২৮৪তম অধ্যায়
শিবহীন দক্ষযজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! বৈবস্বত মনুর অধিকারসময়ে প্রচেতার পুত্র দক্ষের অশ্বমেধযজ্ঞ কিরূপে বিনষ্ট হইয়াছিল এবং দক্ষই বা কিরূপে পার্ব্বতীর দুঃখদর্শনে কোপান্বিত বিশ্বাত্মা দেবদেব মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়া সেই যজ্ঞ পুনঃ প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন, তাহা সবিস্তর শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে; অতএব আপনি উহা কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বকালে প্রাচেতস দক্ষ ঋষিগণে পরিবৃত হইয়া হিমালয়ের পার্শ্বদেশে সিদ্ধমহর্ষি পরিসেবিত, বিবিধদ্রুমলতাপরিশোভিত হরিদ্বারে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ সময় ভূচর, খেচর ও স্বর্গবাসী প্রাণীগণ দক্ষ প্রজাপতির নিকট সমুপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার উপাসনা করিতে লাগিলেন। দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষসগণ, হাহা, হুহু তুম্বুরু, নারদ, বিশ্বাবসু ও বিশ্বসেন প্রভৃতি গন্ধৰ্ব্বগণ, ইন্দ্রের সহিত অপ্সরারা, আদিত্য, বসু, মরুৎ, রুদ্র ও সাধুগণ, ব্রহ্মার সহিত ঋষিগণ, উষ্মপায়ী, সোমপায়ী, ধূমপায়ী ও ঘৃতপায়ী পিতৃগণ, জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ এই চতুৰ্ব্বিধ প্রাণী নিমন্ত্রিত হইয়া তথায় আগমন করিলেন। দেবগণ স্ব স্ব পত্নীর সহিত সমবেত হইয়া যজ্ঞভাগ গ্রহণ করিবার নিমিত্ত বিমান-আরোহণে আগমনপূৰ্ব্বক অনলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
দক্ষযজ্ঞে দধীচি ও নারদের অনাদরপ্রদর্শন
এইরূপে সেই যজ্ঞস্থল দেবদানবাদিতে পরিপূর্ণ হইলে মহাত্মা দধীচি তাঁহাদিগকে দর্শন করিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে কহিলেন, “হে মহাশয়গণ! যে যজ্ঞে ভগবান্ রুদ্র পূজিত না হয়েন, তাহাকে যজ্ঞ বা ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। হায়! কালের কি বিপরীত গতি। তোমরা কেবল বধ ও বন্ধনলাভের নিমিত্ত এই যজ্ঞে আগমন করিয়াছ। তোমাদের যে বিনাশকাল ও মহাভয় উপস্থিত হইয়াছে, মোহবশতঃ তাহা তোমাদিগের বোধগম্য হইতেছে না।” পরমযোগী দধীচি ইহা কহিয়া ধ্যানে মনোনিবেশপূৰ্ব্বক দেখিলেন যে, মহাত্মা নারদ হরপার্ব্বতীর সমীপে সমুপস্থিত হইয়া উপবিষ্ট রহিয়াছেন। তখন তিনি এই যজ্ঞস্থলস্থিত ব্যক্তিরা সকলে একপরামর্শ হইয়া মহাদেবকে নিমন্ত্রণ করে নাই বিবেচনা করিয়া যজ্ঞস্থান হইতে অপসৃত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “যে ব্যক্তি পূজ্যের অপমান ও অপূজ্যের অর্চ্চনা করে, তাহাকে নরহত্যাসদৃশ মহাপাপে লিপ্ত হইতে হয়। আমি পূৰ্ব্বে কখন মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করি নাই এবং কোন কালে মিথ্যাকথা কহিব না; এক্ষণে আমি দেব ও ঋষিগণসমাজে সত্য করিয়া কহিতেছি, জগৎপতি যজ্ঞভোক্তা ভগবান্ পশুপতি অচিরাৎ এই যজ্ঞে সমাগত হইবেন।”
