২৮১তম অধ্যায়
ইন্দ্ৰ-বৃত্রবিরোধ—বৃত্রসহ যুদ্ধে ইন্দ্রের মোহ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অতুল তেজঃসম্পন্ন, জ্ঞানবান্, বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ অসুররাজ বৃত্রের কি অনির্ব্বচনীয় ধার্ম্মিকতা! তিনি অসুর হইয়া কিরূপে অমিততেজাঃ ভগবান্ বিষ্ণুর দুৰ্জ্জেয় মহিমা পরিজ্ঞাত হইলেন? আপনি আমার নিকট বৃত্রের উপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিলেন; আমিও শ্রদ্ধান্বিত হইয়া উহা শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে পুনৰ্ব্বার বিশেষরূপে বৃত্রের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে আমার বাসনা হইয়াছে। বেদান্ততত্ত্বজ্ঞ বিষ্ণুভক্ত পরমধার্ম্মিক বৃত্র কিরূপে ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক নিপাতিত হইলেন, এই বিষয়ে আমার অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইতেছে; অতএব অসুররাজ বৃত্র যেরূপে ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক পরাজিত হইলেন এবং যেরূপে তাঁহাদিগের উভয়ের যুদ্ধ হইল, আপনি তৎসমুদয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পূৰ্ব্বকালে দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্রের সহিত সংগ্রাম করিবার মানসে দেবগণসমভিব্যাহারে রথারোহণপূর্ব্বক গমন করিয়া দেখিলেন, পঞ্চশত যোজন উন্নত, তিনশত যোজন বিস্তৃত অসুররাজ বৃত্র দানবসৈন্যের অগ্রভাগে পৰ্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। দেবগণ সেই ত্রিলোকদুর্জ্জয় মহাবীরকে নিরীক্ষণ করিয়া যারপরনাই ভীত হইলেন। সহসা ভয়ঙ্কর রূপদর্শনে ভয়ে ইন্দ্রের ঊরুস্তম্ভ [ঊরুর পীড়া—উরু-সন্ধিতে বেদনাজন্য গতিরোধ] হইল। অনন্তর সংগ্রামস্থলে উভয় পক্ষের বাদিত্ৰনিস্বন ও সিংহনাদ হইতে লাগিল। অসুররাজ বৃত্র ইন্দ্রকে সমরে অবস্থিত, দেখিয়া অণুমাত্রও সম্ভ্রম, ভয় বা যত্ন করিলেন না।
“তৎপরে দেবরাজ ও মহাত্মা দানবরাজের ভয়াবহ তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত হইল। অসি, পট্টিশ, শূল, শক্তি, তোমর, মুদগর, শিলা, শরাসন এবং অনল ও উল্কা প্রভৃতি বিবিধ দিব্যাস্ত্রে সংগ্রামস্থল সমাকীর্ণ হইল। সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা এবং অসংখ্য দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, অপ্সরা ও গন্ধৰ্ব্বগণ দিব্যবিমানে সমারূঢ় হইয়া যুদ্ধ দর্শন করিবার নিমিত্ত আকাশপথে সমুপস্থিত হইলেন। তখন ধর্ম্মপরায়ণ দৈত্যেন্দ্র বৃত্র ইন্দ্রের চতুর্দ্দিকে শিলাবর্ষণ করিয়া নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে দেবগণও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া শরজালবর্ষণপূর্ব্বক অচিরাৎ সেই প্রস্তুরবৃষ্টি নিবারণ করিলেন। তখন মহাবল পরাক্রান্ত মায়াবী দানবরাজ মায়াযুদ্ধে দেবেন্দ্র পুরন্দরকে বিমোহিত করিয়া ফেলিলেন।
