২৮৭তম অধ্যায়
ইন্দ্রজিতের যুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণের মূর্ছা
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর রাক্ষসপ্রবর রাবণ সানুচর কুম্ভকৰ্ণ ও মহাবল ধূম্রাক্ষ সংগ্রামে নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া আত্মজ ইন্দ্ৰজিৎকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি পূর্ব্বে দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজয় করিয়া ভুমন্ডলে আমার যশোরাশি বিস্তার করিয়াছ; এক্ষণে প্রচ্ছন্ন বা সম্মুখীন হইয়া দিব্যবরপ্রাপ্ত শরদ্বারা শত্রুদিগকে সংহার কর। রাম, লক্ষ্মণ ও সুগ্ৰীব ইহারা তোমার বাণবেগ কদাচ সহ্য করিতে পরিবে না; সুতরাং তাহাদিগের অনুযায়িবৰ্গ যে তোমার সহিত সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত হইবে, ইহাও নিতান্ত অসম্ভব। কুম্ভকৰ্ণ ও প্ৰহস্ত শক্রগণের কিছুমাত্র অনিষ্টসাধন করিতে পারে নাই। অদ্য তোমা হইতেই তাহার সম্পূর্ণ আশা করিতেছি। যেমন পূর্ব্বে বাসবকে পরাজয় করিয়া আমার প্রীতিবৰ্দ্ধন করিয়াছিলে, তদ্রূপ এক্ষণে সসৈন্য শক্ৰগণকে বিনাশ করিয়া আমাকে আনন্দিত কর।’
“অনন্তর ইন্দ্ৰজিৎ সত্বর সমরবেশ পরিধান করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক রণস্থলে উপস্থিত হইল। পরে উচ্চৈঃস্বরে আপনার নাম নির্দেশপূর্ব্বক লক্ষ্মণকে ঘন ঘন আহ্বান করিতে লাগিল। মৃগরাজ সিংহ ক্ষুদ্র মৃগের যাদৃশ অনুসরণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ লক্ষ্মণ সশর শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অনবরত করতালি প্রদান করিয়া বিপক্ষ রাক্ষসগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। অনন্তর তাঁহারা পরস্পর জিগীষাপরবশ হইয়া ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন।
“তখন ইন্দ্ৰজিৎ মহাবল লক্ষ্মণকে বাণবলে পরাস্ত করিতে অসমর্থ হইয়া গুরুতর যত্নসহকারে এক তোমর-প্রহার করিলেন। লক্ষ্মণ শাণিত শরনিকরদ্ধারা সেই তোমর ছিন্ন-ভিন্ন করিলে উহা তৎক্ষণাৎ ধরাতলে নিপতিত হইল। ঐ অবসরে অঙ্গদ এক পাপ উদ্যত করিয়া মহাবেগে ধাবমান হইয়া ইন্দ্ৰজিতের মস্তকে আঘাত করিল। তখন ইন্দ্ৰজিৎ অসঙ্কুচিত অঙ্গদের হৃদয়ে এক প্রাস-অস্ত্ৰ প্রহার করিবার উপক্ৰম করিলে লক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ তাহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
“অনন্তর ইন্দ্ৰজিৎ অঙ্গদকে সম্মুখীন দেখিয়া তাঁহার বামপার্শ্বে এক গদাঘাত করিলেন। অঙ্গদ সেই গদাঘাতে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া বরং ইন্দ্ৰজিতের বধোদ্দেশে ক্রোধাভরে এক শালবৃক্ষ নিক্ষেপ করিল। শালতরু উৎসৃষ্ট হইবামাত্র ইন্দ্ৰজিতের অশ্ব, রথ ও সারথিকে বিনষ্ট করিল। তখন ইন্দ্ৰজিৎ সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া মায়াবলে সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইল। রাম তাহাকে অন্তর্হিত দেখিয়া সত্বর তথায় আগমনপূর্ব্বক কপিবল রক্ষা করিতে লাগিলেন। ইন্দ্ৰজিৎ রাম ও লক্ষ্মণকে লক্ষ্য করিয়া বাণবৃষ্টিদ্বারা তাঁহাদিগের সর্ব্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করিলে তাঁহারা অন্তর্হিত ইন্দ্ৰজিতের প্রতি বাণ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্ৰজিৎ ক্ৰোধে নিতান্ত অধীর হইয়া পুনরায় শরদ্বারা তাঁহাদিগের কলেবর ক্ষত-বিক্ষত করিল। কপিগণ নিরন্তর শরপ্রহারকারী অদৃশ্য ইন্দ্ৰজিৎকে অনুসন্ধান করিয়া এক এক শিলাখণ্ড গ্রহণপূর্ব্বক নভোমণ্ডলে উত্থিত হইল। ইন্দ্ৰজিৎ মায়াবলে অদৃশ্যরূপে বানর ও রামলক্ষ্মণকে লক্ষ্য করিয়া তীক্ষ্নশরে বিদ্ধ করিল। যেমন চন্দ্ৰসূৰ্য্য নভোমণ্ডল হইতে ভূতলে নিপতিত হয়েন, তদ্রূপ রামলক্ষ্মণ শরপরিবৃত ও মূর্চ্ছিত হইয়া রণশায়ী হইলেন।”