২৯৯. সংসারের অনাসক্তি মোক্ষের মূল

২৯৯তম অধ্যায়

সংসারের অনাসক্তি মোক্ষের মূল

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! অনন্তর মিথিলাধিপতি জনক পুনরায় সব্বধৰ্ম্মবেত্তা মহাত্মা পরাশরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহর্ষে! ইহলোকে কোন্ পদার্থ শ্রেয়ঃসাধন? সদ্‌গতি কি? কি কার্য্যের বিনাশ নাই ও কোন যানে গমন করিলে আর প্রত্যাগমন করিতে হয় না? তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’

“পরাশর কহিলেন, ‘রাজন্‌! সংসারে লিপ্ত না হওয়াই শ্ৰেয়োলাভের মূল, জ্ঞানই উৎকৃষ্ট গতি, সৎপাত্রে দান ও তপশ্চৰ্য্যার বিনাশ নাই এবং অভয়প্রদানপূর্ব্বক অধৰ্ম্মপাশ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া ধৰ্ম্মের একান্ত আসক্ত হইতে পারিলেই পরমস্থানলাভ হয়; তথা হইতে প্রত্যাগমনের সম্ভাবনা নাই। যে ব্যক্তি সৎপাত্রে সহস্র সহস্র গাভী ও শত শত অশ্ব প্রদান করে, তাহার সমুদয় জীব হইতে অভয়লাভ হইয়া থাকে। বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা প্রভূত বিষয়মধ্যে অবস্থান করিয়াও কদাপি তাহাতে লিপ্ত হয়েন না, কিন্তু অবোধ মূঢ়ব্যক্তিরা অতি অল্পমাত্র বিষয়েই একান্ত আসক্ত হইয়া উঠে। অধৰ্ম্ম পদ্মপত্রস্থ সলিলের ন্যায় কখনই জ্ঞানবান ব্যক্তিকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতে পারে না; কিন্তু উহা কাষ্ঠসংশ্লিষ্ট জতুর [লাক্ষার—দাহ্যপদার্থ] ন্যায় অজ্ঞান ব্যক্তিকে অনায়াসে আশ্রয় করিয়া থাকে। অধৰ্ম্ম কদাপি কৰ্ত্তাকে পরিত্যাগ করে না, যথাকালে অবশ্যই তাঁহাকে সেই অধৰ্ম্মজন্য ফলভোগ করিতে হয়; কিন্তু আত্মদর্শী সাধুদিগের কখনই কর্ম্মজন্য ফলভোগ হইবার সম্ভাবনা নাই। যে ব্যক্তি প্রমাদবশতঃ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কৰ্ম্মেন্দ্রিয়সমুদয়ের গতি অবগত হইতে অসমর্থ এবং সুখের সময় নিতান্ত হৃষ্ট ও দুঃখের সময় একান্ত কাতর হয়, তাহার নিশ্চয়ই ঘোরতর ভয় উপস্থিত হইয়া থাকে। যাঁহারা বীতরাগ ও জিতক্রোধ হয়েন, বিষয়মধ্যে অবস্থান করিলেও তাঁহাদিগকে পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। নদীমধ্যে সেতু নিবদ্ধ হইলে যেমন ঐ সেতু ভগ্ন না হইয়া স্রোতের বৃদ্ধি সম্পাদন করে, তদ্রূপ লোক বিষয়ে আসক্ত না হইয়া বেদানুশাসনে নিবদ্ধ হইলে তাহাকে কখনই অবসন্ন হইতে হয় না, প্রত্যুত তপস্যার বৃদ্ধিই হইয়া থাকে। সূৰ্য্যকান্তমণি যেমন সূর্য্যের তেজ আকর্ষণ করে, তদ্রূপ চিত্তের একাগ্রতা যোগ আকর্ষণ করিয়া থাকে। যেমন তিলমধ্যে বারংবার সুগন্ধি পুষ্প নিক্ষেপ করিলে ক্রমশঃ সুগন্ধের আতিশয্য হয়, তদ্রূপ বিশুদ্ধচিত্ত মনুষ্যদিগের বারংবার সাধুসংসর্গনিবন্ধন ক্রমশঃ সত্ত্বগুণের আধিক্য হইয়া থাকে। যাঁহারা সম্পত্তি, পদ, যান, স্ত্রী ও বিবিধ সৎক্রিয়া পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণ অবলম্বন করেন, তাঁহাদিগের বিষয়বাসনা লেশমাত্র থাকে না। আর যাহারা বিবিধ বিষয়ে একান্ত আসক্ত হইয়া আপনাদিগের হিতচিন্তায় নিতান্ত অসমর্থ হয়, তাহারা আমিষলোলুপ মৎস্যের ন্যায় বিষয়ে একান্ত সমাকৃষ্ট হইয়া থাকে।