মহাত্মা দধীচি এই কথা কহিলে, দক্ষ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! ইহলোকে জটাজুটধারী শূলহস্ত একাদশ রুদ্র বর্ত্তমান রহিয়াছেন। কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে মহাদেব কে, তাহা আমি অবগত নহি।”
তখন দধীচি কহিলেন, “দক্ষ! তোমরা সকলে একপরামর্শ হইয়া দেবদেব মহাদেবকে নিমন্ত্রণ না করাই যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিয়াছ; কিন্তু আমার মতে তাঁহার তুল্য প্রধান দেবতা আর কেহই নাই। অতএব যখন তুমি তাঁহাকে নিমন্ত্রণ কর নাই, তখন নিশ্চয়ই তোমার এই যজ্ঞ বিনষ্ট হইবে।”
দক্ষ কহিলেন, “মহর্ষে! যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুর নিমিত্ত এই মন্ত্রপূত হবিঃ সুবর্ণপাত্রে সংস্থাপিত রহিয়াছে। আমি অবশ্যই ঐ যজ্ঞভাগদ্বারা সেই ভগবানকে পরিতৃপ্ত করিব।” মহর্ষি দধীচি ও দক্ষের এইরূপ বাগ্বিতণ্ডা [নিষ্ফল তর্ক] হইতে লাগিল।
অনিমন্ত্রিত শিবক্রোধে যজ্ঞে বীরভদ্র-উৎপত্তি
এ দিকে কৈলাস পর্ব্বতে দেবী পার্ব্বতী আপনার ভর্ত্তার নিমন্ত্রণ না হওয়াতে দুঃখিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হায়! আমি কিরূপ দান বা তপানুষ্ঠান করিলে আমার পতি ভগবান্ ত্রিলোচন যজ্ঞের অর্দ্ধ বা তৃতীয় ভাগ লাভ করিতে পারিবেন?”
এই নিত্যসন্তুষ্ট দেবদেব মহাদেব স্বীয় পত্নীর এইরূপ সখেদবাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “কৃশাঙ্গি! আমি সমুদয় যজ্ঞের ঈশ্বর। আমার প্রতি কিরূপ বাক্যপ্রয়োগ করা কর্ত্তব্য, তাহা তুমি জানিতে পার নাই। আজ তোমার মোহবশতঃই ইন্দ্রাদি দেবতা ও ত্রিলোকবাসী প্রাণীগণ মুগ্ধ হইয়াছে। ধ্যানবিহীন অসাধুব্যক্তিরা কদাচ আমাকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। স্তুতিপাঠকেরা যজ্ঞে আমারই স্তব করিয়া থাকে, সামবেদী ব্রাহ্মণগণ আমাকেই উদ্দেশ করিয়া সামবেদোক্ত মন্ত্র গান করেন, ব্রাহ্মণগণ ব্ৰহ্মযজ্ঞে আমারই উপাসনা করেন এবং ঋত্বিকগণ আমাকেই যজ্ঞভাগ প্রদান করিয়া থাকেন।”
দেবী কহিলেন, নাথ! অতি সামান্য লোকও স্ত্রীজনসমক্ষে আপনার প্রশংসা ও গর্ব্ব করিতে পারে।”
মহাদেব কহিলেন, “দেবি! আমি আত্মশ্লাঘা করি নাই। এক্ষণে তোমার প্রীতিসাধনের নিমিত্ত এক মহাবীরের সৃষ্টি করিতেছি, অবলোকন কর।” ভূতভাবন ভগবান্ মহেশ্বর প্রাণপ্রিয়া উমাকে এই কথা কহিয়া মুখ হইতে এক ভয়ঙ্কর পুরুষের সৃষ্টি করিলেন। ঐ বীরই বীরভদ্রনামে প্রসিদ্ধ রহিয়াছেন। বীরভদ্র মহেশ্বরের মুখ হইতে বহির্গত হইবামাত্র দেবদেব তাঁহাকে কহিলেন, “তুমি অবিলম্বে প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞ বিনষ্ট কর।” তখন সেই শিববদননির্ম্মুক্ত সিংহতুল্য বীরপুরুষ দেবীর ক্রোধশান্তির নিমিত্ত দক্ষযজ্ঞ বিনষ্ট করিবার বাসনা করিলেন। ঐ সময় দেবীর ক্রোধসম্ভূতা ভীষণমূৰ্ত্তিধারিণী মহাকালী সেই বীরপুরুষের অনুগামিনী হইলেন।
