২৮৯. সাংসারিক বন্ধন—অরিষ্টনেমি-সগরসংবাদ

২৮৯তম অধ্যায়

সাংসারিক বন্ধন—অরিষ্টনেমি-সগরসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মাদৃশ ভূপতিগণ কিরূপে সাবধান হইয়া পৃথিবীতে অবস্থান করিবেন এবং কোন্ কোন্ গুণ আশ্রয় করিয়া সঙ্গপাশ হইতে বিমুক্ত হইবেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মহর্যি অরিষ্টনেমি মহারাজ সগরকে যাহা কহিয়াছিলেন, আমি এই উপলক্ষে সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মহারাজ সগর মহর্ষি অরিষ্টনেমিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্‌! মনুষ্য কিরূপ মঙ্গলকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে ইহলোকে শোকসন্তপ্ত ও ক্ষুব্ধ না হইয়া সুখী হইতে পারে, তাহা পরিজ্ঞাত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক কীর্ত্তন করুন।’ মহাত্মা সগর এই কথা কহিলে সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ মহাত্মা অরিষ্টনেমি তাঁহাকে উপদেশের যোগ্যপাত্র বিবেচনা করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! মোক্ষই পরম সুখের মূল। ইহলোকে স্ত্রীপুত্রাদি পোষণনিরত ধনধান্যসমাকুল অনভিজ্ঞ লোকেরা কখনই সেই পরমপদার্থ পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। বিষয়ে আসক্তিবুদ্ধি ও তৃষ্ণাকুল মনকে নিবারণ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। স্নেহপাশনিবদ্ধ মূঢ়ব্যক্তিরা কোনকালেই মোক্ষলাভ করিতে পারে না।

স্নেহপাশচ্ছেদনের উপায়

‘এক্ষণে আমি তোমার নিকট সমুদয় স্নেহপাশ হইতে মুক্ত হইবার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, সাবধান হইয়া উহা শ্রবণ কর। যথাকালে পুত্রোৎপাদন এবং পুত্রগণ জীবনধারণে সমর্থ ও যৌবনপ্রাপ্ত হইলে তাহাদিগের বিবাহ সম্পাদনপূৰ্ব্বক স্নেহপাশবিমুক্ত হইয়া পরিভ্রমণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ভাৰ্য্যা পুত্রবতী, পুত্রবৎসলা ও বৃদ্ধা হইলে বিষয়বাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরমার্থের অন্বেষণ করা উচিত; পুত্র হউক বা না হউক, প্রথমে যথাবিধি ইন্দ্রিয়সুখ অনুভব করিয়া পরিশেষে বিষয়তৃষ্ণা বিসর্জ্জনপূর্ব্বক ইহলোকে বিচরণ ও যদৃচ্ছালব্ধ দ্রব্যে সন্তোষলাভ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। এই আমি তোমার নিকট বিষয়ভোগপূর্ব্বক উহা পরিত্যাগ করিবার বিষয় সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে মোক্ষলাভের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘ইহলোকে যাহারা বিষয়বিমুক্ত ও নির্ভয় হইয়া বিচরণ করিতে পারে, তাহারা পরমসুখে কালাতিপাত করে; আর যাহারা বিষয়ে আসক্ত হইয়া থাকে, তাহাদিগকে জন্মমৃত্যুর বশীভূত হইতে হয়, সন্দেহ নাই। দেখ, আহারসঞ্চয়নিরত কীট ও পিপীলিকাগণও নিরন্তর বিনষ্ট হইতেছে, অতএব ইহলোকে বিষয়নির্ম্মুক্ত ব্যক্তিই যথার্থ সুখী। মুমুক্ষু ব্যক্তি, আমা ব্যতিরেকে আমার পরিজনগণ এইরূপে জীবন ধারণ করিবে, এই চিন্তা এককালে পরিত্যাগ করিবেন। প্রাণীগণ স্বয়ং-উৎপন্ন, স্বয়ংপরিবর্দ্ধিত, স্বয়ংসুখ দুঃখভোগী ও স্বয়ংমৃত্যুগ্রস্ত হইয়া থাকে। মানবগণ জন্মান্তরীণ অদৃষ্টবলেই পিতামাতার সংগৃহীত অথবা স্বোপার্জ্জিত গ্রাসাচ্ছাদন প্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি পূৰ্ব্বজন্মে যেরূপ কাৰ্য্য করে, বিধাতা তাহার তদনুরূপ ভক্ষ্য নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেন, অতএব সকল লোকই স্ব স্ব কাৰ্য্যদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহপূৰ্ব্বক ইহলোকে বিচরণ করিয়া থাকে। যখন সকল মনুষ্যই স্বয়ং মৃৎপিণ্ডস্বরূপ [মাটির ঢেলা—কুম্ভকার আপনার ইচ্ছায় আবশ্যকমত মাটিদ্বারা নানা বস্তু প্রস্তুত করে] ও সতত পরাধীন, তখন তাহাদিগের পরিজনপোষণের চিন্তা করা নিতান্ত নিষ্ফল। যখন তুমি স্বজনরক্ষণে একান্ত যত্নবান হইলেও মৃত্যু তোমার পরিজনদিগকে গ্রাস করিতে পারে, তখন তুমি পরিবারদিগের ভরণপোষণ সমাপ্ত না হইতে হইতেই তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে পার। যখন তোমার স্বজনগণ মৃত হইলেও তুমি তাহাদিগের সুখদুঃখ পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হও এবং যখন তুমি জীবিত থাক বা না থাক, তোমার পরিজনদিগকে অবশ্যই স্বকার্য্যনিবন্ধন সুখদুঃখভোগ করিতে হইবে, তখন অদৃষ্টকেই বলবান্ বিবেচনা করিয়া আপনার মঙ্গল চিন্তা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। এই ভূমণ্ডলে কেহই কাহার নহে; ইহা বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইয়া মোক্ষে মনোনিবেশ করা তোমার নিতান্ত উচিত।

