২৯০. শুক্রের সূরশত্রুতা—রুদ্ৰকবলে প্রবেশ

২৯০তম অধ্যায়

শুক্রের সূরশত্রুতা—রুদ্ৰকবলে প্রবেশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মহামতি শুক্রাচাৰ্য্য কি নিমিত্ত দেবগণের অপ্রিয় ও অসুরগণের প্রিয়কার্য্যসাধন এবং কি নিমিত্তই বা স্বয়ং দেবর্ষি হইয়া দেবগণের তেজোহ্রাস করিয়াছিলেন? কিরূপে তাঁহার শুক্রত্ব ও পরম ঐশ্বৰ্য্যলাভ হইয়াছিল এবং কি নিমিত্তই বা তিনি নভোমণ্ডলের মধ্যস্থলে গমন করিতে সমর্থ হয়েন না, এই সমুদয় শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল জন্মিয়াছে; অতএব আপনি আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি ইতিপূৰ্ব্বে এই বৃত্তান্তগুলি যেরূপ শ্রবণ করিয়াছি ও যতদূর অবগত আছি, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর। ভৃগুবংশসম্ভূত মহামুনি শুক্রাচাৰ্য্য বিষ্ণুকৃত [বিষ্ণুর অবতার পরশুরামের মাতৃবধ হেতু] স্বীয় মাতৃবধনিবন্ধন দেবতাদিগের নিতান্ত বিদ্বেষ্টা হইয়াছিলেন। যক্ষরাক্ষসাধিপতি কুবের জগৎপ্রভু ইন্দ্রের কোষরক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। মহামুনি শুক্রাচার্য্য যোগবলে কুবেরের শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া যোগবলে তাঁহাকে বদ্ধ করিয়া সমুদয় সম্পত্তি অপহরণ করিয়াছিলেন। ধনপতি কুবের এইরূপে হৃতসৰ্ব্বস্ব হইয়া একান্ত ব্যাকুলিতচিত্তে অমিতপরাক্রম দেবাদিদেব রুদ্রদেবের নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহেশ্বর! ভগবান্ ভার্গব যোগবলে আমার শরীরমধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক আমাকে রোধ ও আমার সর্ব্বাস্বাপহরণ করিয়া বহির্গত হইয়াছেন। মহাযোগী মহেশ্বর কুবেরের এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র ক্রোধে আরক্তনেত্র হইয়া শূলগ্রহণপূর্ব্বক বারংবার কহিতে লাগিলেন, ‘দুরাত্মা ভার্গব কোথায়?’ ঐ সময় মহাত্মা শুক্রাচার্য্য স্বীয় উগ্রতর তপঃপ্রভাবে দূর হইতেই যোগীশ্বরের রোষ ও অভিপ্রায় অবগত হইয়া তাঁহার শূলের অগ্রভাগে আগমনপূর্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন ভগবান্ ভূতভাবন শুক্রকে তথায় অবস্থিত অবলোকনপূর্ব্বক পিনাকের ন্যায় শূলাগ্ৰ সন্নমিত করিলেন। দেবদেবের শূলাগ্র সন্নমিত হইবামাত্র শুক্রাচার্য্য তাঁহার হস্তগত হইলেন। তখন পিনাকী মুখব্যাদানপূর্ব্বক অবিলম্বে তাঁহাকে গ্রাস করিয়া ফেলিলেন। মহাত্মা শুক্রাচাৰ্য্য এইরূপে মহাদেবের উদরমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তথায় পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মহাদ্যুতি শুক্রাচার্য্য কি নিমিত্ত সেই ভূতভাবন ভগবান্ দেবদেবের জঠর হইতে বহির্গত না হইয়া তথায় পরিভ্রমণ করিলেন এবং পরিভ্রমণ করিয়াই কি কাৰ্য্য করিলেন, তৎসমুদয়ই আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