‘পরস্পরের উপকারতৎপর হস্তপদাদিযুক্ত মনুষ্যসমুদয় কদলীবৃক্ষের ন্যায় নিতান্ত অসার। ইহারা নৌকার ন্যায় সংসারসাগরে নিমগ্ন হইয়া যায়। ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের কালনিশ্চয় নাই। মৃত্যু কালপ্রতীক্ষা করে না; সকলকেই কালগ্রাসে নিপতিত হইতে হইবে; অতএব সৰ্ব্বদাই ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। অন্ধ ব্যক্তি যেমন অভ্যাসবশতঃ অলক্ষিত পথে গমন করে, তদ্রূপ জ্ঞানবান্ ব্যক্তি যোগযুক্তচিত্তে অনায়াসে অগোচর জ্ঞানপথে গমন করিতে পারেন। জন্মগ্রহণ করিলে জীবকে মৃত্যুর হস্তে নিপতিত হইতে হয়। জন্মমৃত্যুর অধিকৃত যাহারা মোক্ষধৰ্ম্মে একান্ত অনভিজ্ঞ, তাহাদিগকেই জন্মমৃত্যুর বশীভূত হইয়া চক্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতে হয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কি ইহলোক, কি পরলোক, সৰ্ব্বত্রই সুখলাভ করেন। যাহারা অগ্নিহোত্রাদি বিবিধ যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগকে ক্লেশ ভোগ করিতে হয়; আর যাঁহারা একেবারে সৰ্ব্বত্যাগী হয়েন, তাঁহাদিগের সুখের পরিসীমা থাকে না। অগ্নিহোত্রাদির অনুষ্ঠানদ্বারা অন্যের হিতানুষ্ঠান করা যায়; কিন্তু সৰ্ব্বত্যাগী হইতে পারিলে আপনারই মঙ্গললাভ হইয়া থাকে। মৃণাল যেমন উৎপাটিত হইলে কর্দ্দমের সহিত তাহার সংস্রব থাকে না, তদ্রূপ তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে লিঙ্গশরীরের সহিত আত্মার সম্পর্ক এককালে রহিত হইয়া যায়। মন আত্মাকে যোগোন্মুখ করে। আত্মা যোগোন্মুখ হইলেই যোগী মনকে আত্মায় লীন করেন। এইরূপে যোগে প্রবৃত্ত হইয়া সিদ্ধ হইতে পারিলেই উপাধিবিহীন আত্মার সহিত সাক্ষাৎকারলাভ হয়। যাহারা যোগে অভিনিবিষ্ট হইয়া ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন ও দেহপোষণ স্বকাৰ্য্য বলিয়া বিবেচনা করে, তাহারা নিশ্চয়ই যোগভ্রষ্ট হয়। যোগভ্রষ্ট ব্যক্তিরা স্ব স্ব কৰ্ম্মফলে অধোগতি, তির্য্যগযোনি ও স্বর্গ লাভ করিয়া থাকে। জীবাত্মা তপস্যাদ্বারা পরিপক্বদেহে অবস্থিত হইলে অনায়াসে পক্ক মৃন্ময়পাত্রস্থ দ্রবদ্রব্যের ন্যায় বহুকালস্থায়ী অদৃষ্টদ্বারা ব্রহ্মলোক পৰ্য্যন্ত ভোগ করিতে পারে।