“যে ব্যক্তি ক্রোধ, লোভ, মোহ ও ক্ষুৎপিপাসাদি জয় করিতে পারে, যে ব্যক্তি মোহবশতঃ দ্যূতক্রীড়া, সুরাপান, স্ত্রীসম্ভোগ ও মৃগয়াবিষয়ে আসক্ত না হয়, যে ব্যক্তি প্রাণীগণের জন্ম, মরণ ও জীবনধারণের ক্লেশ বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইতে পারে, যে ব্যক্তি ধান্যপরিপূর্ণ সহস্ৰকোটি শকট প্রাপ্ত হইয়াও জীবিকানিৰ্ব্বাহের উপযুক্তমাত্ৰ ধান্য গ্রহণ করে, প্রাসাদ ও মঞ্চে যাহার সমজ্ঞান হয়, যে ব্যক্তি সমুদয় লোককে মৃত্যুসমাক্রান্ত, ব্যাধিনিপীড়িত ও জীবিকাকর্ষিত দর্শন করে, অল্পমাত্র লাভে সন্তুষ্ট হয় এবং সমুদয় জগৎকে ভোক্তা ও ভোগ্যবস্তুদ্বারা পরিপূর্ণ দর্শন করিয়া স্বয়ং মায়াময় সুখদুঃখে আসক্ত না হয়, কি পৰ্য্যঙ্কশয্যা [খাট-বিছানা], কি ভূমিশয্যা, কি উৎকৃষ্ট অন্ন, কি কদন্ন, কি পট্টবস্ত্র, কি তৃণনির্ম্মিত বস্ত্র বা বল্কল, কি কম্বল, কি চৰ্ম্ম সমুদয়েই যাহার সমান জ্ঞান, যে ব্যক্তি সমুদয় লোক পঞ্চভূতসম্ভূত বিবেচনা করিয়া স্বচ্ছন্দে অবস্থান করে, সুখদুঃখ, লাভালাভ, জয়পরাজয়, অনুরাগ, বিরাগ এবং ভয় ও উদ্বেগে যাহার সমান বুদ্ধি, যে ব্যক্তি এই এই শরীর যে রক্ত, মূত্র ও পুরীষপরিপূর্ণ ও নানাবিধ দোষের আকর এবং জরানিবন্ধন ইহাতে যে বলীপলিত [চৰ্ম্ম লোল অবস্থা] সংযোগ, কৃশতা, বিবর্ণতা, জরানিবন্ধন মুগ্ধভাব, পুংস্ত্বের উপঘাত, অন্ধত্ব, বধিরতা ও দৌর্ব্বল্যাদি জন্মে, ইহা সবিশেষ অবগত হইতে পারে, যে ব্যক্তি দেবতা, ঋষি ও অসুরগণও লোকান্তরে গমন করিয়া থাকেন বিবেচনা করিয়াসমুদয় অনিত্য জ্ঞান করে, প্রভাবসম্পন্ন অসংখ্য নরপাতিও পৃথিবী পরিত্যাগ করিয়া থাকেন বলিয়া যাহার বিবেচনা হয়, যে ব্যক্তি ইহলোকে অর্থ নিতান্ত দুর্ল্লভ ও কষ্ট নিতান্ত সুলভ এবং কুটুম্বভরণপোষণ অনর্থক ক্লেশজনকমাত্র বলিয়া বোধ করে এবং যে ব্যক্তি শাস্ত্র ও লৌকিক ব্যবহার দর্শনে সমুদয় পদার্থ অসার বিবেচনা করিয়া পরমার্থ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হয়, সেই ব্যক্তিই যথার্থ মুক্তিলাভ করিতে পারে। ইহলোকে অপত্য ও অন্যান্য আত্মীয়গণের অত্যাচার দর্শন করিয়া কাহার না মোক্ষলাভে প্রবৃত্তি জন্মে? যদি তুমি গার্হস্থ্য বা মোক্ষধৰ্ম্মসাধনবিষয়ে স্থিরবুদ্ধি হইয়া থাক, তাহা হইলে আমার বাক্যানুসারে মৃতব্যক্তির ন্যায় ব্যবহার কর।’

“হে ধৰ্ম্মরাজ! নরপতি সগর মহর্ষি অরিষ্টনেমির এই উপদেশবাক্যশ্রবণে মোক্ষধৰ্ম্মে একান্ত অনুরক্ত হইয়া প্রজাপালন করিতে আরম্ভ করিলেন।”