাদিনিধন [আদি-অন্তহীন] ভগবান্ প্রজাপতি সুবর্ণময় হংসমূর্তি ধারণ করিয়া ত্রিলোক পরিভ্রমণ করিতে করিতে সাধ্যগণের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। সাধ্যগণ সেই হংসকে অবলোকনপূৰ্ব্বক সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বিহগরাজ! আমরা সাধ্যদেব; তোমার নিকট মোক্ষধৰ্ম্ম ও অন্যান্য বিষয় জিজ্ঞাসা করিব। তুমি মোক্ষধৰ্ম্মকুশল, পণ্ডিত, ধীরপ্রকৃতি ও বচন রচনাচতুর; অতএব ইহলোকে কোন্ কার্য্যে তোমার মন অনুরক্ত হইয়াছে এবং কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে সমুদয় বন্ধন হইতে বিমুক্ত হওয়া যায়, তাহা কীৰ্ত্তন কর; আমরা তাহারই অনুষ্ঠান করিব।’
“তখন সেই হংসরূপী ভগবান্ প্রজাপতি সাধ্যগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবগণ! আমি শুনিয়াছি, তপস্যা, দমগুণাবলম্বন, সত্যবাক্যপ্রয়োগ ও চিত্তজয় করাই সৰ্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। হৃদয়গ্রন্থি[৩]সমুদয় মোচনপূর্ব্বক প্রিয় বিষয়ে হর্য্য ও অপ্রিয় বিষয়ে বিবাদ পরিত্যাগ করা নিতান্ত আবশ্যক। মর্ম্মভেদী নৃশংস বাক্যপ্রয়োগ ও নীচব্যক্তির নিকট প্রতিগ্রহ করা বিধেয় নহে। যে বাক্যে অন্যের মনোব্যথা উপস্থিত হয় এবং যে বাক্য উচ্চারণ করিলে পাপস্পৃষ্ট হইতে হয়, তাদৃশ বাক্য প্রয়োগ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। বদন হইতে বাকশল্য বিনির্গত হইলেও তন্নিবন্ধন দিবানিশি অনুতাপ করিতে হয়; অতএব কুবাক্য পরিত্যাগ করাই পণ্ডিত ব্যক্তির অবশ্য কর্ত্তব্য। যদি ইতর ব্যক্তি পণ্ডিতের প্রতি কুবাক্য প্রয়োগ করে, তাহা হইলে শান্তি অবলম্বনপূৰ্ব্বক তাহাকে ক্ষমা করাই পণ্ডিতের উচিত। কারণ, অন্যে রোযিত করিবার চেষ্টা করিলে যিনি ক্রোধ সংবরণ করিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করিতে পারেন, তিনি অনায়াসে তকৃত পুণ্যের অধিকারী হয়েন।
‘হে সাধুগণ! কেহ আমার প্রতি আক্রোশ প্রকাশ বা আমাকে নিপীড়িত করিলে আমি কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান না করিয়া তাহাকে ক্ষমা করিয়া থাকি। সাধুব্যক্তিরা ক্ষমা, সত্য, সরলতা ও অনৃশংসতাকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। বেদের ফল সত্য, সত্যের ফল দমগুণ এবং দমগুণের ফল মোক্ষ। যিনি বাক্য, মন, ক্রোধ, প্রতিচিকীর্ষা [প্রতিকারের ইচ্ছা], উদর ও উপস্থের বেগ সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন, আমি তাহাকেই যথার্থ ব্রাহ্মণ ও মুনি বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকি। ক্রোধনস্বভাব অপেক্ষা সহিষ্ণু, অমানুষ অপেক্ষা মানুষ এবং অজ্ঞান হইতে জ্ঞানবান্ ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইয়া থাকেন। কেহ আক্রোশ করিলে যিনি তাহার প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করিয়া ক্রোধাবেগ সংবরণ করিতে পারেন, তিনি আক্রোশকৰ্ত্তার সমুদয় পুণ্যসংগ্রহে সমর্থ হয়েন; আর আক্রোশকর্ত্তাকে আপনার কুকার্য্যনিবন্ধন প্রতিনিয়ত দগ্ধ হইতে হয়। যে ব্যক্তি অন্যে কটুবাক্য প্রয়োগ করিলে কটুবাক্য প্রয়োগ বা স্তুতিবাদ করিলে প্রিয়বাক্য প্রয়োগ এবং প্রহার করিলে প্রতি প্রহার বা প্রহারকার অনিষ্ট বাসনা না করেন, তিনিই দেবতাদিগের সালোক্যলাভে সমর্থ হয়েন। পাপাত্মা ব্যক্তি অপমান বা প্রহার করিলে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় তাহাকে ক্ষমা করা বিধেয়; তাহা হইলে অনায়াসে সিদ্ধিলাভ হইতে পারে।