ত্যাগধর্ম্ম বাসনাত্যাগে সংসারনিবৃত্তি

“যে ব্যক্তি ইহলোকে বিষয়ে আসক্ত হয়, তাহাকে নিশ্চয়ই পরলোকে ভোগসুখে বঞ্চিত হইতে হয়, আর যে মহাত্মা ইহলোকে বিষয়সুখে অভিভূত না হয়েন, তিনিই পরলোকে পরম সুখ অনুভব করিতে পারেন। জন্মান্ধ যেমন পথদর্শনে অক্ষম, তদ্রূপ শিশ্নোদরপরায়ণ মূঢ়ব্যক্তিরা অজ্ঞাননীহারে সমাচ্ছন্ন হইয়া পরমার্থদর্শনে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া থাকে। বণিকেরা যেমন সমুদ্রে ভ্রমণ করিয়া আপনাদিগের মূলধনানুরূপ অর্থলাভ করিয়া থাকে, তদ্রূপ প্রাণীগণ এই সংসারমধ্যে স্ব স্ব কৰ্ম্মের সেইরূপ গতিলাভ করিয়া থাকে। সর্প যেমন বায়ু ভক্ষণ করে, তদ্রূপ মৃত্যু এই অহোরাত্রপরিব্যাপ্ত লোকে জরারূপে পরিভ্রমণপূর্ব্বক প্রাণীগণকে গ্রাস করিতেছে। মানবগণ ইহলোকে জন্মগ্রহণ করিয়া পূৰ্ব্বজন্মর্জ্জিত কাৰ্য্যেরই ফলভোগ করিয়া থাকে, ইহলোকে কোন ব্যক্তিই কৰ্ম্ম ব্যতীত অণুমাত্র প্রিয় বা অপ্রিয় বিষয় লাভ করিতে সমর্থ হয় না। মনুষ্য কি শয়ান, কি গমনে প্রবৃত্ত, কি উপবিষ্ট, কি বিষয়াসক্ত যে-কোন অবস্থায় অবস্থিত হউক না কেন, তাহার অনুষ্ঠিত শুভ ও অশুভ কৰ্ম্মসমুদয় সততই তাহাকে ফল প্রদান করিতেছে। যে ব্যক্তি সমুদ্রের পরপারে উত্তীর্ণ হইয়া পুনৰ্ব্বার পার হইতে ইচ্ছা না করে, তাহাকে যেমন মহার্ণবে নিপতিত হইতে হয় না, তদ্রূপ যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানবলে এই সংসার হইতে বিমুক্ত হইয়া পুনর্জ্জন্ম বাসনা না করেন, তাঁহাকে আর ইহলোকে প্রত্যাগমন করিতে হয় না। ধীবন যেমন স্বীয় 
অভিপ্রায়ানুসারে রজ্জুদ্বারা জলে অবসন্ন অর্ণবপোত [নৌকা, জাহাজ প্রভৃতি সমুদ্রযান] উদ্ধার করে, তদ্রূপ মন সত্ত্বগুণে অভিনেবেশদ্বারা সংসারে নিমগ্ন দেহাভিমানী জীবকে উদ্ধৃত করিয়া থাকে। যেমন নদীসমুদয় সাগরে মিলিত হয়, তদ্রপ যোগসময়ে মন মূল প্রকৃতিতে সংলগ্ন হইয়া থাকে। মানবগণ অজ্ঞান সমাচ্ছন্ন ও বিবিধ স্নেহপাশে বদ্ধ হইয়াই সলিলস্থিত বালুকাময় গৃহের ন্যায় বিনষ্ট হইতেছে। যে ব্যক্তি শরীরকে গৃহ ও শৌচকে তীর্থ বিবেচনা করিয়া 
বুদ্ধিমার্গ অবলম্বনপূৰ্ব্বক কালযাপন করেন, সেই ব্যক্তিই উভয়লোকে সুখলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।
 