“এইরূপে দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্ৰকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া মোহপ্রাপ্ত হইলে, মহর্ষি বশিষ্ঠ সামবেদোক্ত মন্ত্রপাঠদ্বারা তাঁহাকে প্রবোধিত করিয়া কহিলেন, “সুররাজ! তুমি দেবশ্রেষ্ঠ, অসুরঘাতী ও অসাধারণ বলসম্পন্ন হইয়া কি নিমিত্ত বিষন্ন হইতেছ? ঐ দেখ, লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেব, ভগবান্ চন্দ্র ও অসংখ্য মহর্ষি অবস্থান করিতেছেন। এক্ষণে তুমি ইতরলোকের ন্যায় বিমোহিত না হইয়া যুদ্ধবিষয়িণী শ্রেষ্ঠবুদ্ধি অবলম্বনপূৰ্ব্বক শত্রুগণকে পরাভূত কর। ঐ দেখ, সৰ্ব্বলোকনমস্কৃত লোকগুরু ভগবান্ ত্রিনয়ন তোমাকে নিরীক্ষণ করিতেছেন; তুমি অচিরাৎ মোহ পরিত্যাগ কর। ঐ দেখ, বৃহস্পতি প্রভৃতি ব্রহ্মর্ষিগণ তোমার জয়াকাঙ্ক্ষী হইয়া তোমাকে স্তব করিতেছেন।
মোহমুক্ত বাসবের যুদ্ধাৰ্থ পুনরভ্যুত্থান
“অতুল তেজঃসম্পন্ন দেবরাজ মহাত্মা বশিষ্ঠকর্ত্তৃক এইরূপ প্রবোধিত হইয়া প্রভূত বল ধারণ করিলেন। তখন তাঁহার উৎকৃষ্ট যোগবলে বৃত্রের মায়া তিরোহিত হইল। অনন্তর অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতি ও অন্যান্য পরমর্ষিগণ [পরম ঋষিগণ] বৃত্রের অসীম পরাক্রমদর্শনে লোকের হিতকামনায় দেবদেব মহাদেবের নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ভগবন্! অসুররাজ বৃত্র যাহাতে নিপাতিত হয়, আপনি তাহার উপায়বিধান করুন। মহর্ষিগণ এই কথা কহিবামাত্র ভূতভাবন ভগবান্ মহশ্বেরের তেজঃ জ্বররূপী হইয়া দৈত্যবর বৃত্রের শরীরে প্রবিষ্ট হইল। ঐ সময় লোকরক্ষণনিরত সৰ্ব্বলোকপূজিত ভগবান্ বিষ্ণুও ইন্দ্রের বর্জ্যে প্রবেশ করিলেন। অনন্তর বুদ্ধিমান বৃহস্পতি, মহাতেজাঃ বশিষ্ঠ ও অন্যান্য পরমর্ষিগণ লোকপূজিত বাসবের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘দেবরাজ! তুমি অবিলম্বে বৃত্রকে জয় কর।’ দেবদেব মহাদেব পুরন্দরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘সুররাজ! এই মহাবলপরাক্রান্ত বৃত্ৰ সৰ্ব্ববেত্তা, সর্ব্বত্রগামী ও বহুমায়াসম্পন্ন। এই দানব তোমার প্রধান শত্রু; অতএব তুমি অচিরাৎ এই ত্রৈলোক্যবিজয়ী অসুররাজকে নিপাতিত কর। ইহাকে অবজ্ঞা করা তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। পূৰ্ব্বে এই অসুর বললাভের নিমিত্ত ষষ্টিসহস্র বর্ষ কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছিল। সেই তপঃপ্রভাবে ব্রহ্মার নিকট বর প্রাপ্ত হইয়া যোগিগণের মহত্ত্ব, মহামায়া, মহাবল ও উৎকৃষ্ট তেজঃ লাভ করিয়াছে। এক্ষণে আমার তেজঃ তোমার দেহে প্রবেশ করিতেছে, তুমি সেই তেজঃপ্রভাবে বজ্ৰদ্বারা অবিলম্বে ইহাকে সংহার কর।’
‘ইন্দ্র কহিলেন, ভগবন! আমি আপনার প্রসাদে আপনার সমক্ষেই এই বজ্ৰদ্বারা এই দুর্দ্ধর্ষ দানবরাজকে নিপাতিত করিব।
“অনন্তর রুদ্রজ্বর বৃত্রের শরীরে প্রবিষ্ট হইল। দেবতা ও ঋষিগণ আহ্লাদিত হইয়া হর্ষধ্বনি করিতে লাগিলেন। দুন্দুভি, শঙ্খ, মুরজ ও ডিণ্ডিম প্রভৃতি সহস্র বাদিত্র বাদিত হইতে লাগিল। ক্ষণমধ্যে সমুদয় অসুরগণের স্মরণশক্তি বিলুপ্ত ও মায়া বিনষ্ট হইয়া গেল। ঐ সময় দেবতা ও ঋষিগণ বৃত্রকে জ্বরাক্রান্ত পরিজ্ঞাত হইয়া দেবদেব মহাদেব ও ইন্দ্রকে বিবিধ প্রকার স্তব করিয়া সুররাজকে যুদ্ধার্থ ত্বরান্বিত করিতে লাগিলেন। সংগ্রামস্থলে ঋষিগণ স্তব করাতে রথারূঢ় মহাত্মা শতক্রতুর রূপ নিতান্ত দুর্লক্ষ্য হইয়া উঠিল।”