২৮৩তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের জ্বরোৎপত্তি জিজ্ঞাসা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ ও বিজ্ঞতম। আপনার মুখে এই বৃত্রাসুরবধবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া আপনাকে আর একটি বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে আমার বাসনা হইয়াছে, শ্রবণ করুন। আপনি ইতিপূৰ্ব্বে কহিলেন যে, দানবরাজ বৃত্র জ্বররোগে মোহিত হইলে দেবরাজ ইন্দ্র স্বীয় বজ্ৰাস্ত্রপ্রভাবে তাহাকে নিহত করিলেন। কিন্তু এই জ্বররোগ কোন্ স্থান হইতে কিরূপে প্রাদুর্ভূত হইল, তাহা আমি অবগত নহি; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, ‘ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমার নিকট জগদ্বিখ্যাত জ্বরোৎপত্তিবিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে সুমেরুপৰ্ব্বতের সাবিত্রনামে এক বিবিধরত্নবিভূষিত ত্রিলোকপূজিত অনুপম শৃঙ্গ ছিল। ঐ শৃঙ্গে কোন ব্যক্তিই গমন করিতে সমর্থ হইত না। ভগবান্ ভূতভাবন সেই সুবর্ণবিভূষিত সুমেরুশৃঙ্গের শিলাতলে উপবিষ্ট থাকিতেন; শৈলরাজদুহিতা পার্ব্বতীও সতত তাঁহার পার্শ্বে অবস্থান করিতেন। মহানুভব দেবগণ, অমিতপরাক্রম বসুগণ, মহাত্মা অশ্বিনীকুমারদ্বয়, গুহ্যকগণপরিবেষ্টিত যক্ষাধিপতি কুবের, মহর্ষি শুক্র, অঙ্গিরা, সনৎকুমার প্রভৃতি ব্রহ্মর্ষিগণ, দেবগণ, বিশ্বাবসু, নারদ, পৰ্ব্বত প্রভৃতি গন্ধৰ্ব্বগণ, বহুসংখ্যক অঙ্গরা এবং অসংখ্য বিদ্যাধর, সিদ্ধ ও তপোধনগণ তথায় আগমন করিয়া দেবাদিদেবের উপাসনা করিতেন। তথায় নানাগন্ধসমযুক্ত পবিত্র সমীরণ প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হইত। সকল সময়ে সমুদয় ঋতুর পুষ্প প্রস্ফুটিত হইত। নানারূপধারী বিকটমূৰ্ত্তি মহাবলপরাক্রান্ত ভূত, পিশাচ ও রাক্ষস প্রভৃতি অনুচরগণ সতত শঙ্করের সমীপে সমুপস্থিত থাকিত। ভগবান্ নদী প্রজ্জ্বলিত শূলধারণ করিয়া সতত তাঁহার নিকট অবস্থান করিতেন। সর্ব্বতীর্থময়ী [যাঁহার পুণ্যজলে স্নান করিলে সৰ্ব্বতীর্থের ফললাভ হয়] সরিদ্বরা গঙ্গা মূর্ত্তিমতী হইয়া তাঁহার উপাসনায় তৎপর থাকিতেন। এইরূপে ভগবান ভূতভাবন দেবগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া সেই সুমেরুশৃঙ্গে অবস্থান করিয়াছিলেন।
“কিয়ৎকাল অতীত হইলে প্রজাপতি দক্ষ যথাবিধানে যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ ঐ যজ্ঞে গমন করিবার মানসে সকলে সমবেত হইয়া মহাদেবের আদেশানুসারে অনল ও সূৰ্য্যপ্রভ বিমানে আরোহণপূৰ্ব্বক হরিদ্বারে গমন করিলেন। শৈলরাজদুহিতা তাঁহাদিগকে গমন করিতে দেখিয়া স্বীয় পতিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! ইন্দ্রাদি দেবগণ কোন্ স্থানে গমন করিতেছেন, আপনি তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
