২৯৭তম অধ্যায়
পুত্র-পুত্রবধূর অদর্শনে দ্যুমৎসেনের দুঃখ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “এদিকে মহাবল দ্যুমৎসেন সাবিত্ৰীগৃহীত বরপ্রভাবে পুনরায় চক্ষুষ্মান হইয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন তিনি পুত্রের নিমিত্ত নিতান্ত কাতর হইয়া তাঁহার অন্বেষণার্থ সেই রাত্রিকালে স্বীয় পত্নী শৈব্যা-সমভিব্যাহারে সমস্ত আশ্রম, দুৰ্গম কানন, নদী ও সরোবর প্রভৃতি নানা স্থান পৰ্যটন করিতে লাগিলেন। কোন প্রকার শব্দ শ্রবণ করিবামাত্র উন্মুখ হইয়া ‘ঐ সাবিত্রী ও সত্যবান আসিতেছেন’ ভাবিয়া উচ্চৈঃস্বরে আহ্বান করিতে থাকেন। এইরূপে সেই নৃপদম্পতি পুত্ৰশোকে উন্মত্তের ন্যায় ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের চরণতল বিদীর্ণ এবং কুশ ও কণ্টকে সর্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হওয়াতে গাত্ৰ হইতে অনবরত শোণিতধারা নিৰ্গত হইতে লাগিল।
“অনন্তর আশ্রমবাসী ব্ৰাহ্মণগণ সমীপে উপস্থিত হইয়া নানাপ্রকার আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে আশ্রমে লইয়া গেলেন। বৃদ্ধতম তপোধনেরা চতুর্দ্দিকে সমাসীন হইয়া পূর্ব্বরাজগণের কথাপ্রসঙ্গে বহুবিধ আশ্বাসবাক্যে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। রাজা দুমৎসেন ও তাঁহার ভাৰ্য্যা ঋষিগণের প্ৰবোধবাক্যে তৎকালে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে পুত্রমুখনিরীক্ষণবাসনা পুনরায় তাঁহোদের হৃদয়ে বলবতী হইয়া উঠল। পুত্রের বাল্যবৃত্তান্ত স্মৃতিপথে আবির্ভূত হওয়াতে তাঁহাদের দুঃখার্ণব পুনরায় উচ্ছলিত হইল। তখন তাঁহারা নিতান্ত কাতর হইয়া ‘হা পুত্ৰ সত্যবান! হা বৎসে পতিব্ৰতে সাবিত্ৰে! কোথায় রহিলে!’ এই বলিয়া মুক্তকণ্ঠে নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিলেন।
দ্যুমৎসেন-দম্পতির প্রতি ঋষিগণের সান্ত্বনা
“অনন্তর সুবর্চানামে ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, “আপনারা ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন, ধর্ম্মপরায়ণ সাবিত্রীর তপস্যা, দাম ও সদাচারবলে সত্যবান অবশ্য জীবিত আছেন, সন্দেহ নাই।”
“মহর্ষি গৌতম কহিলেন, “আমি সার্ঙ্গবেদ অধ্যয়ন করিয়াছি, দীর্ঘকাল তপানুষ্ঠান করিয়াছি; কৌমারব্রহ্মচর্য্যে দীক্ষিত হইয়া গুরু ও অগ্নিকে সন্তুষ্ট করিয়াছি এবং সমাহিত হইয়া বায়ুমাত্র ভক্ষণপূর্ব্বক সর্ব্বপ্রকার ব্ৰতানুষ্ঠান, যথাবিধি উপবাসাদি করিয়াছি; এই সমস্ত কাৰ্য্যদ্বারা আমি অন্যের অভিপ্ৰায়ও জানিতে পারি; অতএব নিশ্চয় বলিতেছি, সত্যবান প্রাণত্যাগ করেন নাই।”
“শিষ্য কহিলেন, “আমার উপাধ্যায়ের মুখনিঃসৃত বাক্য কদাচ মিথ্যা হইবার নহে, অতএব সত্যবান যে জীবিত আছেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”
