২৯৫তম অধ্যায়
কাষ্ঠাহরণকারী পতির সহিত সাবিত্রীর নবগমন
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “তৎপরে কালক্রমে যে করাল কাল পতিপ্ৰাণা সাবিত্রীর প্রাণবল্লভের প্রাণ-সংহার করিবে, সেই কাল সমুপস্থিত হইল। সাবিত্রীর হৃদয়ে নারদের বাক্য নিরন্তর জাগরকে ছিল, তিনি উহা শ্রবণাবধি দিন দিন দিন-গণনা করিতেছিলেন, যখন দেখিলেন প্ৰাণেশ্বরের প্রাণপতনের আর চারি-দিন মাত্র অবশিষ্ট আছে, তখন তিনি ত্রিরাত্ৰ-ব্ৰত অবলম্বন করিলেন। তিনি তাদৃশ কঠোর নিয়ম অবলম্বন করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া তাঁহার শ্বশুর রাজা দ্যুমৎসেন সাতিশয় দুঃখিত-চিত্তে উত্থানপূর্ব্বক তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, ‘রাজপুত্রি! তুমি অতি তীব্রতর কর্ম্ম আরম্ভ করিয়াছ, দিনত্রয় উপবাস করিয়া থাকা অতি দুষ্কর।”
“সাবিত্রী কহিলেন, “তাত! পরিতাপ করিবেন না, আমি ব্রতসাধন করিতে সমর্থ হইব। অধ্যবসায়ই ইহার উপায়, আমি অধ্যবসায়সহকারে এই ব্ৰতের অনুষ্ঠান করিয়াছি।” তখন পরমধার্ম্মিক দ্যুমৎসেন মাদৃশ লোকে “ব্রতসংসাধন কর” ব্যতীত কখন “ব্রতভঙ্গ কর” বলিতে সমর্থ হয় না।” এইমাত্ৰ কহিয়া বিরত হইলেন।
“এদিকে সাবিত্রী ক্রমে ক্ৰমে অত্যন্ত কৃশা হইতে লাগিলেন। তিনি যেদিন জানিলেন যে, কল্য প্ৰাণনাথ জন্মের মত পলায়ন করিবেন, সেই রাত্রি তাঁহার অতিকষ্টে অতিবাহিত হইল। প্ৰভাত হইলে, “আজি সেইদিন উপস্থিত হইল”। মনে করিয়া প্ৰদীপ্ত হুতাশনে হোমক্রিয়া সমাধান করিলেন এবং সূর্যদেব চারি’হস্ত মাত্র উখিত হইলেই পূর্ব্বাহ্নিক ক্রিয়াকলাপ সাধন করিয়া বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণগণ এবং শ্বশ্রূ ও শ্বশুরকে যথাক্রমে অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইলেন। তপোবনবাসী তপস্বিগণ ‘তোমার অবৈধব্য হউক’ বলিয়া তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। ধ্যান্যপরায়ণা সাবিত্রী মনে মনে ‘তাই হউক’ বলিয়া তপস্বিগণের আশীৰ্বাদ গ্ৰহণ করিলেন এবং দুঃখিতচিত্তে নারদবাক্য স্মরণ করিয়া সেই কাল ও সেই মুহুর্ত্ত প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
“তাঁহার শ্বশ্রূ ও শ্বশুর তাঁহাকে একান্তে লইয়া প্রীতিপূর্ব্বক কহিলেন, ‘মাতঃ! যে প্রকারে ব্ৰতানুষ্ঠান করিতে হয়, তাহা করিয়াছ, এক্ষণে আহারসময় সমুপস্থিত, অতএব শীঘ্ৰ গিয়া আহার কর।’ সাবিত্রী কহিলেন, “আমি এইরূপ সঙ্কল্প করিয়াছি যে, দিবাকর অস্তগত হইলে ভোজন করিব।”
“সাবিত্রী এইরূপে শ্বশ্রূ ও শ্বশুর সমীপে আপনি সঙ্কল্পের পরিচয় প্রদান করিতেছেন, এমন সময়ে সত্যবান স্কন্ধে পরশু গ্রহণপূর্ব্বক বনে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন। সাবিত্রী স্বামীকে কহিলেন, ‘একাকী গমন করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। আমি অদ্য তোমায় পরিত্যাগ করিতে পারিব না, তোমার সহিত গমন করিব।’
‘সত্যবান কহিলেন, ‘ভাবিনি! তুমি কখন বনে গমন কর নাই, অতএব বনের পথ তোমার নিতান্ত ক্লেশকর হইবে, বিশেষতঃ ব্ৰতোপবাসে ক্ষীণ হইয়াছ, কিরূপে পদব্রজে গমন করিবে?’
