২৯৬. তপস্যার প্রবৃত্তিজনক কারণ

২৯৬তম অধ্যায়

তপস্যার প্রবৃত্তিজনক কারণ

“পরাশর কহিলেন, “হে মহারাজ! এই আমি গৃহস্থধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে তপোনিয়ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রায় সকল গৃহস্থেরই রাজসিক গুণপ্রভাবে সাংসর্গিক [সংসর্গজাত] মমতা জন্মিয়া থাকে। মানবগণ স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, গৃহ, গো, ক্ষেত্র ও ধনসম্পন্ন হইলে তাহাদিগের আর কিছুই অনিত্য বলিয়া বোধ থাকে না। তাহারা সতত ঐ সমুদয় সন্দর্শন করিতে করিতে রাগদ্বেষে একান্ত অভিভূত ও মোহজনিত সম্ভোগবাসনায় একান্ত আক্রান্ত হয়। তখন ভোগপরায়ণ ব্যক্তিকেই কৃতার্থ ও স্ত্রীসম্ভোগই সুখের পরাকাষ্ঠা বলিয়া তাহাদের বিবেচনা হয় এবং তাহারা চিরপরিচিত লোভে একান্ত বিমোহিত হইয়া দাসদাসী প্রভৃতির সংখ্যাবৃদ্ধি ও তাহাদের সন্তোষসাধনার্থ জ্ঞানপূর্ব্বক বিবিধ কুকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াও অর্থোপার্জ্জন করিয়া থাকে। ঐ সমুদয় নির্ব্বোধ ব্যক্তি অপত্যস্নেহে যারপরনাই অভিভূত ও অপত্যবিয়োগে নিতান্ত কাতর হয়। গৃহস্থেরা সমাজমধ্যে সম্মানলাভ করিয়া যে স্ত্রীপুত্রাদিরূপ বিষয়দ্বারা ভোগী হইবে বলিয়া স্থির করে, অচিরাৎ সেই সমুদয় হইতে বিনষ্ট হয়। ঐ সমুদয় গৃহস্থের মধ্যে যেসকল বুদ্ধিমান ব্রহ্মবাদী ব্যক্তি শুভকর্ম্মের কামনা করিয়া নিষিদ্ধ ও কাম্যকর্ম্ম পরিত্যাগ করেন, তাহারা চিরকাল অসীম সুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন। পীড়া এবং স্ত্রী, পুত্র ও ধনাদিনাশনিবন্ধন ঐ সকল মহাত্মার অন্তঃকরণে ঘোরতর নির্ব্বেদ উপস্থিত হয়। ঐ নির্ব্বেদ হইতে আত্মজ্ঞান, আত্মজ্ঞান হইতে শাস্ত্রদর্শন ও শাস্ত্ৰদৰ্শন হইতে তপস্যার প্রবৃত্তি হইয়া থাকে। কিন্তু স্ত্রীপুত্রাদিজনিত সুখ পরিণামে ক্লেশকর বিবেচনা করিয়া তপশ্চরণে প্রবৃত্ত হয়, গৃহস্থদিগের মধ্যে এতাদৃশ লোক নিতান্ত দুর্ল্লভ।