“ঋষিগণ কহিলেন, “সাবিত্রী সমুদয় অবৈধব্যকর সুলক্ষণসম্পন্ন, অতএব তাঁহার স্বামী অবশ্যই জীবিত আছেন।”
“ভরদ্বাজ কহিলেন, “সাবিত্রী যেরূপ তপ, দাম ও সদাচারসম্পন্ন, তাহাতে কদাচি সত্যবানের প্রাণনাশ হইবে না।”
“দালভ্য কহিলেন, “যখন তুমি চক্ষুষ্মান হইয়াছ, যখন সাবিত্রী ব্রতানুষ্ঠান করিয়া অনাহারে স্বামীর সহিত গমন করিয়াছেন, তখন সত্যবান অবশ্যই জীবিত আছেন।”
“আপস্তম্ব কহিলেন, “যখন দিকসকল প্ৰসন্ন রহিয়াছে, মৃগ ও পক্ষিগণ অনুকূল শব্দ করিতেছে, এবং তোমার প্রবৃত্তি রাজধর্ম্মের অনুরূপ হইয়াছে, তখন সত্যবান জীবিত আছেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”
“ধৌম্য কহিলেন, “মহারাজ! তোমার পুত্ৰ সত্যবান অশেষগুণসম্পন্ন, সকলের প্রিয় ও দীর্ঘজীবিলক্ষণসম্পন্ন, অতএব তিনি অবশ্যই জীবিত আছেন।”
“দ্যুমৎসেন সেই সকল সত্যবাদী তপস্বিগণকর্ত্তৃক এইরূপে আশ্বাসিত হইয়া তাঁহাদিগের তপঃপ্রভাব, মহিমা এবং অতীত ও অনাগতকালের অভিজ্ঞতাদি চিন্তা করিয়া সুস্থির হইলেন।
সাবিত্রী-সত্যবানের স্বীয় আশ্রমাগমন
“পরে অনতিবিলম্বে সাবিত্রী ও সত্যবান হষ্টচিত্তে আশ্রমে প্ৰত্যাগমন করিলেন। তখন ব্রাহ্মাণেরা কহিলেন, “মহারাজ! আপনি পুত্রের সহিত পুনৰ্ম্মিলিত ও চক্ষুষ্মান হইলেন দেখিয়া আমরা সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম, এক্ষণে প্রার্থনা করি যে, অচিরাৎ আপনার সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি হউক। আজি আপনার পরমসৌভাগ্য বলিতে হইবে; কারণ, অদ্য আপনি প্রিয়তম নিরুর্দ্দিষ্ট পুত্র ও পুত্রবধূর দর্শন পাইলেন এবং অমূল্যরত্ন চক্ষু পুনরায় লাভ করিলেন। আমরা যাহা যাহা কহিলাম, তৎসমুদয়ই সত্য, তাহাতে কিঞ্চিম্মাত্ৰও সংশয় করিবেন না। অধুনা উত্তরোত্তর আপনার শ্ৰীবৃদ্ধি হইবে।” ব্রাহ্মণগণ এই কথা বলিয়া তথায় অগ্নি প্ৰজ্বালনপূর্ব্বক মহীপতি দ্যুমৎসেনের শরীরগ্নানি নির্য্যাকরণ করিলেন। শৈব্যা সত্যবান ও সাবিত্রীর একপার্শ্বে দণ্ডায়মান ছিলেন, ব্রাহ্মণেরা অনুমতি করিলে তাঁহারা সকলে উপবিষ্ট হইলেন।
“অনন্তর বনবাসী ঋষিগণ রাজার সহিত একত্ৰ উপবেশনপূর্ব্বক একান্ত কৌতুহলোক্রান্ত হইয়া সত্যবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে নৃপানন্দন? তোমরা এতাবৎকাল কি নিমিত্ত আগমন করা নাই, আর কি নিমিত্তই বা রাত্রিশেষে আগমন করিলে, তোমাদের কি ঘটনা হইয়াছিল, আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই; অতএব সবিশেষ সমস্ত বর্ণন কর। অদ্য তোমাদিগের নিমিত্ত এই কাননস্থ সমস্ত লোক, বিশেষতঃ তোমার পিতামাতা যে কিরূপ উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না।”
