২৮০. সনৎকুমারকর্ত্তৃক বিষ্ণুমাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন

২৮০তম অধ্যায়

সনৎকুমারকর্ত্তৃক বিষ্ণুমাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন

“তখন শুক্রাচার্য্য কহিলেন, ‘দানবরাজ! এই ভূমণ্ডল যাঁহার অধ, আকাশমণ্ডল যাঁহার মধ্যভাগ এবং মোক্ষধাম যাঁহার মস্তক, আমি সেই ভগবান নারায়ণকে নমস্কার করিয়া তোমার নিকট তাঁহার অতি উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“দৈত্যাধিপতি বৃত্র ও মহাত্মা শুক্রাচার্য্য উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে ধৰ্ম্মাত্মা সনৎকুমার তাঁহাদিগের সন্দেহভঞ্জনার্থ তথায় সমুপস্থিত হইলেন। অসুরেন্দ্র বৃত্র ও মহাত্মা শুক্রাচার্য্য তাঁহাকে দর্শনমাত্র যথোচিত পূজা করিয়া মহামূল্য আসন প্রদান করিলেন। মহাত্মা সনৎকুমার সেই আসনে আসীন হইলে, শুক্রাচার্য্য তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাত্মন্! আপনি দানবেন্দ্রের নিকট বিষ্ণুমাহাত্ম কীৰ্ত্তন করুন।

“তখন মহাত্মা সনৎকুমার বৃত্রাসুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দৈত্যেন্দ্র! আমি তোমার নিকট বিষ্ণুমাহাত্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘এই বিশ্বসংসার সেই বিষ্ণুতে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। সেই পরমপুরুষ কালসহকারে এই চরাচর ভূতসমুদয়ের পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি ও সংহার করিয়া থাকেন। এই সমুদয় ভূত তাহা হইতেই সম্ভূত এবং তাহাতেই বিলীন হইয়া থাকে। শাস্ত্রজ্ঞান, তপস্যা বা যজ্ঞদ্বারা তাঁহাকে লাভ করা যায় না; কেবল ইন্দ্রিয়সংযমপ্রভাবেই তাঁহাকে লাভ করিতে পারা যায়। যিনি দৃঢ়তর অধ্যবসায়সহকারে নিষ্কাম যজ্ঞ ও শমদমাদি কাৰ্য্যদ্বারা চিত্তসংশোধন করেন, তিনিই পরলোকে মোক্ষপদলাভে সমর্থ হয়েন। সুবর্ণাদি ধাতু যেমন স্বর্ণকারকর্ত্তৃক বারংবার হুতাশনে প্রদত্ত হইয়া পরিশুদ্ধ হয়, তদ্রূপ মনুষ্যগণ বারংবার জন্মপরিগ্রহ করিয়া বিশুদ্ধিলাভ করে। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ একবার মাত্র জন্মপরিগ্রহ করিয়াই পরমাত্নসহকারে কেবল যজ্ঞ ও শমদমাদি কার্য্যপ্রভাবে শুদ্ধি লাভ করিতে পারে। স্বীয় কলেবরস্থ মলমার্জ্জনের ন্যায় যত্নপূৰ্ব্বক দোষসংশোধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যেমন তিলসৰ্ষপাদিতে [তিলতৈলে কিংবা সরিষার তৈলে] একবার অল্পসংখ্যক পুষ্প প্রদান করিলে উহার গন্ধ সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত হয় না; তদ্রূপ এক জন্মে অল্পমাত্র সত্ত্বগুণদ্বারা সমুদয় দোষ দূরীকৃত করা যায় না। আর যেমন তিলসর্ষপাদিতে বারংবার প্রচুর পরিমাণে পুষ্প প্রদান করিলে উহার গন্ধ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হইয়া যায়, তদ্রূপ মানবগণের বারংবার জন্মপরিগ্রহ ও সত্ত্বগুণের আধিক্যদ্বারা স্ত্রীপুত্ৰাদিস্নেহজনিত দোষসমুদয় একবারে নিরাকৃত হয়।