শিবরহিত যজ্ঞের ব্যর্থতা
“তখন মহাদেব কহিলেন, ‘দেবি! প্রজাপতি দক্ষ অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন, দেবগণ সেই যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হইয়া গমন করিতেছেন।’ পার্ব্বতী কহিলেন, ‘মহান! আপনি কি নিমিত্ত তথায় গমন করিলেন না, আপনার তথায় গমন করিবার বাধা কি?’ মহাদেব কহিলেন, ‘প্রিয়ে! পূৰ্ব্বকালে যজ্ঞভাগকল্পনার সময়ে দেবগণ আমার ভাগ নির্দ্দেশ করেন নাই। সেই পূর্ব্বরীতি অনুসারে অদ্যাপি তাঁহারা আমাকে যজ্ঞভাগ প্রদান করেন না।’ তখন পার্ব্বতী কহিলেন, ‘মহাভাগ! আপনি রূপ, গুণ, যশঃ, তেজঃ ও প্রভাবে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আপনাকে অতিক্রম কর কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। অতএব আপনার যজ্ঞভাগ কল্পিত হয় নাই শুনিয়া আমি যারপরনাই দুঃখিত হইলাম।’ পার্ব্বতী পশুপতিকে এই কথা কহিয়া দুঃখিতমনে মৌনভাবে অকস্থান করিতে লাগিলেন।
“তখন ভগবান ভূতভাবন ভবানীর অভিপ্রায় অবগত হইয়া নন্দীকে তথায় অবস্থান করিতে আদেশ করিয়া যোগবলে স্বীয় অনুচরগণসমভিব্যাহারে দক্ষের যজ্ঞস্থলে গমনপূর্ব্বক যজ্ঞ ধ্বংস করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার অনুচরগণমধ্যে কেহ কেহ সিংহনাদ পরিত্যাগ, কেহ কেহ হাস্য, কেহ কেহ যজ্ঞাগ্নিতে রুধির বর্ষণ, কেহ কেহ ঘূপ উৎপাটনপূৰ্ব্বক পরিভ্রমণ এবং কেহ কেহ বা স্বীয় বিকটানন বিস্তার করিয়া যজ্ঞের পরিচারকদিগকে গ্রাস করিতে আরম্ভ করিল।
“মহাদেবের অনুচরগণ এইরূপ উপদ্রব আরম্ভ করিলে যজ্ঞ [যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা] নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া মৃগরূপ ধারণপূর্ব্বক আকাশমার্গে পলায়ন করিতে লাগিল। ভগবান্ মহাদেব যজ্ঞকে মৃগরূপে পলায়ন করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে শরাসনে শরসংযোজনপূর্ব্বক তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। যজ্ঞের অনুসরণ করিতে করিতে তাঁহার বিকট ললাটদেশ হইতে স্বেদবিন্দু বিনির্গত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। ঘর্ম্মবিন্দু নিপতিত হইবামাত্র তথায় কালাগ্নিসদৃশ হুতাশন প্রাদুর্ভূত ও ঐ হুতাশন হইতে এক খর্ব্বাকার, মহাবলপরাক্রান্ত, কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ সদ্ভূত হইল। উহার পরিধানে রক্তাম্বর, নেত্র লোহিত, শ্মশ্রু হরিদ্বর্ণ এবং শরীর শ্যেন ও উলূকের ন্যায় লোমশ। ঐ পুরুষ সমুৎপন্ন হইবামাত্র অনল যেমন কক্ষকে ভস্মসাৎ করে, তদ্রূপ সেই মৃগরূপী যজ্ঞকে ভস্মসাৎ করিয়া মহাবেগে ঋষি ও দেবগণের প্রতি ধাবমান হইল। দেবতারা তদ্দর্শনে অতিমাত্র ভীত হইয়া দশ দিকে ধাবমান হইলেন। বসুমতী সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহাপুরুষের পদভরে কম্পিত হইয়া উঠিল এবং সমুদয় জগৎ হাহাকারে পরিপূর্ণ হইল।
