২৯৮. ব্যক্তিভেদে কর্ত্তব্যের বিভিন্নতা

২৯৮তম অধ্যায়

ব্যক্তিভেদে কর্ত্তব্যের বিভিন্নতা

“পরাশর কহিলেন, “হে মহারাজ। ইহলোকে যাহারা ভক্তিবিহীন, তাহারা কখনই পিতা, মাতা, গুরু, গুরুপত্নী ও সুহৃদগণের সেবাজন্য ফললাভে সমর্থ হয় না, যাহারা তাঁহাদিগের প্রতি একান্ত ভক্তিমান, প্রিয়বাদী এবং তাঁহাদিগের হিতানুষ্ঠান তৎপর ও বশবর্ত্তী হয়, তাহারাই ফললাভে সমর্থ হইয়া থাকে। পিতা পুত্রের পরম দেবতা এবং স্বর্গ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা জ্ঞানকে উৎকৃষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন ও উহা লাভ করিয়া জিতেন্দ্রিয় হইয়া পরমপদ অধিকার করেন।

‘যে নরপতি সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইয়া শরানলে শলভবৃত্তি [পতঙ্গচেষ্টা—ফড়িং যেমন আগুনের মুখে ঝাপাইয়া পড়ে, রাজাও তদ্রূপ যুদ্ধাদি বিপদের মধ্যে অগ্রসর হইবেন] অবলম্বন করেন, তিনি অনায়াসে দেবদুর্ল্লভ লোকে গমন করিয়া স্বর্গসুখসম্ভোগে সমর্থ হয়েন।

‘শ্রান্ত, ভীত, ভ্রষ্টশস্ত্র [অস্ত্রহীন], রোরুদ্যমান [অতিশয় ক্রন্দনপরায়ণ], সমপরাঙ্মুখ, সহায়বিহীন, উদ্যোগশূন্য, রোগী, শরণাপন্ন বালক ও বৃদ্ধকে প্রহার করা কদাপি বিধেয় নহে। সমরস্থলে সহায়সংযুক্ত, যুদ্ধার্থ সমুদ্যত, সমকক্ষ, প্রতিযোগী ক্ষত্রিয়কে আক্রমণ করাই নরপতিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। তুল্য বা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির হস্তে বিনাশই প্রশংসনীয়। ভয়বিহুল নীচব্যক্তির হস্তে প্রাণপরিত্যাগ নিতান্ত নিন্দনীয়। পাপানুষ্ঠাননিরত দুরাত্মাদিগের হস্তে নিহত হইলে নিশ্চয়ই নরকগামী হইতে হয়। কালসমাক্রান্ত ব্যক্তিদিগকে কেহই পরিত্রাণ করিতে সমর্থ হয় না। আর যাহার পরমায়ু থাকে, তাহাকে কেহই বিনষ্ট করিতে পারে না।

‘মাতা প্রভৃতি গুরুজনেরা অন্য ব্যক্তির প্রাণহিংসাদ্বারা অপত্যাদির জীবনরক্ষা করিতে উদ্যত হইলে জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বব তাঁহাদিগকে নিবারণ করা পুত্রাদির অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। মুমূর্ষ গৃহস্থমাত্রেরই তীর্থস্থানে অবস্থানপূৰ্ব্বক মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হওয়া উচিত। আয়ুঃশেষ হইলে কেহ কেহ রোগাক্রান্ত হইয়া পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়, আর কেহ কেহ বা সহসা মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়া থাকে। দেহিগণের মৃত্যু হইলে তাহারা পুনৰ্ব্বার দেহ লাভ করে। যেমন এক গৃহ হইতে অন্য গৃহে গমন করা যায়, তদ্রূপ জীব কৰ্ম্মপথদ্বারা পুনৰ্ব্বার এক দেহ হইতে অন্য দেহ আশ্রয় করিয়া থাকে; কিন্তু জীব যোগযুক্ত হইলে তাহার ক্রমশঃ মুক্তিলাভ হয়।