সংযমসাধনে সৰ্ব্ববর্ণের অধিকার

‘তপস্যা [সংযমসাধন] সৰ্ব্বসাধারণের ধর্ম্ম। দয়াদাক্ষিণ্যবিহীন শূদ্রাদি হীনবর্ণের উহাতে অধিকার আছে। তপঃপ্রভাবে দমগুণান্বিত জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির স্বর্গলাভ হইয়া থাকে। ভগবান্ প্রজাপতি বিবিধব্রত অবলম্বনপূর্ব্বক তপানুষ্ঠান করিয়াই প্রজাবর্গের সৃষ্টি করিয়াছেন। আদিত্য, বসু, রুদ্র, অগ্নি, বিশ্বদেব, সাধ্য, পিতৃলোক, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধৰ্ব্ব, সিদ্ধ ও অশ্বিনীকুমার প্রভৃতি স্বর্গবাসী দেবগণ একমাত্র তপঃপ্রভাবেই সিদ্ধিলাভে সমর্থ হইয়াছেন। ভগবান্ ব্রহ্মা পূৰ্ব্বে যেসকল ব্রাহ্মণের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহারা স্ব স্ব তপঃপ্রভাবে পৃথিবী প্রতিপালন করিয়া এক্ষণে স্বর্গলোকে বিচরণ করিতেছেন। আর এই মর্ত্ত্যভূমিতে যেসমুদয় নরপতি ও মহাবংশসম্ভূত ধনাঢ্য গৃহস্থকে পট্টবস্ত্র উৎকৃষ্ট আভরণ, বাহন, আসন, যান, পরমরূপবতী অসংখ্য কামিনী, অট্টালিকা, উৎকৃষ্ট শয্যা, উত্তমোত্তম বিবিধ ভোজ্যবস্তু এবং অন্যান্য অভিলষিত সামগ্রী সম্ভোগ করিতে দেখা যায়, তৎসমুদয় তাঁহাদের পূর্ব্বকৃত তপস্যার ফল। ত্রিলোকমধ্যে তপস্যার অসাধ্য কিছুই নাই। তপোবলে তত্ত্বজ্ঞানবিহীন মূঢ়ব্যক্তিদিগেরও বৈরাগ্যোদয় হয়। মনুষ্য সুখীই হউক বা দুঃখীই হউক, স্বীয় বুদ্ধিমত্তাপ্রভাবে শাস্ত্র সন্দর্শন করিয়া লোভ পরিত্যাগ করা তাহার অবশ্য কর্ত্তব্য। লোভ সকল দুঃখের আদিকারণ, লোভ হইতে ইন্দ্রিয়সম্ভ্রম [১] এবং ইন্দ্রিয়সম্ভ্রমনিবন্ধন অভ্যাসবর্জ্জিত বিদ্যার ন্যায় ক্রমশঃ জ্ঞানের হ্রাস হইয়া থাকে। প্রজ্ঞানাশ হইলে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা থাকে না। যাহা হউক, লোকের দুঃখ উপস্থিত হইলে উগ্রতর তপানুষ্ঠান করাই তাহার কর্ত্তব্য। ইহলোকে প্রিয়বস্তুই সুখকর ও অপ্রিয়বস্তুই দুঃখজনক বলিয়া কীৰ্ত্তিত হয়। অতএব তপস্যার ফল সুখ, আর তপস্যা না করিলে অশেষ কেশ উপস্থিত হয়; অতএব তপস্যা করাই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়। নিষ্পাপ তপানুষ্ঠান করিতে পারিলে প্রতিনিয়ত বিবিধ মঙ্গলদর্শন, বিষয়সম্ভোগ ও খ্যাতিলাভ হইয়া থাকে। আর যে ব্যক্তি ফলার্থী হইয়া সৎপথ পরিত্যাগ করে, তাহার সতত 
অপ্রিয়সংঘটন, বিষয়সম্ভোগজনিত বিবিধ ক্লেশ ও অপমান উপস্থিত হয়। তপস্যা ও দান প্রভৃতি বিবিধ ধৰ্ম্মকাৰ্য্যের কৰ্ত্তব্যতা সত্ত্বেও মানবগণ অবিহিত কাৰ্য্যে অনুরক্ত হইয়া বিবিধ পাপানুষ্ঠানপূর্ব্বক নিরয়[নরক]গামী হয়।

‘যে ব্যক্তি কি সুখের সময়, কি দুঃখের সময়, কখনই স্বধর্ম্ম হইতে বিচলিত নহেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানবান্। স্পর্শ, দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ ও আস্বাদজনিত সুখ অতি অল্পক্ষণমাত্র স্থায়ী। ঐ সুখ ক্ষয় হইলেই আবার দুঃখের আবির্ভাব হয়। মোক্ষসুখ চিরস্থায়ী; কিন্তু মূঢ়ব্যক্তিরাই মোক্ষলাভাৰ্থ শমদমাদি গুণ অবলম্বন করে না। ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম কখনই তাঁহাদিগকে পরাভব করিতে সমর্থ হয় না। অনায়াসলভ্য বিষয়সমুদয় উপভোগ ও যত্নপূর্ব্বক স্বধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করা গৃহস্থদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। সৎকুলসদ্ভূত শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন পূজ্য ব্যক্তিরা কখনই তাহার অনুষ্ঠান করতে সমর্থ হন না। যদি কর্ম্মসমুদয় নশ্বর; অতএব আত্মতত্ত্ব নির্ণয় করাই শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। আর যেসকল গৃহস্থ কৰ্ম্মনিরত, স্বধৰ্ম্মানুসারে যজ্ঞীয় দ্রব্য আহরণপূৰ্ব্বক যজ্ঞাদি ধৰ্ম্মানুষ্ঠানবিষয়ে কৃতনিশ্চয় হওয়া তাঁহাদিগের সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। যেমন নদনদী প্রভৃতি জলাশয়সকল সমুদ্রকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে, তদ্রূপ ব্রহ্মচারী প্রভৃতি আশ্রিমিকগণ গৃহস্থদিগকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছেন।”