২৮৮তম অধ্যায়
সুষেণ চিকিৎসায় রাম-লক্ষ্মণের মোহাপনোদন
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহাবীর ইন্দ্ৰজিৎ রাম ও লক্ষ্মণকে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া বরপ্রাপ্ত শরজালদ্বারা পুনরায় তাঁহাদিগকে বন্ধন করিল। তাঁহারা শরবন্ধে বদ্ধ হইয়া পিঞ্জরস্থিত পক্ষীর ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিলেন। কপিরাজ সুগ্ৰীব রাম ও লক্ষ্মণকে ভূতলানিপতিত এবং বাণবিদ্ধকলেবর অবলোকন করিয়া সুষেণ, মৈন্দ, দ্বিবিদ, কুমুদ, অঙ্গদ, হনুমান, নীল, তার ও নল প্রভৃতি বানরগণদ্বারা তাঁহাদিগকে পরিবেষ্টিত করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। তখন কৃতকর্ম্ম বিভীষণ তথায় আগমনপূর্ব্বক প্রজ্ঞাস্ত্রদ্বারা ভ্রাতৃদ্বয়কে প্ৰবোধিত করিলে বানররাজ সুষেণ দিব্যমন্ত্রপ্ৰযুক্ত মহৌষধি বিশল্যাদ্বারা অতি সত্বরে তাঁহাদিগকে শল্যনির্মুক্ত করিয়া দিলেন। মহারথ রামলক্ষ্মণ লব্ধসংজ্ঞ ও শল্যনির্মুক্ত হইয়া গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক ক্ষণকালমধ্যেই গতক্লম হইলেন।
“অনন্তর রাক্ষসকুলতিলক বিভীষণ ইক্ষ্বাকুবংশাবতংস রামকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “হে অরাতিনিপাতন! এক গুহ্যক [দূত] কুবেরের শাসনানুসারে এই জল লইয়া কৈলাসপর্ব্বত হইতে আপনার নিকট আগমন করিয়াছে। যক্ষরাজ কুবের অন্তর্হিত প্রাণীগণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আপনাকে এই বারি প্রদান করিয়াছেন। আপনি হউন, বা অন্য কোন ব্যক্তিই হউন, এই উদকদ্বারা নেত্ৰীক্ষালন করিলে অন্তর্হিত ভূতগণকে অনায়াসে অবলোকন করিতে সমর্থ হইবেন।’ রাম বিভীষণের বিচনানুসারে সেই সুসংস্কৃত সলিলদ্বারা নেত্ৰদ্ধয় প্রক্ষালন করিলেন। মহামনাঃ লক্ষ্মণ, সুগ্ৰীব, জাম্ববান, হনুমান, অঙ্গদ, মৈন্দ, দ্বিবিদ, নীল ও অন্যান্য প্রধান প্রধান বানরীগণ ঐ জলদ্বারা নয়ন ক্ষালন করিতে লাগিলেন। তাহাতে তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের চক্ষু অতীন্দ্ৰিয় হইয়া উঠিল।
যুদ্ধার্থ ইন্দ্ৰজিতের পুনরাগমন—প্ৰাণসংহার
“এদিকে ইন্দ্ৰজিৎ কৃতকাৰ্য্য হইয়া পিতৃসমীপে গমনপূর্ব্বক সমুদয় নিবেদন করিয়া পুনরায় যুদ্ধে আগমন করিল। লক্ষ্মণ ইন্দ্ৰজিৎকে পুনরায় সমাগত দেখিয়া বিভীষণের মতানুসারে তাহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তিনি বিভীষণের বাক্যানুসারে অকৃতাহ্নিক ইন্দ্ৰজিৎকে সংহার করিবার মানসে ক্রোধান্বিতচিত্তে তাহার উপর শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বে সুররাজ ও প্ৰহ্লাদের যেরূপ ঘোরতর সমর হইয়াছিল, তদ্রূপ ইন্দ্ৰজিৎ মর্ম্মভেদী শরনিকরদ্ধারা লক্ষ্মণকে ও লক্ষ্মণ অনলসদৃশ শরসমূহদ্বারা ইন্দ্ৰজিৎকে প্রহার করিতে লাগিলেন। রাবণানন্দন লক্ষ্মণের শরস্পর্শে সাতিশয় ক্ৰোধোদ্দীপিত হইয়া আশীবিষসদৃশ অষ্টবাণ তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিল।
“এক্ষণে মহাবীর লক্ষ্মণ যেরূপে তিনবাণদ্বারা ইন্দ্ৰজিতের প্ৰাণসংহার করিলেন, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। প্রথমতঃ সুমিত্ৰানন্দন লক্ষ্মণ দুই বাণে ইন্দ্ৰজিতের শরাসন ও নারাচোপশোভিত ভুজন্দ্বয় ছেদন করিলেন। পরিশেষে তৃতীয় বাণদ্বারা তাহার কুণ্ডলমণ্ডিত মুণ্ড কর্ত্তনপূর্ব্বক ধরাতলে পাতিত করিয়া তাহার ভুজস্কন্ধবিহীন ভীমদৰ্শন কবন্ধকলেবর সংহারপূর্ব্বক সারথিকে নিধন করিলেন। তখন ঘোটকগণ রথ লইয়া লঙ্কামধ্যে প্রবেশ করিল। রাবণ শূন্যরথ-সন্দর্শনে পুত্ৰ নিহত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া শোকমোহে নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন। অনন্তর ক্রোধান্বিতচিত্তে অশোকবনস্থ রামদর্শনলালসা সীতাকে সংহার করিবার নিমিত্ত খড়গ গ্রহণপূর্ব্বক বেগে ধাবমান হইলেন। অবিন্ধ্য রাবণের পাপসঙ্কল্প বুঝিয়া বিবিধ সান্ত্বনাবাক্যদ্বারা তাঁহাকে শান্ত করিয়া কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আপনি এই দেদীপ্যমান মহারাজ্য শাসন করিতেছেন; অতএব স্ত্রীহত্যা করা আপনার নিতান্ত অনুচিত। সীতা একে নারী, তাহাতে আবার আপনার বশীভূত হইয়া বন্ধনাবস্থায় রহিয়াছে; তাহাই ত’ তাহার পক্ষে মৃত্যুতুল্য। আমার মতে উহার দেহনাশ করিলে উহাকে বধ করা হয় না; আপনি উহার ভর্ত্তাকে সংহার করুন, তাহা হইলেই উহাকে নিধন করা হইবে। স্বয়ং শতক্ৰতুও আপনার তুল্য বিক্রমশালী নহেন। আপনি অনেকবার ইন্দ্ৰাদি দেবগণকে পরাজিত ও ত্ৰাসিত করিয়াছেন।”
“অবিন্ধ্য এইরূপ বহুবিধ সাত্ত্বনাবাক্যদ্বারা রোষপরবশ রাবণকে শান্ত করিলে তিনি অবিন্ধ্যের বাক্যে সম্মত ও সমরগমনে অভিলাষী হইয়া খড়্গ পরিত্যাগপূর্ব্বক রথসজ্জা করিতে আদেশ করিলেন।”