‘হে দানবরাজ! এক্ষণে কৰ্ম্মানুরক্ত ও কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরা যেরূপে কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান এবং যেরূপে কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া থাকে, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর। জন্মত্যুরহিত ভগবান্ নারায়ণ এই চরাচর বিশ্বসংসারের সৃষ্টি করিয়া থাকেন। তিনি সৰ্ব্বভূতমধ্যে দেহ ও জীবরূপে বিরাজিত রহিয়াছেন এবং একাদশ ইন্দ্রিয়স্বরূপ হইয়া এই জগৎ উপভোগ করিতেছেন। তাঁহার পদযুগল পৃথিবী, মস্তক, স্বর্গ, চারি বাহু চারি দিক্‌, কর্ণ আকাশ, চক্ষু সূৰ্য্য, মন চন্দ্র, বুদ্ধি জ্ঞান এবং রসনা সলিলরূপে অবস্থান করিতেছে। গ্রহসমুদয় তাঁহার দেশে ও ধর্ম্ম তাঁহার হৃদয়ে সন্নিহিত রহিয়াছে। নক্ষত্রসমুদয় তাঁহার নেত্র হইতে এবং সত্ত্ব, রজ ও তম এই গুণত্রয়ও তাহা হইতে সম্ভূত হইয়াছে। তিনি সমুদয় আশ্রম, জপাদি কৰ্ম্ম ও সন্ন্যাসধর্ম্মের ফলস্বরূপ। তাঁহার রোমসমুদয় ছন্দঃ ও বাক্য প্রণব। তিনি সমুদয় আশ্রমের আশ্রয়। তাঁহার মুখ সৰ্ব্বত্র বিরাজিত রহিয়াছে। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই পরম ধৰ্ম্ম, তপস্যা, সৎ ও অসৎকাৰ্য্য, মন্ত্র, শাস্ত্র, যজ্ঞপাত্র, ষোড়শ ঋত্বিক্‌যুক্ত যজ্ঞ, তিনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, অশ্বিনীকুমার, পুরন্দর, মিত্র, বরুণ, যম ও কুবেররূপে অবস্থান করিতেছেন। ঋত্বিকগণ তাঁহাকে ইন্দ্র-মহেন্দ্রাদিরূপে ভিন্ন ভিন্ন। দর্শন করিয়াও অদ্বিতীয় বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন। এই সমুদয় জগৎ সেই অদ্বিতীয় ভগবান্ নারায়ণেরই অধীনে অবস্থান করিতেছে। বেদে তাঁহাকেই এই বিবিধ ভূতগ্রামের একমাত্র কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। জীবগণ যখন জ্ঞানপ্রভাবে সমুদয় সেই নারায়ণময় অবলোকন করে, তখনই তাহাদিগের ব্রহ্মজ্ঞানের আবির্ভাব হয়।