‘সত্যবান কহিলেন, “অদ্য পিতার আদেশক্রমে কাষ্ঠাহরণ করিবার নিমিত্ত সাবিত্রী-সমভিব্যাহারে বনে গমন করিয়াছিলাম। তথায় কাষ্ঠসঞ্চয় করিতে করিতে অত্যন্ত শিরোবেদনা উপস্থিত হওয়াতে আমি শয়ান ও নিদ্রিত হইলাম। আদ্য দীর্ঘকাল নিদ্রাভিভূত ছিলাম; আমি পূর্ব্বে কখন এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত নিদ্ৰাগত থাকি নাই। এই জন্যই আসিতে এত বিলম্ব হইল। আর আমাদিগকে না দেখিয়া আপনারা নিতান্ত সন্তপ্ত হইবেন, এই ভাবিয়া রজনীশেষে প্রত্যাগমন করিলাম। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন কারণ নাই।
“গৌতম কহিলেন, “হে সত্যবান! তুমি তোমার পিতার অকস্মাৎ চক্ষুঃপ্রাপ্তির কারণ কিছুই জান না, সাবিত্রী ইহার পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত আছেন, অতএব উনি উহা আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করুন, আমরা শুনিতে অত্যন্ত অভিলাষী হইয়াছি। বৎসে সাবিত্রি! তুমি সাবিত্রীসদৃশ তেজস্বিনী, শ্বশুরের চক্ষুঃপ্রাপ্তির কারণ অবশ্যই তোমার বিদিত আছে, যদি রহস্য না হয়, তবে বর্ণন কর।”
ঋষিগণসমীপে সাবিত্রীকর্ত্তৃক বনবৃত্তান্তবর্ণন
“সাবিত্রী কহিলেন, “আপনারা যাহা বিবেচনা করিয়াছেন, উহা যথার্থ বটে; ইহাতে কিছুমাত্র রহস্য নাই। আমি যথার্থরূপে সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে দেবর্ষি নারদ কহিয়াছিলেন, এক বৎসর অতীত হইলে আমার স্বামীর মৃত্যু হইবে। অদ্য সেই দিবস উপস্থিত হইয়াছিল বলিয়া উঁহাকে পরিত্যাগ না করিয়া উঁহার সহিত বনে গমন করিয়াছিলাম। তথায় দেখিলাম, সত্যবান নিদ্রায় নিতান্ত অভিভূত হইলে কৃতান্ত কিঙ্কর-সমভিব্যাহারে স্বয়ং তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বন্ধনপূর্ব্বক দক্ষিণদিকে লইয়া চলিলেন। তদর্শনে আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমনপূর্ব্বক সত্যবাক্যদ্বারা সেই দেবের স্তব করিতে লাগিলাম। ভগবান কৃতান্ত প্ৰসন্ন হইয়া আমার শ্বশুরের রাজ্য ও চক্ষুঃপ্রাপ্তি, পিতার একশত পুত্র, আপনার শত পুত্র এবং সত্যবানের চারিশত বৎসর আয়ু এই পাঁচটি বর প্রদান করিলেন। আমি কেবল স্বামীর জীবনের নিমিত্তই ঈদৃশ কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছি। হে মহর্ষিগণ! আমি যে-পরিমাণ দুঃসহ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহা আপনাদের সমীপে সবিস্তর কীর্ত্তন করিলাম।”
“ঋষিগণ কহিলেন, “হে সাধ্বি! তুমি অতি সৎকুলোদ্ভবা; স্বীয় সুশীলতা, ব্রত এবং পুণ্যপুঞ্জদ্বারা দুঃখার্ণবে নিমগ্ন ও বিনাশোন্মুখ রাজকুল পুনরুদ্ধৃত করিলে।”
‘সমাগত মহর্ষিগণ এইরূপে বরবর্ণিনী সাবিত্রীর ভূয়সী। প্রশংসা করিয়া রাজা দুমৎসেন ও সত্যবানের নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক আহ্লাদচিত্তে নির্ব্বিয়ে স্ব স্ব আশ্রমে গমন করিলেন।”