শুক্রনামের উৎপত্তি-কারণ

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! ভগবান্ কৈলাসনাথ শুক্রাচার্য্যকে গ্রাস করিয়া সলিলমধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে বহুকাল কঠোর তপানুষ্ঠান করিলেন। তৎপরে তিনি মহাহ্রদ হইতে গাত্রোত্থান করিলে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহার কুশলী ও তপোবৃদ্ধির বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন অচিন্ত্যাত্মা সত্যধর্ম্মনিরত মহাযোগী মহেশ্বর ব্রহ্মার নিকট আপনার তপোবৃদ্ধির বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া তপোবলে আপনার তেজঃ পরিবর্দ্ধিত দেখিলেন এবং স্বীয় তপস্যা ও ঐশ্বৰ্য্যদ্বারা ত্রিলোকমধ্যে অসাধারণভাবে পরিশোভিত হইয়া পুনৰ্ব্বার ধ্যানযোগ অবলম্বন করিলেন। মহাযোগী শুক্রাচার্য্য নিতান্ত উদ্বিগ্নচিত্তে তাঁহার জঠরমধ্যে অবস্থানপূৰ্ব্বক তথা হইতে বিনির্গত হইবার নিমিত্ত বারংবার স্তব করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। পরিশেষে তিনি বারংবার মহেশ্বরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিতে লাগিলেন, ‘ভগবন্! আপনি প্রসন্ন হইয়া আমাকে পরিত্রাণ করুন। আমি আর কষ্ট সহ্য করিতে পারি না।’ তখন ভগবান শূলপাণি সমুদয় ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘ভার্গব! তুমি আমার শিশ্ন[জননেন্দ্রিয় দ্বার]দ্বার দিয়া বহির্গত হও।”

‘‘মহেশ্বর এই কথা কহিলে মহর্ষি শুক্রাচার্য্য প্রথমতঃ স্বীয় নির্গমনদ্বার দেখিতে না পাইয়া কিয়ৎক্ষণ উদরমধ্যে ইতস্ততঃ ভ্রমণপূৰ্ব্বক পরিশেষে দেবদেবের শিশ্নদ্বার দিয়া বিনির্গত হইলেন। মহর্ষি ভার্গব মহেশ্বরের উপস্থদ্বার হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন বলিয়া শুক্রনামে বিখ্যাত হইয়াছেন। মহাদেবের ক্রোধনিবন্ধন ঐ মহর্যি আকাশের মধ্যস্থলে কখনই লক্ষিত হয়েন না। অনন্তর ভগবান্ দেবাদিদেব সেই তেজঃপুঞ্জকলেবর শুক্রাচার্য্যকে বিনির্গত দেখিয়া রোষপূর্ণনয়নে শূলধারণপূর্ব্বক তাঁহার বিনাশসাধনে সমুদ্যত হইলেন। দেবী পৰ্ব্বতী পশুপতিকে ক্রোধাবিষ্ট দেখিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলে, ‘নাথ! এই ব্রাহ্মণ আপনার উদর হইতে শিশ্নদ্বার দিয়া নিঃসৃত হওয়াতে আমার পুত্রস্বরূপ হইয়াছে; অতএব ইহাকে বধ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে।

“পার্ব্বতী এই কথা কহিলে, ভগবান শূলপাণি প্রসন্ন হইয়া সহাস্যবদনে তাঁহাকে বারংবার কহিতে লাগিলেন, ‘দেবি! আমি প্রীত হইয়াছি, ইহাকে যথা ইচ্ছা গমন করিতে বল।’ তখন মহর্ষি শুক্রাচাৰ্য্য দেবদেব মহাদেব ও দেবী পাৰ্ব্বতীকে প্রণাম করিয়া অভীষ্ট স্থানে প্রস্থান করিলেন। এই আমি তোমার নিকট ভৃগুনন্দন মহাত্মা শুক্রাচার্য্যের চরিত্র সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।”