গুণভেদে বর্ণভেদ-গুণানুরূপ বর্ণ

‘স্থাবর জীবগণ সহস্র-কোটি কল্পকাল অবস্থান ও জঙ্গম জীবেরা তাবৎকাল সঞ্চরণ করিতেছে। এক যোজন বিস্কৃত, পাঁচ শত যোজন দীর্ঘ ও এক ক্রোশ গভীর সহস্র সহস্র দীর্ঘিকার জল প্রতিদিন একবারমাত্র কেশাগ্রভাগদ্বারা নিক্ষেপ করিলে তৎসমুদয় যত দিনে শুষ্ক হয়, তত দিনে সমুদয় প্রজার একবার সৃষ্টি ও একবার সংহার হইয়া থাকে। জীবগণের বর্ণ ছয় প্রকার—কৃষ্ণ, ধূম্র, নীল, রক্ত, হারিদ্র [হরিদ্রাবর্ণ—হলুদের বর্ণ] ও শুক্ল। এই সমস্ত বর্ণ উত্তরোত্তর উৎকৃষ্ট ও সুখসম্পাদক। তমোগুণের প্রাধান্যে কৃষ্ণবর্ণ অর্থাৎ স্থাবরযোনি, রজ ও তমোগুণের প্রাধান্যে ধূম্রবর্ণ অর্থাৎ তির্য্যগযোনি, রজোগুণের প্রাধান্যে নীলবর্ণ অর্থাৎ মনুষ্যযোনি, রজ ও তত্ত্বগুণের প্রাধান্যে রক্তবর্ণ অর্থাৎ প্রাজাপত্য [ব্রহ্মদির বর্ণ], সত্ত্বপ্রাধান্যে হারিদ্রবর্ণ অর্থাৎ দেবত্ব এবং কেবল বিশুদ্ধসত্ত্বগুণপ্রভাবে শুক্লবর্ণ অর্থাৎ জীবন্মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। শুক্লবর্ণপ্রভাবেই জীব নিষ্পাপ, বিগতশোক ও শ্রমবিহীন হইয়া সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকে। কিন্তু উহা নিতান্ত দুর্ল্লভ। কেন না, জীব সহস্র সহস্রবার জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক শুভপ্রদ শাস্ত্র অবগত হইয়া পরিশেষে সেই শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট আত্মানুভবাত্মিকা [আত্মানুভবময়ী-আত্মার অনুভূতিসমন্বিতা] গতি লাভ করিয়া থাকে। গতি শুক্লাদি বর্ণের এবং বর্ণ সত্যাদিকালের প্রভাবেই হইয়া থাকে। শুক্ল ভিন্ন অন্যান্য বর্ণসমুদয়ের গতি চতুর্দ্দশ প্রকার। ঐ চতুর্দ্দশ প্রকার গতির আবার অসংখ্য অবান্তরভেদ আছে। গুণপ্রভাবেই জীবের উন্নতলোকে আরোহণ, অবস্থান ও তথা হইতে অবরোহণ হইয়া থাকে। কৃষ্ণবর্ণের গতি অতি নিকৃষ্ট। ঐ বর্ণপ্রভাবে জীব নরকে বাস ও লক্ষ লক্ষ বৎসর নরকযন্ত্রণা ভোগ করিয়া পশ্চাৎ ধূম্রবর্ণ প্রাপ্ত হয়। ঐ ধূম্রবর্ণের প্রভাবে জীবকে শীতোষ্ণাদি সহ্য করিয়া কালযাপন করিতে হয়। পরিশেষে পাপক্ষয় হইলে উহার চিত্তে বৈরাগ্য উপস্থিত হইয়া থাকে। তখন সেই জীব নীলবর্ণ লাভ করে। যখন তাহার সত্ত্বগুণের উদ্রেক হয়, তখন সে তমোগুণবিমুক্ত ও রক্তবর্ণ প্রাপ্ত হইয়া আপনার বুদ্ধিপ্রভাবে শ্রেয়োলাভাৰ্থ যত্নসহকারে মনুষ্যলোকে পরিভ্রমণ করে। তৎপরে সে এক কল্প পুণ্যপাপশৃঙ্খলে বদ্ধ হইয়া পশ্চাৎ হারিদ্ৰবৰ্ণ প্রাপ্ত হয়। তৎপরে শত কল্প দেবত্ব ভোগ করিয়া পুনরায় মনুষ্যত্ব লাভ করিয়া থাকে। পরে সেই মনুষ্যযোনি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পুনরায় দেবত্ব লাভ করিয়া অসংখ্য কল্পস্বর্গে বাস করিয়া থাকে। তৎপরে ক্রমে ক্রমে একবিংশতি সহস্র গতি লাভ করিয়া পরিশেষে ভোগপ্রদ কৰ্ম্মসমুদয় হইতে বিমুক্ত হয়। মনুষ্যের ন্যায় সকল যোনিরই উত্তরোত্তর উন্নতি ও অধোগতি হইয়া থাকে। জীব সতত দেবলোকে বিহার করিয়া পশ্চাৎ মনুষ্যত্ব লাভ করে এবং অষ্ট কল্প সেই মনুষ্যদেহে সকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে বিমুক্ত হয়। যদি জীব কালসহকারে দেবত্ব হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া পুনরায় পাপাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাকে নিকৃষ্ট কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্ত হইতে হয়।

