২৮৬তম অধ্যায়
কুম্ভকৰ্ণ সংহার
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর কুম্ভকৰ্ণ অনুচরবর্গসমভিব্যাহারে নগর হইতে নিৰ্গত হইয়া সম্মুখে বানরসৈন্য নিরীক্ষণ করিলেন। পরে রামদর্শনবাসনায় সেই সৈন্যমধ্যে দৃষ্টিপাত করিবামাত্ৰ কাৰ্ম্মুকধারী লক্ষ্মণকে দেখিতে পাইলেন। তখন বানরগণ কুম্ভকৰ্ণকে বেষ্টন করিয়া অতি বিশাল পাদব-সকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল। কেহ কেহ নির্ভীক হইয়া খর-নখর-প্ৰহারে তাহার কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিল। এইরূপে তাহারা ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া কুম্ভকৰ্ণকে বহুবিধ আয়ুধপ্রহার করিতে লাগিল।
“অনন্তর কুম্ভকৰ্ণ বানরগণকর্ত্তৃক এই প্রকার বারংবার তাড়িত হইয়া সহাস্যমুখে তাহাদিগকে ভক্ষণ করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন; চণ্ডবল ও বজাবাহুনামে মহাবল পরাক্রান্ত বানরদ্বয়কে অনায়াসে গ্ৰাস করিলেন। তখন তার প্রভৃতি বানরেরা কুম্ভকর্ণের এইরূপ ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া শঙ্কিত ও কম্পিতহৃদয়ে চীৎকার করিতে লাগিল৷ ইত্যবসরে মহাবীর সুগ্ৰীব নিৰ্ভয়ে কুম্ভকর্ণের প্রতি ধাবমান হইয়া বলপ্রকাশপূর্ব্বক তাঁহার মস্তকে এক বিশাল শালবৃক্ষ নিক্ষেপ করিলেন। বৃক্ষ নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহা শতখণ্ডে চূৰ্ণ হইয়া গেল; কিন্তু মহাবীর কুম্ভকর্ণের কিছুমাত্র অনিষ্ট হইল না।
“বীরবর কুম্ভকৰ্ণ শালপ্ৰহারে প্রতিবোধিত হইয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ ও বলপ্রকাশ্যপূর্ব্বক সুগ্ৰীবকে ভূজপঞ্জরে রুদ্ধ করিয়া হরণ করিলেন। মিত্রবৎসল সৌমিত্র এই ব্যাপার নেত্ৰগোচর করিয়া কুম্ভকর্ণের প্রতি মহাবেগে ধাবমান হইলেন এবং শরাসনে শর সন্ধান করিয়া অনবরত প্ৰহার করিতে লাগিলেন। সেই সকল নিশিত শর কুম্ভকর্ণের বর্ম্ম ও দেহ ভেদ করিয়া শোণিতাক্ত হইয়া পৃথিবী বিদীর্ণ করিতে লাগিল।
“অনন্তর কুম্ভকৰ্ণ কপীশ্বর সুগ্ৰীবকে পরিত্যাগপূর্ব্বক এক প্ৰকাণ্ড শিলাখণ্ড উদ্যত করিয়া লক্ষ্মণের প্রতি ধাবমান হইলেন। লক্ষ্মণ সত্বর খরধার ক্ষুদ্র-প্রহারে তাঁহার উদ্যত ভুজন্দ্বয় ছেদন করিলেন। তখন কুম্ভকর্ণের চারিমাত্ৰ ভুজ রহিল। পরে লক্ষ্মণ সম্মুখীন হইযা তাঁহার গৃহীতাস্ত্র হস্তচতুষ্টয় ক্ষুরদ্বারা ছেদন করিলেন।
“তখন মহাবীর কুম্ভকৰ্ণ কলেবর বৃদ্ধি করিয়া বহুতর কর, চরণ ও শিরঃসম্পন্ন হইলেন। লক্ষ্মণ ব্ৰহ্মাস্ত্রদ্বারা পর্ব্বতের ন্যায় উন্নতকায় কুম্ভকৰ্ণকে বিদীর্ণ করিলে তিনি অশনি-নির্দ্দগ্ধ শাখাপল্লবশালী পাদপের ন্যায় তৎক্ষণাৎ রণক্ষেত্রে নিপতিত হইলেন। রাক্ষসেরা কুম্ভকৰ্ণকে ভূপতিত ও গতাসু দেখিয়া সচকিতচিত্তে আশু পলায়ন করিতে লাগিল।
“অনন্তর দূষণানুজ বজ্ৰবেগ ও প্ৰমাথী যোদ্ধৃবর্গকে প্রতিষেধ করিয়া ক্রোধাভরে লক্ষ্মণের প্রতি ধাবমান হইল। লক্ষ্মণ তাহাদিগকে আগমন করিতে অবলোকন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক শর-প্রহার করিতে লাগিলেন। এইরূপে উভয় পক্ষেরই ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইলে, লক্ষ্মণ তাহাদিগের প্রতি অনবরত বাণ বর্ষণ করিলেন; তাহারাও ক্রোধাভরে লক্ষ্মণকে লক্ষ্য করিয়া নিরন্তর শর নিক্ষেপ করিল। এই অবসরে মহাবীর মারুতি এক অদ্ৰিশৃঙ্গ গ্রহণপূর্ব্বক মহাবেগে ধাবমান হইয়া বজ্ৰবেগের প্রাণসংহার করিলেন। পরে মহাবল নীল এক প্ৰকাণ্ড পর্ব্বত উদ্যত করিয়া দ্রুতবেগে আগমনপূর্ব্বক প্ৰমাথীকে বিনাশ করিল। তখন উভয় পক্ষের সৈন্যেরা পুনরায় পরস্পর তুমুল যুদ্ধ করিতে লাগিল। ঐ যুদ্ধে বানরেরাই অধিকাংশ রাক্ষসকে বিনাশ করিল; কিন্তু রাক্ষসেরা বানরদিগকে তদ্রূপ সংহার করিতে সমর্থ হইল না।”