বদ্ধের গহনকানন—মুক্তের আনন্দকানন
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘প্রিয়ে! এক্ষণে আমি সঙ্কল্পরূপ দংশমশকম্পন্ন, শোকহর্ষরূপী শীততাপযুক্ত মোহরূপ তিমির পরিপূর্ণ এবং লোভ ও ব্যাধিরূপ সরীসৃপে সমাকীর্ণ সংসাররূপ অরণ্য অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মরূপ মহাবনে প্রবেশ করিয়াছি। ঐ সংসারারণ্যের পথে কাম ও ক্রোধরূপ দুইটি শত্ৰু সতত অবস্থান করিয়া থাকে এবং উহাতে একাকীই গমনাগমন করিতে হয়।
“ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘নাথ! আপনি যে মহাবনের কথা উল্লেখ করিলেন, সেই বন কোথায়? ঐ বনে কিরূপ বৃক্ষ, নদী ও পৰ্ব্বত সমুদয় বিদ্যমান রহিয়াছে এবং কতদূর গমন করিলেই বা ঐ বন উপলব্ধ হইয়া থাকে?
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, প্রিয়ে! ঐ বন হইতে স্বতন্ত্র ও অস্বতন্ত্র, হ্রস্ব ও দীর্ঘ এবং সুখকর ও দুঃখজনক পদার্থ কিছুই নাই। ব্রাহ্মণেরা ঐ বনে প্রবেশ করিতে পারিলে তাঁহাদের আর শোক বা হর্ষের লেশমাত্র থাকে না। তৎকালে তাঁহারা আর কাহার হইতেও ভীত হয়েন না এবং তাহাদিগের হইতেও কেহ ভয় প্রাপ্ত হয় না। ঐ বনমধ্যে অহঙ্কার প্রভৃতি সাতটি মহদবৃক্ষ বিদ্যমান আছে। শব্দ, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংশয় ও নিশ্চয় এই সাতটি ঐ বৃক্ষ সমুদয়ের ফল; ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাত্রী সপ্ত দেবতা ঐ সমুদয় ফলভক্ষক অতিথি; মন, বুদ্ধি ও কর্ণনেত্রাদি পঞ্চেন্দ্রিয় ঐ অতিথিদিগের আশ্রয় এবং ঐ সপ্তবিধ ফলভোগজনিত দুঃখ সপ্তবিধ দীক্ষাস্বরূপ।
‘ঐ বনমধ্যে আরও কতকগুলি বৃক্ষ বিদ্যমান আছে। তন্মধ্যে মনোরূপ পাদপ, শব্দাদির অনুভবরূপ পঞ্চবিধ পুষ্প ও তজ্জনিত প্রতিরূপ পঞ্চবিধ ফল; চক্ষুরূপ বৃক্ষ, শ্বেতপীতাদি বর্ণরূপ পুষ্প ও তদ্দর্শনজনিত সুখদুঃখরূপ ফল; বিহিত-নিষিদ্ধ কাৰ্য্যরূপ বৃক্ষ, পুণ্যকল্পরূপ পুষ্প ও স্বৰ্গনরকরূপ ফল; ধ্যানরূপ বৃক্ষ, সুখরূপ পুষ্প ও ফল এবং মন ও বুদ্ধিরূপ বৃক্ষদ্বয় মন্তব্য ও বোদ্ধব্যরূপ বহুসংখ্যক পুষ্প ও ফল উৎপাদন করিতেছে। ঐ বনে জীবাত্মারূপ ব্রাহ্মণ মন ও বুদ্ধিরূপ স্রুক ও স্রুব গ্রহণপূৰ্ব্বক পঞ্চ ইন্দ্রিয়রূপ সমিধ আহুতি প্রদান করিয়া থাকেন। ঐ সমুদয় সমিধ আহুত হইয়া লয়প্রাপ্ত হইলেই মোক্ষ আবির্ভূত হয়। ঐ যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় জীবাত্মারূপ ব্রাহ্মণ যে দীক্ষা গ্রহণ করেন সেই দীক্ষাও নিষ্ফল হয় না। ঐ দীক্ষার ফল পুণ্য, কিন্তু ঐ পুণ্য যজ্ঞকারী জীবাত্মাকে ভোগ করিতে হয় না; ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতারা বা ঐ যজ্ঞদীক্ষিত ব্যক্তির আত্মীয়গণই উহা ভোগ করিয়া থাকেন। ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণ ঐ দীক্ষার ফলরূপ পুণ্য ভোগ করিয়া, লয়প্রাপ্ত হইলে পরিশেষে নিরুপাবি ব্রহ্মরূপ মহাবন সুপ্রকাশিত হয়।
‘ঐ বনে আত্মসাক্ষাৎকাররূপ বৃক্ষ মোক্ষরূপ ফল ও শান্তিরূপ ছায়া উৎপাদন করিয়া থাকে। শাস্ত্রজ্ঞান ঐ বনে আশ্রয়স্থান ও তৃপ্তি উহার জলপূর্ণ জলাশয়স্বরূপ। আত্মা ভাস্কররূপে সতত ঐ বন প্রকাশিত করিয়া থাকেন। ঐ বনে গমন করিলে ভয়ের লেশমাত্রও থাকে না। ঐ বন সৰ্ব্বব্যাপী; উহার অন্ত নাই। ঘ্রাণাদি বৃত্তিরূপ সাতটি স্ত্রী পৃথিবীর অন্যান্য ব্যক্তিগণকে অনায়াসে। বশীভূত করিয়া থাকে; কিন্তু ঐ বনপ্রবিষ্ট ব্যক্তিদিগকে কিছুতেই বিচলিত করিতে পারে না। উহারা ঐ মহাত্মাদিগের নিকট সহসা সমুপস্থিত হইয়া, কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারিয়া লজ্জায় অধোমুখে অবস্থান করে। ঐ মহাত্মাদিগের ইচ্ছানুসারে ঘ্রাণাদি পঞ্চেন্দ্রিয় এবং মনঃ ও বুদ্ধি ইহারা ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান পদার্থ সমুদয়ের সহিত সমুদিত ও লয়প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ঐ মহাত্মারা কি যশস্বী, কি দীপ্তিশীল, কি ঐশ্বর্য্যশালী, কি বিজয়ী, কি সিদ্ধ, কি তেজস্বী সকলকেই আত্মাতে দর্শন করিয়া থাকেন। উহাদের অতি নিগূঢ় হৃদয়াকাশে উপদেশরূপ পর্ব্বত হইতে জ্ঞানরূপ নদী-প্রবাহ প্রবাহিত হইয়া পরব্রহ্মে সঙ্গত হইয়া থাকে। উহারা ঐ প্রবাহ অবলম্বন করিয়া সাক্ষাৎ ব্রহ্মকে লাভ করিয়া থাকেন। ফলতঃ যাঁহাদিগের বিষয়বাসনা নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া যায়, যাঁহারা তপঃপ্রভাবে সমুদয় পাপ দগ্ধ করিয়া থাকেন এবং যাঁহারা সতত শান্তিলাভেই অভিলাষী হয়েন, তাঁহারাই বুদ্ধির সাহায্যে পরমাত্মাতে জীবাত্মাকে লীন করিয়া পরব্রহ্মের উপাসনা করিতে পারেন।
‘হে প্রিয়ে! শাস্ত্রে এইরূপ ব্রহ্মবন নির্দ্দিষ্ট আছে। পণ্ডিতগণ শাস্ত্রলোচনাদ্বারা ঐ বনের বিষয় সবিশেষ অবগত হইয়া তত্ত্বদর্শী ব্যক্তির উপদেশানুসারে উহাতে প্রবেশ করিয়া থাকেন।