২৯১তম অধ্যায়
শুভলোকগতি—জনক-পরাশরসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আমি যত আপনার অমৃতময় বাক্য শ্রবণ করিতেছি, ততই আমার শ্রবণেচ্ছা পরিবর্দ্ধিত হইতেছে। অতএব এক্ষণে আপনি মানবগণ কিরূপ শুভকার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে উভয় লোকে শ্রেয়োলাভে সমর্থ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পূৰ্ব্বকালে মহাযশস্বী জনক রাজা একদিন মহাত্মা পরাশরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহর্ষে! কি কাৰ্য্যদ্বারা মানবগণের ইহলোক ও পরলোকে মঙ্গললাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
“মহারাজ জনক এই কথা কহিলে সৰ্ব্বধৰ্ম্মবেত্তা মহাতপা পরাশর তাঁহাকে কহিলেন, ‘রাজন্! ধৰ্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা উভয় লোকেই শ্ৰেয়োলাভ করা যায়। পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন, ধৰ্ম্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। ধৰ্ম্মানুষ্ঠানপ্রভাবে মানবগণ স্বর্গলোকে পূজ্য হইয়া থাকে। সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠানই ধৰ্ম্ম। স্ব স্ব ধর্ম্মানুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করা সকলেরই কর্ত্তব্য। ইহলোকে জীবিকানির্ব্বাহাৰ্থ ব্রাহ্মণের প্রতিগ্রহ, ক্ষত্রিয়ের করগ্রহণ, বৈশ্যের কৃষ্যান্নিকাৰ্য্য এবং শূদ্রের ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের সেবা এই চারি প্রকার উপায় বিহিত হইয়াছে। মানবগণ ঐ সমুদয় উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক অবস্থান করিয়া থাকে। উহারা জীবিকানির্ব্বাহাৰ্থ নানাপ্রকার পুণ্য ও পাপজনক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে বলিয়া উহাদের গতি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হয়। তাম্রাদিনিৰ্ম্মিত পাত্র যেমন সুবর্ণ ও রজতরসে অভিষিক্ত হইলে তদ্দ্বারা লিপ্ত হয়, তদ্রূপ মানবগণ পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মানুসারে পূণ্যপাপে লিপ্ত হইয়া থাকে। বীজ ব্যতীত পদার্থের উৎপত্তি ও কর্ম্ম ব্যতীত সুখলাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। মানবগণ দেহাবসানে স্ব স্ব সুকৃতিবলেই সুখলাভ করিয়া থাকে।
‘চার্ব্বাকেরা কহে, অদৃষ্ট বা অদৃষ্টকৰ্ম্ম কিছুই নাই। দেব, গন্ধৰ্ব্ব ও দানবযোনিপ্রাপ্তি স্বভাবতই হইয়া থাকে। ফলপ্রাপ্তির সময় জন্মান্তরীণ কৰ্ম্মকে উহার কারণ বলিয়া জ্ঞান করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত নহে। বেদনির্দ্দিষ্ট বাক্যসমুদয় লোকযাত্রানির্ব্বাহ ও লোকের মনস্তুষ্টির নিমিত্তই কল্পিত হইয়াছে। ঐ সমুদয় জ্ঞানবৃদ্ধদিগের অনুশাসনবাক্য নহে। চার্ব্বাকদিগের এই মত নিতান্ত অবিশুদ্ধ।
‘কায়মনোবাক্যে যে যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে তদনুরূপ ফললাভ করিয়া থাকে। ভোগ ব্যতীত কখনই পুণ্য ও পাপের নাশ হয় না। মানবগণ স্ব স্ব কৰ্ম্মগুণেই কেবল সুখ, কেবল দুঃখ ও সুখদুঃখ মিশ্রিত অবস্থা লাভ করে। সংসারসাগরে নিমগ্ন শক্তিদিগের দুঃখভোগের সময় সুখ আচ্ছন্নভাবে অবস্থান করে; দুঃখের অবসান হইলেই সেই সুখের উদয় হয়। আবার সুখের ক্ষয় হইলেই পুনরায় দুঃখের আবির্ভাব হয়। দম, ক্ষমা, ধৈর্য্য, তেজ, সন্তোষ, সত্যবাদিতা, লজ্জা, অহিংসা, বাসনপরিত্যাগ ও দক্ষতা মনুষ্যগণের সুখের আদিকারণ। মনুষ্যমধ্যে কাহাকেও নিয়ত সুখ বা নিয়ত দুঃখভোগ করিতে হয় না। সতত চিত্ত সংযত করা বিচক্ষণ ব্যক্তির অবশ্য কর্ত্তব্য। একের পুণ্য বা পাপ অন্যকে ভোগ করিতে হয় না। যে যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে তদনুরূপ ফললাভ করিয়া থাকে। যাঁহারা সুখদুঃখ বিলীন করিয়া জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করেন, আর যাঁহারা স্ত্রীপুত্ৰাদির সহিত সঙ্গত হইয়া সংসারমধ্যে অবস্থিত থাকেন, তাঁহাদিগের উভয়েরই পথ পৃথক পৃথক্। অন্যকে যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে দেখিয়া নিন্দা করা যায়, স্বয়ং তাহার অনুষ্ঠান করা কদাপি বিধেয় নহে; করিলে নিশ্চয়ই উপহাসাস্পদ হইতে হয়। ভীরু রাজা, মিথ্যাবাদী সৰ্ব্বভোজী ব্রাহ্মণ, চেষ্টাবিহীন বৈশ্য, অলস শূদ্র, অসচ্চরিত্র বিদ্বান্, অসদ্ব্যবহারযুক্ত কুলীন, ব্যভিচারিণী স্ত্রী, রাগযুক্ত যোগী, মূর্খ বক্তা এবং রাজ্যবিহীন বা প্রজার প্রতি স্নেহশূন্য নরপতি সকলের উপহাস্পদ হইয়া থাকে।’ ”