২৮২তম অধ্যায়
রামসমীপে সুগ্ৰীবের বানর সৈন্য-প্রেরণ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর সমুদয় বানরশ্রেষ্ঠ সুগ্ৰীবের বিচনানুসারে পর্ব্বতোপরি বানরগণের সহিত সুখাসীন রামের সমীপে সমুপস্থিত হইতে লাগিল। বালীর শ্বশুর শ্ৰীমান। সুষেণ মহাবল পরাক্রান্ত সহস্ৰ-কোটি বানর লইয়া আগমন করিল। বানরেন্দ্র গয় ও গবয় শতকোটি বানরে পরিবৃত হইয়া সমাগত হইল। ভীমদৰ্শন গবাক্ষনামা গোলাঙ্গুল বানর ষষ্টিসহস্ৰকোটি বানর-সমভিব্যাহারে রাম-সন্নিধানে আগমন করিল। গন্ধমাদননিবাসী গন্ধমাদন-নামা বানর শতসহস্রকোটি বানর লইয়া উপস্থিত হইল। পনস নামে মেধাবী মহাবলপরাক্রান্ত বানর দ্বিপঞ্চাশাৎ কোটি বানর আনয়ন করিল। বলবীৰ্য্যসম্পন্ন শ্ৰীমান দধিমুখনামে বৃদ্ধ বানর ভীমপরাক্রমশালী সুমহতী বানরসেনা লইয়া রাম-সন্নিধানে সমাগত হইল। জাম্বুবান কৃষ্ণবর্ণ পাণ্ডুবদন ভীমকর্ম্ম শতসহস্রকোটি ভল্লুক লইয়া আগমন করিল।
“এই সমুদয় ও অন্যান্য বহুসংখ্যক প্রধান প্রধান বানরগণ রামের কাৰ্য্যসাধন নিমিত্ত তথায় সমুপস্থিত হইল। ঐ সমস্ত গিরিকূটসন্নিভ বানরগণ মহাবেগে ধাবমান হইয়া তুমুল-শব্দে সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিতে লাগিল। উহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ শৈলশৃঙ্গের ন্যায়, কেহ কেহ মহিষের তুল্য, কেহ কেহ বা শরদভ্রসন্নিভ [শরৎকালীন মেঘসম] ও হিঙ্গুলবৰ্ণমুখসম্পন্ন। কপিগণ উৎপতিত, পতিত ও প্লবমান হইয়া ধূলিপটল উদ্ধৃত করিয়া মহাবেগে চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইতে লাগিল। ঐ সমুদয় বানরসৈন্য সুগ্ৰীবের অনুমতিক্রমে সেই স্থানেই সন্নিবেশিত হইয়া রহিল।
“এইরূপে সেই সমুদয় প্রধান প্রধান বানরগণ একত্র মিলিত হইলে রাম প্রশস্ত তিথি নক্ষত্রে উত্তম মুহুর্তে তাহাদিগকে লইয়া সুগ্ৰীব-সমভিব্যাহারে গমন করিলেন, বোধ হইল যেন, ভূলোক আলোড়িত হইতে লাগিল। পবননন্দন হনুমান সেই মহাসৈন্যের মুখস্বরূপ হইলেন এবং সুমিত্ৰানন্দন লক্ষ্মণ উহার জঘনদেশ পালন করিতে লাগিলেন। গোধাঙ্গুলিত্ৰধারী রাম ও লক্ষ্মণ কপিসৈন্যে পরিবেষ্টিত হইয়া গ্ৰহগণপরিবৃত চন্দ্ৰসূৰ্য্যের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। ঐ সুমহৎ বানরসৈন্য শাল, তাল ও শিলা ধারণ করিয়া উদয়াচলচূড়াবলম্বী দিনকরের অভিমুখস্থিত শালিকাননের[বনসন্নিবিষ্ট সংখ্যাতীত ষান্যতৃণশ্রেণীর] ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।
সাগরতীরে রামের সৈন্যসমাবেশ-সেতুবন্ধন মন্ত্রণা