“সাবিত্রী কহিলেন, “উপবাসে আমার কিছুমাত্র ক্লেশ বা পরিশ্রম হয় নাই। আমি গমনের নিমিত্ত একান্ত উৎসুক হইয়াছি, আমাকে নিষেধ করিও না।”
“সত্যবান কহিলেন, “যদি গমনের নিমিত্ত নিতান্তই উৎসুক হইয়া থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমার প্রিয়ানুষ্ঠান করিব। কিন্তু তোমাকে আমার পিতামাতার অনুমতি গ্ৰহণ করিতে হইবে; নতুবা আমিই ইহার দোষভাগী হইব।”
“সাবিত্রী সত্যবানের বাক্যানুসারে শ্বশ্রূ ও শ্বশুরকে অভিবাদন করিয়া কহিলেন, ‘আর্য্যপুত্র ফলমাত্র আহার করিয়া অরণ্যানীমধ্যে গমন করিতেছেন, আজি আমি উঁহার বিরহ সহ্য করিতে পারিব না; ইচ্ছা করিয়াছি, উহার সমভিব্যাহারে গমন করিব; আপনারা অনুমতি করুন। উনি মাতা, পিতা ও অগ্নিহোত্রের প্রয়োজনসংসাধনের নিমিত্ত অরণ্যে গমন করিতেছেন; অতএব উহাকে নিবারণ করা উচিত নহে। যদ্যপি ঈদৃশ গুরুতর প্রয়োজন না থাকিত, তবে উহাকে বনগমন করিতে নিষেধ করিলেও হানি হইত না। বিশেষতঃ কিঞ্চিদূন এক বৎসর হইল, আমি আশ্রম হইতে বহির্গত হই নাই; এই জন্য কুসুমিত কানন নিরীক্ষণ করিতে একান্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়াছি।’
“দ্যুমৎসেন কহিলেন, ‘যে অবধি সাবিত্রী আমার পুত্রবধূ হইয়াছেন, তদবধি কখন আমার নিকটে কিঞ্চিম্মাত্রও প্রার্থনা করেন নাই; অতএব অদ্য ইনি স্বাভিলষিত ফললাভ করুন।’ পরে সাবিত্রীকে কহিলেন, ‘বৎসে! পথে সত্যবানের প্রতি অবহিত থাকিবে।’
“যশস্বিনী সাবিত্রী উভয়ের অনুমতি গ্রহণান্তর বর্ত্তৃ-সমভিব্যাহারে রমণীয় কাননে গমন করিলেন। নারদবাক্য-স্মরণে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণপ্ৰায় হইতেছে, তথাপি স্বামীর সহিত অরণ্যাগমনকালে তাঁহার বদন সহাস্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সত্যবান ‘প্রিয়ে! অবলোকন কর’ বলিয়া মধুরবাক্যে সাবিত্রীকে অনুরোধ করিলে তিনি রমণীয় বন, ময়ূর, পুণ্যবহা নদী ও পুষ্পিত পর্ব্বতসকল অবলোকন করিলেন; কিন্তু মুনিবাক্যস্মরণে স্বীয় জীবিতেশ্বরকে গতজীবিতই মনে করিয়া তাঁহার প্রতি বারংবার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণপ্ৰায় হইতে লাগিল। তিনি সেই বিষম সময়ের প্রতীক্ষাপূর্ব্বক ধীরগমনে ভর্ত্তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন।”