‘অগ্নিহোত্রাদি বিস্তর কার্য্য ক্লেশকর। ঐ সমস্তদ্বারা কেবল শারীরিক সুখ উৎপন্ন হয়; কিন্তু একমাত্র সর্ব্বত্যাগই আত্মার সুখলাভের কারণ, সন্দেহ নাই। মনুষ্য যত দিন পোষ্যবর্গের প্রতিপালন করিতে পারে, ততদিন মিত্রবর্গ, জ্ঞাতি, পুত্র, কলত্র ও ভৃত্য প্রভৃতি পরিজনগণ তাহার অনুগত থাকে; অতএব যোগমার্গ পরিত্যাগপূর্ব্বক পরিবারপালনের চিন্তা করা কখনই কর্ত্তব্য নহে।

‘পিতামাতা হইতে পরলোকের কোন কার্য্যই সম্পাদিত হয় না। প্রাণীগণ স্বীয় কার্য্যের অনুরূপ ফল ভোগ করিয়া থাকে। কেবল দানই মনুষ্যের স্বর্গপ্রাপ্তির পাথেয় সন্দেহ নাই। পিতা, মাতা, পুত্র, ভ্রাতা, ভার্য্যা ও মিত্র প্রভৃতি পরিজনগণ সুবর্ণরেখার ন্যায় দেখিতে সুন্দর; কিন্তু তাঁহাদিগের দ্বারা পারত্রিক সুখলাভের কোন সম্ভাবনা নাই। জন্মান্তরীণ শুভাশুভ কার্য্যসমুদয় আত্মাকে আশ্রয় করিয়া থাকে। অন্তরাত্মা উপস্থিত কর্ম্মফল পরিজ্ঞাত হইয়া উহার অনুরূপ ফলভোগের নিমিত্ত বুদ্ধিকে বিবিধ কার্য্যে প্রেরণ করেন। যে ব্যক্তি সহায়বান্‌ ও উদ্‌যোগী হইয়া কার্য্যানুষ্ঠান করে, তাহার কোন কাৰ্য্যই কখন নিষ্ফল হয়না। কিরণজাল যেমন সূৰ্য্য হইতে কদাপি অন্তর্হিত হয়না, তদ্রূপ শ্রী কখনই একাগ্রচিত্ত উদযোগী ধীরচিত্ত পণ্ডিতদিগকে পরিত্যাগ করেন না। আস্তিক্য, উদ্‌যোগ, গৰ্ব্বপরিত্যাগ, উপায় ও বুদ্ধিদ্বারা যে কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হয়, তাহা কখনই বিনষ্ট হয় না। সমুদয় প্রাণীই গর্ভবাসকালে আপনাদিগের পূর্ব্বজন্মর্জ্জিত শুভাশুভ কার্য্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে। বায়ু যেমন কাষ্ঠচূর্ণকে অন্যত্র নীত করে, তদ্রূপ অনিবার্য্য মৃত্যু জীবননাশক কালকে সহায় করিয়া প্রাণীগণকে লোকান্তরে লইয়া যায়। মানবগণের জন্মান্তরীণ শুভাশুভ কার্য্যাদারাই রূপ, ঐশ্বৰ্য্য ও পুত্রপৌত্র প্রভৃতি লাভ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! ধৰ্ম্মবিদ্‌গণের অগ্রগণ্য রাজর্ষি জনক মহাত্মা পরাশরের নিকট এইরূপ যথার্থ ধৰ্ম্মোপদেশ শ্রবণ করিয়া পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন।”