‘অধ্যাত্মচিন্তাপরায়ণ পণ্ডিতেরা দেহকে শিরা, স্নায়ু ও অস্থিসমূহে পরিপূর্ণ, বিকৃত ও অপবিত্র পদার্থে পরিব্যাপ্ত, পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় ও বিষয়ক অধিষ্ঠিত এবং ত্বকদ্বারা আবৃত বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। যখন জীব দেহকে পরিত্যাগ করে, তখন উহা নিশ্চেষ্ট ও বিচেতন হইয়া ভূমিতে নিপতিত হয় এবং জীব আপনার কর্ম্মানুসারে উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। দেহত্যাগের পর জীবাত্মা কিয়ৎকাল যাতনা-দেহ আশ্রয় করিয়া বিমানচারী মেঘের ন্যায় পরিভ্রমণ করে এবং তৎপরে পুনর্ব্বার অন্য দেহ প্রাপ্ত হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে। শরীরের অন্যান্য অংশ অপেক্ষা ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয় অপেক্ষা মন ও মন অপেক্ষা আত্মা শ্রেষ্ঠ। আত্মা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই। আত্মা সৰ্ব্বশরীরে সমভাবে অবস্থান করিলেও উপাধিভেদে প্রাণীগণের তারতম্য লক্ষিত হইয়া থাকে। স্থাবর ও জঙ্গম এই দ্বিবিধ প্রাণীর মধ্যে জঙ্গম, জঙ্গমমধ্যে মনুষ্য, মনুষ্যমধ্যে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণমধ্যে জ্ঞানবান, জ্ঞানবানদিগের মধ্যে আত্মতত্ত্বজ্ঞ এবং আত্মতত্ত্বজ্ঞগণের মধ্যে মানাপমানে সমজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই শ্রেষ্ঠ।

‘যাহারা ইহলোকে স্ব স্ব গুণানুসারে নশ্বর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া দেহান্তের পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করে, তাহাদিগকে অবশ্যই কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। যে মহাত্মা কাহাকেও ক্লেশ প্রদান না করিয়া সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া উত্তরায়ণে পবিত্র নক্ষত্রে ও পবিত্ৰমুহূর্তে প্রাণত্যাগ করেন, তাঁহাকেই পুণ্যবান্ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। বিষভোজন, উদ্বন্ধন বা অগ্নিপ্রবেশদ্বারা যাহাদিগের মৃত্যু হয় এবং যাহারা দস্যু-হস্তে নিপতিত বা হিংস্ৰজন্তুকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত হইয়া প্রাণপরিত্যাগ করে, তাহাদিগের মৃত্যুকে অপমৃত্যু বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ঐরূপ মৃত্যু নিতান্ত অপকৃষ্ট। পুণ্যবান্ ব্যক্তিরা অতি উৎকৃষ্ট পীড়াদিদ্বারা সমাক্রান্ত হইলেও কদাপি ঐ সমস্ত কাৰ্য্যদ্বারা প্রাণত্যাগ করিতে ইচ্ছা করেন না। যাঁহারা কেবল পুণ্যকর্ম্মে নিরত থাকেন, তাঁহাদিগের প্রাণ ঊর্ধ্বদেশ, যাঁহারা পাপ ও পুণ্য উভয়বিধ কাৰ্য্যেই নিরত থাকেন, তাঁহাদিগের প্রাণ মধ্যদেশ এবং যাহারা কেবল পাপকর্ম্মে নিরত থাকে, তাহাদিগের প্রাণ অধোদেশ, ভেদপূর্ব্বক বহির্গত হইয়া থাকে।