শিবরোষে জুরোৎপত্তি—জ্বরের বহু বিভাগ
“এইরূপে সমুদয় লোক নিতান্ত বিপদাপন্ন হইলে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা দেবাদিদেব মহাদেবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহেশ্বর! ঐ দেখুন, সমুদয় লোক উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়াছে। এই সমুদয় ঋষি ও দেবতা আপনার ক্রোধদর্শনে কিছুতেই সুস্থ হইতে পারিতেছেন না; অতএব আপনি অচিরাৎ ক্রোধ সংবরণ করুন। দেবগণ অদ্যাবধি আপনাকে সমুচিত যজ্ঞাংশ প্রদান করিবেন। আপনার স্বেদবিন্দু হইতে এই যে পুরুষ বিনির্গত হইয়াছে, এ জ্বরনামে বিখ্যাত হইয়া পৃথিবীমধ্যে বিচরণ করিবে কিন্তু আপনার এই তেজোরাশি একত্র অবস্থিত থাকিলে সমুদয় পৃথিবীও উহা ধারণ করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব আপনি এই তেজোরাশিকে বহু ভাগে বিভক্ত করুন।’
“লোকপিতামহ ব্রহ্মা এই কথা কহিয়া ভগবান্ ভবানীপতির যজ্ঞভাগ কল্পনা করিলে তিনি সাতিশয় প্রীতমনে ও গর্ব্বিতবচনে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীয় ভাগ স্বীকার করিলেন। অনন্তর দেবাদিদেব জীবগণের শান্তিবিধানার্থ জ্বরকে নানাপ্রকারে বিভক্ত করিলেন। নাগগণের শিরঃসন্তাপ, পৰ্ব্বতের শিখা, সলিলের শৈবাল, ভুজগের নির্স্মোক, গোসমুদয়ের পাদরোগ, পৃথিবীর ঊষরতা, পশুদিগের দৃষ্টিপ্রতিরোধ, অশ্বের গলরোগ, ময়ূরের শিখাভেদ, কোকিলের নেত্ররোগ, মেষের পিত্তভেদ, শুকের হিক্কা এবং শার্দ্দূলের শ্রমই জ্বরনামে কথিত হইয়া থাকে। আর ঐ জ্বর স্বনামে প্রসিদ্ধ হইয়া জন্ম, মৃত্যু ও অন্যান্য সময়ে মানবদিগের শরীরে প্রবিষ্ট হয়। দেবাদিদেব মহাদেবের ঐ জ্বরনামক সুদারুণ তেজসমুদয় জীবের নমস্য ও মান্য। দানবরাজ বৃত্র ঐ জ্বরে সমাক্রান্ত হইয়া জৃম্ভা পরিত্যাগ করিলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার প্রতি বজ্রনিক্ষেপ করিয়াছিলেন। ঐ বজ্ৰাস্ত্রপ্রভাবে অসুররাজের শরীর বিদীর্ণ হইয়া যায়। তৎকালে তিনি নারায়ণে একান্ত ভক্তিমান্ ছিলেন বলিয়া যুদ্ধে নিহত হইবামাত্র উৎকৃষ্ট বিষ্ণুলোকে গমন করিয়াছিলেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি তোমার নিকট বৃত্রাসুরের বৃত্তান্তপ্রসঙ্গে বিস্তারিতরূপে জ্বরোৎপত্তি কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আর কি শ্রবণ করিতে তোমার বাসনা আছে, তাহা প্রকাশ কর। যিনি অবহিতচিত্তে এই জ্বরোৎপত্তি-বিষয় পাঠ করেন, তিনি রোগশূন্য ও সুখী হইয়া পরমাহ্লাদে অভিলষিত ফল লাভ করিতে সমর্থ হয়েন, সন্দেহ নাই।”