দ্রৌপদী প্রভৃতির পতন—প্রত্যেকতঃ হেতুনির্দ্দেশ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, এইরূপে মহাত্মা পাণ্ডবগণ পত্নীর সহিত উপবাসনিরত ও যোগপরায়ণ হইয়া ক্রমাগত উত্তরদিকে গমন করিতে করিতে হিমালয়গিরি দেখিতে পাইলেন। ঐ পৰ্ব্বতে আরোহণপূর্ব্বক গমন করিতে করিতে বালুকাময় সমুদ্র ও সুমেরুপর্ব্বত তাঁহাদিগের নেত্রপথে নিপতিত হইল। তখন তাঁহারা হিমালয় অতিক্রম করিবার মানসে দ্রুতবেগে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় পাণ্ডবমহিষী দ্রৌপদী নিতান্ত পরিশ্রমনিবন্ধন যোগভ্রষ্ট হইয়া তাঁহাদিগের সম্মুখেই ধরাতলে নিপতিত হইলেন। মহাবীর ভীমসেন তদ্দর্শনে ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! রাজপুত্রী দ্রৌপদী ত’ কখন কোন অধর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন নাই; তবে কি নিমিত্ত ভূতলে নিপতিত হইলেন?”
তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! দ্রৌপদী আমাদের সকলের অপেক্ষা অর্জ্জুনের প্রতি সমধিক পক্ষপাত করিতেন, এই নিমিত্ত আজ উঁহাকে তাহার ফলভোগ করিতে হইল।” এই বলিয়া ধৰ্ম্মরাজ দ্রৌপদীর প্রতি নেত্রপাত না করিয়া সমাহিতচিত্তে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাত্মা সহদেব সেই স্থানে ধরাতলে পতিত হইল। মহাবীর ভীমসেন সহদেবকে নিপতিত দেখিয়া ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমাদিগের কনিষ্ঠভ্রাতা সহদেব অহঙ্কারবিহীন এবং আমাদিগের শুশ্রূষায় একান্ত অনুরক্ত ছিল; তবে কি নিমিত্ত উঁহাকে ধরাতলে নিপতিত হইতে হইল?”
তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভ্রাতঃ! সহদেব আপনাকে সর্ব্বাপেক্ষা বিজ্ঞ বলিয়া জ্ঞান করিত। সেই পাপে আজ উঁহাকে ভূমিতলে নিপতিত হইতে হইল।” এই বলিয়া ধৰ্ম্মরাজ সহদেবকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অনন্যমনে অন্যান্য ভ্রাতৃগণ এবং কুক্কুরের সহিত গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাত্মা নকুল দ্রৌপদী ও কনিষ্ঠ সহোদর সহদেবের পতননিবন্ধন নিতান্ত দুঃখিত ও যোগভ্রষ্ট হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! নকুল, পরমধাৰ্ম্মিক, অলৌকিক রূপসম্পন্ন ও আমাদের আজ্ঞাবহ হইয়াও আজ কি পাপে ভূতলে নিপতিত হইল?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভ্রাতঃ! ধর্ম্মপরায়ণ নকুল ইহলোকে ‘আমার তুল্য রূপবান আর কেহই নাই এবং আমিই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে মনে অহঙ্কার করিত, এই নিমিত্ত আজ উঁহাকে ধরাতলে নিপতিত হহতে হইল। তুমি আর উঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া আমার সহিত আগমন কর। যে যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে অবশ্যই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। এই বলিয়া ধৰ্ম্মরাজ নকুলকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সমাহিতচিত্তে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ইন্দ্রতুল্য পরাক্রান্ত মহাবীর অর্জ্জুন দ্রৌপদী, সহদেব ও নকুলের পতননিবন্ধন নিতান্ত শোকসন্তপ্ত ও বিমনায়মান হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন মহাত্মা ভীমসেন পুনরায় ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! মহাত্মা অৰ্জ্জুন পরিহাসচ্ছলেও কখনও মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করে নাই, তবে এক্ষণে কি পাপে উঁহাকে ধরাতলে নিপতিত হইতে হইল?”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভ্রাতঃ! অর্জ্জুন শৌৰ্য্যাভিমানী হইয়া ‘আমি একদিনেই সমুদয় শত্ৰু সংহার করিব’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কিন্তু উহা প্রতিপালন করিতে পারে নাই। বিশেষতঃ ঐ মহাবীর বলদর্পনিবন্ধন সমুদয় ধনুর্দ্ধরকে অবজ্ঞা করিত। এই নিমিত্ত উঁহাকে আজ ভূমিতলে নিপতিত হইতে হইল।”
ধর্ম্মপরায়ণ ধৰ্ম্মরাজ এই বলিয়া সমাহিতচিত্তে ভীম ও সেই কুক্কুরের সহিত গমন করিতে আরম্ভ করিলে মহাবীর বৃকোদর অচিরাৎ ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তিনি ভূতলে পতিত হইয়া উচ্চৈঃস্বয়ে ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার নিতান্ত প্রিয়পাত্র। আজ কোন পাপে আমায় ধরাতলে নিপতিত হইতে হইল?”
তখন ধৰ্ম্মরাজ তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি অন্যকে ভক্ষ্যবস্তু প্রদান না করিয়া স্বয়ং অপরিমিত ভোজন ও আপনাকে অদ্বিতীয় বলশালী বলিয়া অহঙ্কার করিতে; এই নিমিত্ত তোমাকে ভূতলে নিপতিত হইতে হইল।” এই বলিয়া ধর্ম্মরাজ ভীমের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া সমাহিতচিত্তে গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় কেবল সেই কুক্কুর তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।