“সেই মহতী বানরচমূ নল, নীল, অঙ্গদ, ক্রাথ, মৈন্দ ও দ্বিবিদকর্ত্তৃক পালিত হইয়া রাঘবের কাৰ্য্যসাধন করিতে গমন করিল। সৈন্যগণ প্রভূত মধু, মাংস ও জলসম্পন্ন, বিবিধ ফলমূল-সংকীর্ণ অরণ্য ও গিরিশিলাতলে বাস করিয়া নির্ব্বিঘ্নে ক্ষীরোদসাগরসমীপে সমুপস্থিত হইল। দ্বিতীয়সাগরসন্নিভ বহুধ্বজশালী সেই বানরসৈন্য সমুদ্রের বেলাভূমিতে বাস করিতে লাগিল ।
“তখন শ্ৰীমান দাশরথি সুগ্ৰীব ও অন্যান্য প্রধান প্রধান বানরগণকে কহিলেন, “তোমাদের মতে সাগরলঙ্ঘনের উপায় কি? কিরূপে এই মহতী সেনা ঈদৃশ দুস্তর সাগর পার হইবে?’ তখন কোন কোন স্বাভিমানী বানর কহিল, “আমরা লম্ফপ্রদানদ্বারা সমুদ্র পার হইব।” কেহ কেহ নৌকাদ্বারা ও কেহ কেহ বা বিবিধ প্লব[উড়ুপ—জলের উপর ভাসমান ভেলা]দ্বারা সমুদ্র উত্তীর্ণ হইতে স্থির করিল। তখন রাম তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া কহিলেন, ‘ইহার মধ্যে কোন মতই যুক্তিসিদ্ধ নহে, কারণ সাগর শত-যোজনবিত্তীর্ণ; সমুদয় বানরগণ লম্ফপ্ৰদানদ্বারা উহা অতিক্রমণ করিতে সমর্থ হইবে না। এত অধিক নৌকাও নাই যে, এই মহতী চমূ তন্দ্বারা পার হইতে পারে। বিশেষতঃ বণিকদিগের প্রতি উপদ্রব করা মাদৃশ ব্যক্তির নিতান্ত অকর্ত্তব্য। শত্ৰুগণ ছিদ্ৰ পাইলেই আমাদের এই অসংখ্য সৈন্য অনায়াসে সংহার করিবে; অতএব প্লব বা উড়ুপদ্ধারা পার হওয়া আমার মতে কোনরূপেই যুক্তিসিদ্ধ হয় না। অতএব আমি ঐ সমস্ত উপায় পরিত্যাগপূর্ব্বক রত্নাকরের আরাধনা করি। আমি উপবাস করিয়া ইহার তীরে শয়ান থাকিলে ইনি অবশ্যই আমাকে পথ প্ৰদান করিবেন। যদি না করেন, অগ্নিতুল্য সমুজ্জ্বল অপ্ৰতিহত মহাস্ত্রদ্বারা ইহাকে দগ্ধ করিয়া ফেলিব।’
“এই বলিয়া রাম লক্ষ্মণের সহিত কুশাসন সংস্তীর্ণ করিয়া সাগরতীরে শয়ন করিয়া রহিলেন। তখন রত্নাকর রাঘবের সম্মুখে জলজন্তুগণের সহিত আবির্ভূত হইয়া মধুর-বাক্যে কহিলেন, “হে লোকনাথ! আমি কোন বিষয়ে আপনাকে সাহায্য প্রদান করিব আদেশ করুন।” রাম কহিলেন, “হে সমুদ্র! আমি ইক্ষুকুবংশীয়, তোমারই জ্ঞাতি; এক্ষণে রাক্ষস-কুলপাংশুল রাবণকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত লঙ্কায় গমন করিব; অতএব তুমি আমার সৈন্যগণের গমনপথ প্ৰদান কর। যদি এই বিষয়ে সম্মত না হও, তাহা হইলে এখনই মন্ত্রপূত শরদ্বারা তোমাকে শুষ্ক করিব।”
“এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র নিম্নগা[নদী]পতি অতিমাত্র দুঃখিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “হে রাঘব! আপনি আমার শোষণ বিষয়ে বিরত হউন, আমি কদাচ আপনার বিঘ্ন-সম্পাদন করিব না; কিন্তু এক্ষণে আমি যাহা নিবেদন করিতেছি, শ্রবণ করিয়া কর্ত্তব্য অবধারণ করুন। অদ্য যদি আপনার আদেশানুসারে সৈন্যগণের গমনপথ প্রদান করি, তাহা হইলে অন্যেও কামুকবলে আমাকে এইরূপ আজ্ঞা করিবে, সন্দেহ নাই। অতএব বিশ্বকর্ম্মার আত্মজ সাতিশয় শিল্পী নলনামা মহাবল এক বানর আছেন; তিনি আমার উপর যে সমস্ত শিলা, কাষ্ঠ ও তৃণ নিক্ষেপ করিবেন, আমি তাহা ধারণ করিয়া আপনার সেতু প্ৰস্তুত করিয়া দিব।” এই বলিয়া সরিৎপতি সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।
নলকর্ত্তৃক সাগরে সেতুবন্ধন
“অনন্তর রাঘব নলকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, ‘হে নল তুমি সকল বিষয়েই সমর্থ এবং আমার একান্ত প্রিয়তম; এক্ষণে সমুদ্রে সেতুবন্ধন কর।’ এই বলিয়া রঘুবংশাবতংস রাম সাগরনির্দ্দিষ্ট উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক নল-বানরদ্বারা দশ-যোজন বিস্তীর্ণ ও শত-যোজন আয়ত এক সেতু নির্ম্মাণ করাইলেন। অদ্যাপি উহা ভূমণ্ডলে নলসেতু বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে এবং সমুদ্র রামের আদেশক্রমে আজও ঐ পর্ব্বততুল্য প্রকাণ্ড সেতু অনায়াসে ধারণ করিয়া আছেন।
বিভীষণ—সাহায্যে রামের লঙ্কাপ্রবেশ-শিবির সংস্থান
‘অনন্তর একদা রাবণের ভ্রাতা পরমধার্ম্মিক বিভীষণ মন্ত্রিসমভিব্যাহারে সাগরতীরবর্ত্তী রাঘবের নিকট উপস্থিত হইলে রাম স্বাগত প্রশ্নপূর্ব্বক তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তখন বিভীষণকে রাবণের গুপ্তচর বলিয়া সুগ্ৰীবের অন্তঃকরণে শঙ্কা জন্মিল। রাম আকার [হৃদগত ভাব] ও ইঙ্গিতদ্বারা তাঁহাকে নির্দোষ বিবেচনা করিয়া যথোচিত উপচারে অৰ্চনাপূর্ব্বক রাক্ষসরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন এবং মন্ত্রণাবিষয়ে লক্ষ্মণের পরম সুহৃৎ করিয়া দিলেন।
“অনস্তর রাম বিভীষণের মতানুসারে সৈন্যগণ-সমভিব্যাহারে একমাসে সেই সেতুদ্বারা সমুদ্র পার হইলেন; পরে লঙ্কাপ্রবেশ করিয়া বানরগণদ্বারা রাবণের অতি বিস্তীর্ণ বহুবিধা রমণীয় উদ্যান ভগ্ন করিলেন। রাবণের মন্ত্রি শুক ও সারণ গুপ্তচর হইয়া বানরবেশে স্কন্ধাবারে[সৈন্য-শিবিরে] প্রবেশ করিয়াছিল; বিভীষণ জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে ধারণ করিলেন। পরে যখন তাহারা পুনর্ব্বার রাক্ষস রূপ পরিগ্রহ করিল, তখন কৃপাবান রাম তাহাদিগকে কপিবল অবলোকন করাইয়া প্ৰতিগমনের আদেশ প্রদান করিলেন। অনন্তর তিনি সেই নগরীর সুরম্য উপবনে সেনানিবেশ সংস্থাপনপূর্ব্বক মহাবীর অঙ্গদকে দৌত্যকর্ম্মে নিযুক্ত করিয়া রাবণসমীপে প্রেরণ করিলেন।”