গুণভেদে গতিভেদ—গুণানুসারিণী গতি

‘হে দানবরাজ! এক্ষণে জীব যেরূপে সিদ্ধিলাভ করে, তাহা

সবিশেষ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জীব সাতশত দৈবকল্প রক্ত, হারিদ্র ও শুক্লবর্ণ ভোগ করে। মহাত্মারা শুক্লবর্ণ লাভ করিয়া মনোভিলাষলভ্য অসংখ্য লোকে গমন করিয়া থাকেন। শুক্লবর্ণের গতি জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন হইতে ভিন্ন। জীব যোগেশ্বৰ্য্যভোগে আসক্ত হইলে তাহাকে এক কল্প মহর্লোক প্রভৃতি চারি লোকে বাস করিতে হয়। ঐ কল্প অতীত হইলেই তাঁহার মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। যিনি অনুরাগাদি দোষশূন্য হইয়াও ব্রহ্মসাক্ষাৎকার করিতে না পারিয়া যোগেশ্বৰ্য্য হইতে পরিভ্রষ্ট হয়েন, তিনি একশত কল্প ভূঃ প্রভৃতি সপ্ত [ভুঃ ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জন, তপঃ ও সত্য] লোকে বাস করিয়া পরিশেষে তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া পুনরায় মনুষ্যযোনি পরিগ্রহপূৰ্ব্বক মহত্ত্ব লাভ করেন। অনন্তর সেই মর্ত্যলোক হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া পুনরায় উত্তরোত্তর উৰ্দ্ধতন লোকে গমনপূর্ব্বক সাতলোক অতিক্রম করিয়া থাকেন। ঐ সকল অতিক্রম করিবার সময় লোকসমুদয়ের বারংবার জন্মমৃত্যুদর্শনে তাঁহার বৈরাগ্য উপস্থিত হয়। তখন তিনি ঊর্ধ্বতন লোকসমৃদয়ও অনিত্য বোধ করিয়া ঐ সমুদয়ে অনাদর প্রদর্শনপূৰ্ব্বক জীবলোকেই অবস্থান করেন। তৎপরে তাঁহার অক্ষয় অসীম লোক লাভ হয়।

‘ঐ লোককে কেহ কেহ মহাদেবের, কেহ কেহ বিষ্ণুর, কেহ কেহ ব্রহ্মার, কেহ কেহ অনন্তের, কেহ কেহ নরের ও কেহ কেহ ব্রহ্মের বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। সাধুব্যক্তি মুক্তিলাভ কালে ইন্দ্রিয়সমুদয় ও প্রকৃতি প্রভৃতির সহিত স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর ভস্মীভূত করিয়া ব্রহ্মলাভ করেন। জীবগণ জন্মলাভ করিয়া স্ব স্ব কৰ্ম্মানুসারে স্ব স্ব নির্দ্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে; পরিশেষে প্রলয়কালে তাঁহাদিগকে প্রকৃতির সহিত ব্রহ্মে প্রবেশ করিতে হয়। ঐ সকল মধ্যে যে মহাত্মারা সিদ্ধলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হয়েন, তাঁহারা প্রলয়কালেও ঐ লোক লাভ করিয়া থাকেন। ব্রহ্মবিৎ পঞ্চেন্দ্রিয় সংযমপূর্ব্বক বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া সুখদুঃখে হৃষ্ট ও ব্যথিত হইয়া যতকাল ইহলোকে অবস্থান করেন, তাবৎকাল তাঁহার শরীরে বেদবিদ্যা ও ব্রহ্মবিদ্যা অবস্থান করিয়া থাকে। ঐ সময় তাঁহাকে জীবন্মুক্ত ও সৰ্ব্বময় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।

বৃত্রাসুরের বৈষ্ণবী গতি

মনুষ্য প্রথমতঃ বিশুদ্ধ মনদ্বারা অনুসন্ধান করিয়া সেই বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপ ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ করে এবং পরিশেষে অন্যের নিতান্ত দুর্লভ মোক্ষস্বরূপ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়। হে দৈত্যরাজ! এই আমি তোমার নিকট নারায়ণের মাহাত্ম্য ও মোক্ষের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম।

