২৯৩. দানাদি কর্ম্মর্ব্বারা সিদ্ধিলাভ

২৯৩তম অধ্যায়

দানাদি কর্ম্মর্ব্বারা সিদ্ধিলাভ

“পরাশর কহিলেন, “হে মহারাজ জনক! ইহলোকে কেহ কাহার উপকার বা কেহ কাহাকে কিছুই প্রদান করে না; সকলেই স্ব স্ব উপকারসাধনার্থ কাৰ্য্য করিয়া থাকে। অতএব অন্যের কথা দুরে থাকুক, সহোদর ভ্রাতাও যদি স্নেহপরিশূন্য ও লঘুচেত্তা হয়, তাহা হইলে তাহাকেও পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। সৎপাত্রে ধনদান ও সৎপাত্র হইতে ধনগ্রহণ এই উভয় কাৰ্য্যেই পুণ্যলাভ হইয়া থাকে; কিন্তু ঐ উভয়ের মধ্যে প্রতিগ্ৰহ অপেক্ষা দানের পুণ্য অধিক। যে ধন ন্যায়পথে পরিবর্দ্ধিত হয়, ধর্ম্মানুষ্ঠানের নিমিত্ত যত্নপূর্ব্বক তাহা রক্ষা করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। নৃশংসকাৰ্য্যদ্বারা ধনোপার্জ্জন করা ধর্ম্মার্থী ব্যক্তির কোনক্রমেই কৰ্ত্তব্য নহে। অর্থচিন্তায় অভিভূত না হইয়া আপনার শক্তি অনুসারেই সমুদয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করা উচিত। তৃষ্ণার্ত্ত অতিথিকে শীতলই হউক বা উষ্ণই হউক, সাধ্যানুরূপ সলিল প্রদান করিতে পারিলে অর্থদানের তুল্য ফললাভ হইয়া থাকে। মহাত্মা রন্তিদেব ফল, মূল ও পত্ৰদ্বারা মুনিগণের অর্চ্চনা করিয়াছিলেন বলিয়া ইহলোকে সিদ্ধিলাভ করিয়া গিয়াছেন। নরপতি শৈব্যও ফলমূলদ্বারা পার্ষদগণের সহিত ভগবান্ ভাস্করের সন্তোষসাধন করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়াছেন। মানবগণ জন্মগ্রহণ করিবামাত্র দেবতা, ঋষি, পিতৃগণ, অতিথি ও পুত্ৰাদিপোষ্যগণ এবং স্ব স্ব আত্মার নিকট ঋণী হইয়া থাকে। অতএব মনুষ্যমাত্রেরই যজ্ঞদ্বারা দেবতাদিগের, স্বাধ্যায়দ্বারা, ঋষিদিগের, শ্রাদ্ধদ্বারা পিতৃলোকের, সৎকারদ্বারা অতিথিকুলের, জাতকর্ম্মাদির অনুষ্ঠানদ্বারা পুত্রাদির এবং বেদশাস্ত্র শ্রবণ, যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নভোজন ও সাধ্যানুসারে রক্ষাদ্বারা আত্মার ঋণ পরিশোধ করা অবশ্য কর্ত্তব্য।

‘ধনবিহীন মুনিগণ যত্নপূৰ্ব্বক অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। মহাত্মা ঋচীকতনয় শুনঃশেক বিশ্বামিত্রের পুত্রত্ব লাভপূৰ্ব্বক ঋক্‌বেদগানদ্বারা যজ্ঞভোজী দেবগণকে স্তব করিয়া সিদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। দৈত্যগুরু উশনা দেবী পার্ব্বতী ও দেবাদিদেব মহাদেবের প্রসাদে দেবলোকে কীৰ্ত্তি ও শুক্ৰত্ব লাভ করিয়াছেন। এতদ্ভিন্ন অসিতদেবল, নারদ, পর্ব্বত, কাক্ষীবান, জিতেন্দ্রিয় তাণ্ড্য, বশিষ্ঠ, জমদগ্নি, বিশ্বামিত্র, অত্রি, ভরদ্বাজ, কুণ্ডধার, হরিশ্মশ্রু ও শ্রুতশ্রবা প্রভৃতি মহর্ষিগণ একাগ্রচিত্তে ঋক্‌বেদদ্বারা ভগবান বিষ্ণুর স্তব করিয়া তাঁহার প্রসাদে সিদ্ধিলাভ করিয়া গিয়াছেন। ইহলোকে নিন্দনীয় অনেকানেক ব্যক্তিও একমাত্র বিষ্ণুর স্তবপ্রভাবেই সকলের পূজনীয় হইয়াছে।

‘নিন্দিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া উন্নতিলাভের ইচ্ছা করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। ধর্ম্মপথে অবস্থানপূর্ব্বক যে অর্থ উপার্জ্জন করা যায়, তাহাই যথার্থ অর্থ; অধৰ্ম্মদ্বারা উপার্জ্জিত অর্থে ধিক! ইহলোকে ধর্ম্মই নিত্য পদার্থ; ধনলাভের নিমিত্ত সেই ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা কদাপি বিধেয় নহে। আহিতাগ্নি [আজীবন গৃহে অগ্নিস্থাপনপূৰ্ব্বক হোমাদির অনুষ্ঠানকারী] ব্যক্তিরা পুণ্যবান ব্যক্তিদিগের অগ্রগণ্য। দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আহবনীয় এই তিন অগ্নিতেই বেদসমুদয় প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। যিনি ক্রিয়াবিহীন নহেন, তিনিই যথার্থ সাগ্নিক। ক্রিয়াবিহীন হইয়া অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান করা অপেক্ষা উহা না করাই শ্রেয়। অগ্নি, আত্মা, পিতা, মাতা ও গুরু ইহাদিগকে বিধিপূৰ্ব্বক সেবা করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। যিনি সর্ব্বতোভাবে হিংসা পরিত্যাগ, নিষ্কাম হইয়া ধর্ম্মানুষ্ঠান, অভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জ্ঞানবৃদ্ধদিগের সেবা এবং কামনাপরিশূন্য হইয়া স্নেহসহকারে সকলের প্রতি সমভাবে কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সাধু ব্যক্তিরা তাঁহাকেই সাধু বলিয়া সম্মান করিয়া থাকেন।’ ”