গৌরীরোষজাতা কালীসহায়ে বীরভদ্রের যজ্ঞভঙ্গ
অনন্তর সেই ভগবান্ রুদ্রের ন্যায় অনন্তবলবীৰ্য্যসম্পন্ন অতুলশৌৰ্য্যশালী মূর্ত্তিমান ক্রোধস্বরূপ মহাবীর দেবদেব মহাদেবকে প্রণাম করিয়া তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক আপনার সমুদয় রোমকূপ হইতে অসংখ্য রুদ্রগণের সৃষ্টি করিলেন। ভীমরূপ মহাকায় বীরগণ সৃষ্ট হইবামাত্র কিলকিলাশব্দে নভোমণ্ডল পরিপূর্ণ করিয়া বীরভদ্রসমভিব্যাহারে দক্ষযজ্ঞ বিনাশার্থে অবিলম্বে নিষ্ক্রান্ত হইল। তাহাদের ভয়ঙ্কর শব্দে দেবগণ ভীত হইয়া উঠিলেন, পর্ব্বতসমুদয় বিদীর্ণ, বসুন্ধরা কম্পিত, বায়ু বিঘূর্ণিত ও সলিল ভিত হইতে লাগিল। অগ্নি ও প্রভাকর প্রভাশূন্য হইলেন; চন্দ্র ও গ্রহণক্ষত্ৰ-সমুদয় আর প্রকাশিত হইল না; দেবতা, ঋষি ও মনুষ্যগণ প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন; চতুর্দ্দিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ভূতগণ যজ্ঞস্থল দগ্ধ করিতে লাগিল। কেহ কেহ তত্রত্য ব্যক্তিগণকে প্রহার ও কেহ কেহ ঘূপ উৎপাটন করিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ বায়ুবেগে ধাবমান হইতে লাগিল এবং কেহ কেহ বা যজ্ঞপাত্র ও আভরণ সমস্ত চুর্ণ করিয়া ফেলিল। পৰ্ব্বতোপম অনুপানের স্তুপসমুদয়ই ইতস্ততঃ নিক্ষিপ্ত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, নভোমণ্ডলে নক্ষত্রগণ সমুদিত হইয়াছে। ভূতগণ ক্ষীর, ঘৃত, পায়স, দধি, খণ্ড [মিশ্রি], শর্কর ও মাংস প্রভৃতি বিবিধ ভোজ্য এবং উৎকৃষ্ট পেয়-সমুদয় নানাপ্রকার মুখ দ্বারা ভোজন ও পান করিতে লাগিল। কেহ কেহ ভোজ্যদ্রব্যসমুদয় দন্তদ্বারা ছেদন ও কেহ কেহ বা নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ সুরসৈন্যদিগকে ভীত ও ক্ষুভিত করিয়া ক্রীড়া করিতে লাগিল এবং কেহ কেহ সুরনারীদিগকে দূরে নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল।
এইরূপে মহাবীর বীরভদ্র ক্রোধপ্রভাবে ভূতগণের সাহায্যে সেই সৰ্ব্বদেব-সুরক্ষিত যজ্ঞস্থল দগ্ধ করিয়া মৃগরূপী [মৃগরূপে পলায়মান যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার—যজ্ঞ বলিলে অগ্নি আহুতি প্রভৃতি ব্যাপারময় উৎসব উপলক্ষিত হইলেও উহার একটি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন] পলায়মান যজ্ঞের শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক প্রফুল্লমনে ভয়ঙ্কর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।