‘আমার সমুদয় বাসনা পরিপূর্ণ হইয়াছে; তথাপি আমি সর্ব্বদা সাধুগণের সেবা করিয়া থাকি। আমার কাৰ্য্যবাসনা বা রোষের লেশমাত্রও নাই। ধন হস্তগত হইলেও আমি ধৰ্ম্ম হইতে বিচলিত হই না এবং ধনলাভার্থে কাহারও নিকট কিছুমাত্র প্রার্থনা করি না। আমাকে কেহ অভিসম্পাত করিলে আমি তাহাকে শাপপ্রদানে প্রবৃত্ত হই না। দমগুণই পুণ্যের দ্বারস্বরূপ বলিয়া আমার বোধ হইয়াছে।
‘কোন জন্তুই মনুষ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে। ধীর ব্যক্তিরা মেঘনির্ম্মুক্ত চন্দ্রমার ন্যায় পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া স্ব স্ব ধৈর্য্যগুণপ্রভাবে সিদ্ধিলাভ কবিয়া থাকেন। সমুদয় লোকে যাঁহাকে ব্রহ্মাণ্ডমণ্ডপের স্তম্ভের ন্যায় জ্ঞান করিয়া অর্চ্চনা এবং যাঁহার প্রতি সকলেই প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করে, তিনি সংযমপ্রভাবে অনায়াসে দেবলোকে গমন করিতে সমর্থ হয়েন। স্পৰ্দ্ধাবান ব্যক্তিরা মানবগণের দোষ দর্শন করিবামাত্র উহা কীৰ্ত্তন করিবার নিমিত্ত যেমন ব্যগ্র হয়, গুণ দর্শন করিলে তাহা কীৰ্ত্তন করিতে, সেরূপ ব্যগ্র হয় না। যিনি বাক্য ও মনকে সংযত করিয়া সৰ্ব্বদা ঈশ্বরে অর্পণ করেন, তিনি অনায়াসে বেদ, তপস্যা ও দানজনিত ফললাভে সমর্থ হয়েন। মূঢ়ব্যক্তিরা আক্রোশ বা অপমানসূচক বাক্য প্রয়োগ করিলে, তাহার অনুরূপ বাক্যদ্বারা তাহাদিগকে নিন্দা করা পণ্ডিত ব্যক্তির কর্ত্তব্য নহে। আত্মার ও অন্য ব্যক্তির হিংসা করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। পণ্ডিতেরা অপমানকে অমৃতের ন্যায় জ্ঞান করিয়া পরমসুখে নিদ্রাগত হইতে পারেন; কিন্তু অবমন্তাকে [অপমানকারীকে] অবমাননাবিন্ধন অবশ্যই অনুতাপ করিতে হয়।
‘ক্রুদ্ধ হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান, দান, তপস্যা ও হোম করিলে মৃত্যু ঐ সমুদয় কৰ্ম্মের ফল হরণ করিয়া থাকেন; সুতরাং ক্রুদ্ধ ব্যক্তির সমুদয় পরিশ্রমই নিষ্ফল হয়, সন্দেহ নাই। যাঁহার উপস্থ, উদর, হস্ত ও বাক্য এই চারিটি সুরক্ষিত থাকে, তাঁহাকে ধাৰ্মিক বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যে ব্যক্তি স্বাধ্যায়নিরত, পরধনে নিস্পৃহ ও সস্বভাবসম্পন্ন হইয়া সত্য, দম, সরলতা, অনৃশংসতা, ধৈৰ্য্য ও তিতিক্ষা আশ্রয় করিতে পারেন, তিনিই পরলোকে স্বর্গলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। বৎস যেমন গাভীর চারি স্তন হইতে দুগ্ধ পান করে, তদ্রূপ সত্য, দম, ক্ষমা ও প্রজ্ঞা এই চারি গুণেই অনুরক্ত হওয়া মনুষ্যের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম।