‘মনুষ্য অজ্ঞানকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াই ঘোরতর নিষ্ঠুর কার্য্যের অনুষ্ঠান করে; অতএব অজ্ঞানের তুল্য শত্রু আর কেহই নাই। যে ব্যক্তি ঐ শত্রুকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত বেদধৰ্ম্মানুসারে বৃদ্ধদিগের উপাসনা করেন, তিনিই প্রজ্ঞা-শরদ্বারা উহাকে উচ্ছিন্ন করিয়া মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। জ্ঞানবান ব্যক্তি প্রথমে ব্রহ্মচারী হইয়া কেবল বেদাধ্যয়ন, তৎপরে গৃহস্থাশ্রম গ্রহণ করিয়া বেদাধ্যয়নাদি পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং পরিশেষে পুত্রাদির প্রতি গার্হস্থ্য ধর্ম্মের ভারার্পণপূৰ্ব্বক মোক্ষলাভের নিমিত্ত অরণ্য আশ্রয় করিবেন। আত্মাকে এককালে উপভোগবিহীন করিয়া অবসন্ন করা, মনুষ্যের কর্ত্তব্য নহে।

মানুষজন্মের প্রশংসা

‘অন্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করা অপেক্ষা মনুয্যযোনিতে জন্মগ্রহণপূর্ব্বক চণ্ডালত্বলাভ করাও শ্রেয়ঃ । আত্মা যে যোনি প্রাপ্ত হইয়া পুণ্যকর্ম্মদ্বারা ইহলোক হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে, সেই যোনিই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সন্দেহ নাই। ধর্ম্মপরায়ণ মানবগণ যাহাতে কোনক্রমেই মনুষ্যযোনি হইতে পরিভ্রষ্ট না হয়েন, তদ্বিষয়ে সতত যত্নবান হইয়া বেদপ্রমাণানুসারে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি দুর্লভতর মনুষ্যদেহ লাভ করিয়া, কামপরায়ণ হইয়া মনুষ্যের দ্বেষ ও ধর্ম্মের অবমাননা করে, তাহাকে নিশ্চয়ই সমুদয় কামনা হইতে বঞ্চিত হইতে হয়। যে মহাত্মারা বৈরাগ্য অবলম্বনপূর্ব্বক বিষয়দর্শনে বিমুখ ও শান্তস্বভাব হইয়া প্রীতিপ্রফুল্লনয়নে প্রাণীগণকে দর্শন, অন্নদান, তাহাদিগের প্রতি প্রিয়বাক্যপ্রয়োগ এবং তাহাদের দুঃখে দুঃখ ও সুখে সুখ অনুভব করেন, তাঁহাদিগকে পরলোকে ক্লেশ ভোগ করিতে হয় না। সরস্বতী, নৈমিষ ও পুষ্কর প্রভৃতি পৃথিবীস্থ পুণ্যতীর্থসমুদয়ে গমনপূর্ব্বক শান্তমূৰ্ত্তি হইয়া বৈরাগ্য অবলম্বন ও তপস্যাদ্বারা দেহের পবিত্রতা সম্পাদন করিয়া ধনদান করা মনুষ্যগণের নিতান্ত আবশ্যক। যাহারা স্বীয় গৃহে প্রাণপরিত্যাগ করে, তাহাদিগকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত ও যানদ্বারা শ্মশানে নীত করিয়া বেদোক্ত বিধি অনুসারে দাহ করা আত্মীয়গণের অবশ্য কর্ত্তব্য। মানবগণ আপনাদিগের হিতসাধনার্থই যজ্ঞ, পুষ্টিজনক ক্রিয়া, যজন, দান ও পিতৃলোকের শ্রাদ্ধ প্রভৃতি সৎকাৰ্য্য সমুদয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। পুণ্যবানদিগের মঙ্গলের নিমিত্তই ধর্ম্মশাস্ত্র, বেদ ও শিক্ষাকল্পাদি ষড়ঙ্গের সৃষ্টি হইয়াছে।’

“হে যুধিষ্ঠির। পূৰ্ব্বকালে মহাত্মা পরাশর বিদেহরাজের হিতাকাঙ্ক্ষী হইয়া তাঁহাকে এইরূপ উপদেশপ্রদান করিয়াছিলেন।”