শিবশরণাগত দক্ষের যজ্ঞসাফল্য
অনন্তর ব্রহ্মাদি দেবগণ ও প্রজাপতি দক্ষ, বীরভদ্রের সন্নিধানে। গমনপূৰ্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্! আপনি কে?” তখন বীরভদ্র দক্ষকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ব্ৰহ্মন! আমি রুদ্র বা দেবী পার্ব্বতী নহি। আমি এই যজ্ঞস্থলে ভোজন বা কৌতুহলপরতন্ত্র হইয়া ব্রাহ্মণগণকে দর্শন করিতে আসি নাই। দেবী পার্ব্বতী দুঃখিত হওয়াতে সৰ্ব্বাত্মক ভগবান রুদ্র স্বয়ং ক্রোধাবিষ্ট হইয়াছেন। আমি তাঁহারই আদেশানুসারে তোমার এই যজ্ঞ বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি। আমার নাম বীরভদ্র। আমি রুদ্রদেবের ক্রোধানল হইতে উৎপন্ন হইয়াছি। আর দেবী পার্ব্বতীর ক্রোধ হইতে এই বীরনারী সঞ্জাত হইয়াছেন। ইহার নাম ভদ্রকালী। আমরা উভয়ে রুদ্রদেবের নির্দ্দেশানুসারে তোমার এই যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি সেই দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হও। অন্য দেবতার নিকট বর গ্রহণ করা অপেক্ষা তাঁহার ক্রোধে নিপতিত হওয়াই শ্রেয়ঃ।”
মহাবীর বীরভদ্র এই কথা কহিলে ধার্ম্মিকপ্রধান দক্ষ তাঁহার বাক্যানুসারে মহেশ্বরকে নমস্কার করিয়া স্তবদ্বারা তাঁহার তুষ্টিসম্পাদন করিবার বাসনায় কহিলেন, “আমি সেই নিত্য, নিশ্চল, অবিনশ্বর বিশ্বপতি দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হইলাম।” তখন দক্ষ এইরূপ স্তব করিলে সহস্র-সূৰ্য্যসঙ্কাশ সংবৰ্ত্তকসদৃশ ভগবান্ রুদ্র প্রসন্ন হইয়া প্রাণায়াম ও চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে সেই ভূতপিশাচোপদ্রুত অগ্নিকুণ্ড হইতে সহসা সমুত্থিত হইলেন এবং দক্ষের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক সহাস্যবদনে কহিলেন, “ব্রহ্মন্! তোমার কি উপকার করিব?” প্রজাপতি দক্ষ তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র ভীত হইয়া বাষ্পকুললোচনে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্! যদি আপনি প্রসন্ন হইয়া থাকেন এবং আমাকে প্রিয়পাত্ৰবোধে অনুগ্রহ প্রদর্শনপূর্ব্বক বর প্রদান করিতে অভিলাষী হয়েন, তাহা হইলে আমার যে সমস্ত দ্রব্য দগ্ধ, ভক্ষিত, পীত, বিনষ্ট, চূর্ণীকৃত ও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়াছে, সেই সমস্ত বহুকালে বহুযত্নে সঞ্চিত যজ্ঞীয় দ্রব্য যেন নিষ্ফল না হয়। তখন ধর্ম্মাধ্যক্ষ ভগবান বিরূপাক্ষ‘ তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহাকে অভিলাষানুরূপ বর প্রদান করিলেন; প্রজাপতি দক্ষ ভগবান্ ভবানীপতি রুদ্র হইতে এই বরলাভ করিয়া ক্ষিতিতলে জানুদ্বয় সংস্থাপনপূর্ব্বক অষ্টোত্তরসহস্র নাম কীৰ্ত্তনপূৰ্ব্বক মহাদেবের স্তবপাঠ করিতে লাগিলেন।