‘সত্যের তুল্য পবিত্র আর কিছুই নাই। আমি দেবলোক ও মনুষ্যলোকে পরিভ্রমণ করিয়া কহিতেছি যে, অর্ণবপোত যেমন সমুদ্রপারের একমাত্র উপায়, তদ্রূপ সত্যই স্বর্গগমনের একমাত্র সোপানস্বরূপ, সন্দেহ নাই। যে ব্যক্তি যেরূপ লোকের সহবাস, যেরূপ লোকের উপাসনা ও যেরূপ হইবার বাসনা করে, সে নিশ্চয়ই তদনুরূপ প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। দেবগণ সৰ্ব্বদাই সাধুদিগের সহিত সম্ভাষণ করিয়া থাকেন, এই নিমিত্ত সাধুগণ লৌকিক বিষয় দর্শন করিতে ইচ্ছা করেন না। যে ব্যক্তি সমুদয় বিষয়ের তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনিই যথার্থ সাধু; বায়ু বা চন্দ্র কখনই তাহার তুল্য বলিয়া পরিগণিত হয় না। যে ব্যক্তির হৃদয়স্থ জীব রাগদ্বেষশূন্য হয়, দেবগণ তাঁহার প্রতি সতত প্রসন্ন থাকেন। আর যে ব্যক্তি শিশ্নোদরপরায়ণ, তস্কর ও অপ্রিয়বাদী, সে প্রায়শ্চিত্ত করিলেও দেবতারা তাহাকে পরিত্যাগ করেন। নীচবুদ্ধি, সর্ব্বভোজী, দুষ্কৰ্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিরা কখনই দেবগণকে পরিতুষ্ট করিতে সমর্থ হয় না। সত্যব্রতপরায়ণ ধৰ্ম্মনিষ্ঠ কৃতজ্ঞ ব্যক্তিরাই দেবগণের সহিত মিলিত হইয়া শ্ৰেয়োলাভ করিতে পারেন। বাচালের ন্যায় অনর্থক বিবিধ বাক্য প্রয়োগ করা অপেক্ষা মৌনাবলম্বন, মৌনাবলম্বন অপেক্ষা কেবল সত্যবাক্য প্রয়োগ এবং কেবল সত্যবাক্য প্রয়োগ করা অপেক্ষা ধৰ্ম্মসংযুক্ত সত্যবাক্য প্রয়োগ করা শ্রেয়। আবার সেই ধৰ্ম্মসংযুক্ত সত্যবাক্য যদি লোকের প্রিয় হয়, তাহা অপেক্ষা শ্রেয়স্কর আর কিছুই নাই।
“সাধ্যগণ কহিলেন, ‘বিহগরাজ! লোকসমুদয় কোন্ পদার্থে সমাবৃত ও কি কারণে অপ্রকাশিত থাকে, কি নিমিত্ত মিত্ৰগণকে পরিত্যাগ করে আর কি নিমিত্তই বা স্বর্গে গমন করিতে সমর্থ হয় না, তাহা আমাদের নিকট কীৰ্ত্তন কর।’
“হংস কহিলেন, ‘সাধ্যগণ! মনুষ্যেরা অজ্ঞানদ্বারা সমাচ্ছন্ন, মাৎসর্য্যনিবন্ধন অপ্রকাশিত, লোভবশতঃ মিত্ৰত্যাগে প্রবৃত্ত ও সংসৰ্গদোষেই স্বর্গগমনে অসমর্থ হইয়া থাকে।’
“সাধ্যগণ কহিলেন, ‘হে হংস! ব্রাহ্মণের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্ব্বদা পরিতৃপ্ত থাকেন, কোন্ ব্যক্তি মৌনাবলম্বী হইয়া বহুলোকের সহিত বাস করিতে পারেন, কোন্ ব্যক্তি দুৰ্ব্বল হইয়াও বলবান্ বলিয়া পরিগণিত হয়েন এবং কোন্ ব্যক্তি, কাহারও সহিত কলহ করেন না, তাহা আমাদের নিকট কীৰ্ত্তন কর।’
“হংস কহিলেন, ‘সাধ্যগণ! ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই সতত পরিতৃপ্ত থাকেন, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক বহুলোকের সহিত বাস করিতে পারে, এ ব্যক্তিই দুর্ব্বল হইয়াও বলবান বলিয়া পরিগণিত হয়, এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই কদাপি কাহারও সহিত বিরোধ করেন না।’
‘সাধ্যগণ কহিলেন, “বিহগরাজ! ব্রাহ্মগণের দেবত্বসাধক কি, সাধুত্বসাধক কি, অসাধুত্বসাধক কি এবং মনুষ্যত্বসাধকই বা কি, তাহা আমাদের নিকট কীৰ্ত্তন কর।
“তখন হংসরূপী ব্রহ্মা কহিলেন, ‘হে সাধ্যগণ! বেদপাঠ ব্রাহ্মণগণের দেবত্ব, ব্রত উহাদের সাধুত্ব, অপবাদ উহাদের অসাধুত্ব এবং মৃত্যু উহাদের মনুষ্যত্ব সম্পাদন করিয়া থাকে।”
“হে ধৰ্ম্মরাজ। আমি তোমার নিকট হংস ও সাধ্যগণের এই উৎকৃষ্ট কথোপকথন কীৰ্ত্তন করিলাম। বস্তুতঃ দেহই কর্ম্মের উৎপত্তিস্থান এবং জীবই সত্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে।”