“সনৎকুমার এই কথা কহিলে দানবরাজ বৃত্র তাঁহাকে কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি যাহা কীৰ্ত্তন করিলেন, তৎসমুদয়ই যথার্থ। এই বিশ্বসংসার অলীক বলিয়াই আমি বিষণ্ন হইতেছি না। যাহা হউক, এক্ষণে আপনার বাক্যশ্রবণে আমি নিষ্পাপ ও শোকমোহবিহীন হইলাম। ভগবান্ নারায়ণের এই অনন্ত কালচক্র নিয়তই বিদ্যমান রহিয়াছে। ঐ চক্রপ্রভাবেই সমুদয় পদার্থ সৃষ্টি হইতেছে। তিনি পুরুষোত্তম এবং তাঁহাতেই এই জগৎসংসার প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। দৈত্যাধিপতি বৃত্র এই কথা কহিয়া পরমব্রহ্মে আত্মসংযোজনপূর্ব্বক প্রাণপরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিলেন।”

কৃষ্ণ কি নারায়ণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! পূৰ্ব্বকালে মহর্ষি সনৎকুমার বৃত্রাসুরের নিকট যে নারায়ণের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, এই কৃষ্ণই কি সেই ভগবান নারায়ণ?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সেই সর্ব্বাশয় চৈতন্যস্বরূপ পরব্রহ্ম স্বীয় অসীম তেজঃপ্রভাবে নানা রূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন। এই মহাত্মা কেশব তাঁহারই অষ্টমাংশস্বরূপ এবং এই ত্রিলোক তাঁহারই অষ্টমাংশ হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছে। কল্পান্তকালে বিরাট পুরুষেরও ধ্বংস হয়; কিন্তু কেবল ভগবান ঐ সময়ে সলিলশয্যায় শয়ন করিয়া থাকেন। প্রলয়কালে লোকসমুদয় বিনষ্ট হইলে, এই অনাদিনিধন কেশব পুনরায় জগতের সৃষ্টি করিয়া সমুদয় পরিপূর্ণ করেন। ফলতঃ এই বিচিত্র বিশ্ব ইঁহাতেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে।”

কৰ্ম্মর্গতিভীত যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মের আশ্বাস

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আমার বোধ হয়, দানবরাজ বৃত্র স্বয়ং আপনার সদগতি সন্দর্শন করিয়াছিলেন বলিয়াই কিছুমাত্র শোকপ্রকাশ করেন নাই; প্রত্যুত সৰ্ব্বদাই সুখে অবস্থান করিতেন। যাঁহারা শুক্লবর্ণে অবস্থিত, শুদ্ধবংশসত ও সিদ্ধ, তাঁহারাই তিৰ্য্যগযোনি ও নরক হইতে নির্ম্মুক্ত হইয়া থাকেন। তাঁহাদিগকে পুনরায় আর জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না। যাঁহারা হারিদ্র ও রক্তবর্ণে অবস্থান করেন, তাঁহাদিগকেও কখন কখন দুর্দ্দেবনিবন্ধন তামসিক কার্য্যে আসক্ত হইয়া তির্য্যগ্‌যোনি লাভ করিতে হয়। যাহা হউক, আমরা সুখদুঃখে একান্ত আসক্ত রহিয়াছি; সুতরাং আমাদিগকে কৃষ্ণ বা সৰ্ব্বাপেক্ষা অপকৃষ্ট এই উভয়ের অন্যতর গতি লাভ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তোমরা শংসিতব্রত ও বিশুদ্ধ পাণ্ডবংশসম্ভূত। অতএব তোমরা দেবলোকে গমন করিয়া পুনরায় মত্তভূমিতে আগমন করিবে এবং তৎপরে পুনরায় দেবলোক গমনপূৰ্ব্বক সুখসম্ভোগ করিয়া পরিশেষে সিদ্ধপুরুষমধ্যে গণনীয় হইবে। তোমাদের ভীত হইবার প্রয়োজন নাই; সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত কর।”