২৭৯তম অধ্যায়
সীতবিরহে রামের বিলাপ—লক্ষ্মণের সান্ত্বনা
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর দাশরথি অনতিদূরবতী প্ৰফুল্লাৎপলশালী সুরম্য পম্পী-সরোবরে উপনীত হইলেন। তাহার সুশীতল সুখকর সমীরণ সেবন করিতে করিতে র্ত্তাহার অন্তঃকরণে জানকীবিরহ উদ্দীপিত হইল। তখন তিনি মদনবাণে একান্ত আহত হইয়া অতীত বৃত্তান্তের অনুশোচনা করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে লক্ষ্মণ র্ত্তাহাকে জানকীবিরহে নিতান্ত কাতর দেখিয়া প্ৰবোধবাক্যে কহিলেন, “আৰ্য্য! যেমন ব্যাধি বৃদ্ধমতানুযায়ী বিজ্ঞ মনুষ্যকে আক্রমণ করিতে পারে না, তদুপ এবংবিধ বিরূপ ভােব আপনাকে স্পর্শ করিতে কদাচি সমর্থ হয়। না; অতএব আপনার শোকাকুল হওয়া অনুচিত। আপনি জানকী ও রাবণের বার্ত্তা অবগত আছেন; এক্ষণে বুদ্ধি, বল ও পৌরুষ প্রকাশপূর্ব্বক সীতাদেবীর উদ্ধারসাধনে যত্নবান হউন। আসুন, আমরা পর্ব্বতবাসী কপিবর সুগ্ৰীবের নিকট গমন করি। আমি আপনার শিষ্য, ভূত্য ও সহায়, আমি বিদ্যমান থাকিতে আপনার নিরাশ্বাস হওয়া কোনক্রমেই উচিত নহে।”
ঋষ্যমুকশৈলে সুগ্ৰীবসন্নিধানে রাম-লক্ষ্মণের গমন-তৎসহ মৈত্রী
“অনন্তর রাঘব প্রকৃতিস্থ হইয়া সমস্ত কর্ত্তব্যকার্য্য পর্য্যালোচনা করিতে লাগিলেন। তখন তাঁহারা সেই সরোবরে অবগাহন ও পিতৃগণের তর্পণ করিয়া ঋষ্যমূকাভিমুখে গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া গিরিশিখরবাসী মহাবীর পঞ্চবানরকে নিরীক্ষণ করিলে কপিবর সুগ্ৰীব হিমাচলের ন্যায় উন্নত নিজ মন্ত্রী ধীমান হনুমানকে তাহাঁদিগের নিকট প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা হনুমানকে সম্ভাষণপূর্ব্বক তাঁহার সহিত কপিরাজ সুগ্ৰীবের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি রামের সহিত মৈত্রভাব সংস্থাপন করিলেন।
“অনন্তর রাম কপিগণের নিকট নিজ বৃত্তান্ত বর্ণন করিলে তাহারা সীতাদেবী হরণকালে পর্ব্বতোপরি যে বস্ত্ৰ নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাঁহা তাহার নেত্ৰগোচর করিলেন। রাম প্রত্যয়কর সেই অভিজ্ঞান লাভ করিয়া সুগ্ৰীবকে পৃথিবীস্থ বানরগণের অধিপতি করিয়া দিলেন এবং “আমি মহাবল বালীকে বধ করিব।” এই বলিয়া তাঁহার নিকট অঙ্গীকার করিলেন; সুগ্ৰীবও সীতাদেবীর উদ্ধারসাধনে প্রতিশ্রুত হইলেন।
“তাঁহারা এইরূপ পরস্পর বচনবদ্ধ হইয়া বিশ্বস্তমনে যুদ্ধার্থ কিষ্কিন্ধ্যা আক্রমণ করিলে সুগ্ৰীব মুহুর্মুহুঃ সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। বালী এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া ক্ৰোধাভরে যুদ্ধার্থ নিৰ্গত হইতেছেন, ইত্যবসরে সুগ্ৰীবপত্নী তারা তাঁহাকে তদ্বিষয়ে নিষেধ করিয়া কহিল, “মহারাজ! যখন মহাবলপরাক্রান্ত সুগ্ৰীব সিংহনাদ করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই বোধ হয়, সে অন্য কোন জীবের আশ্রয়লাভ করিয়া উপস্থিত হইয়া থাকিবে; অতএব এক্ষণে যুদ্ধাৰ্থ নিষ্ক্রান্ত হইও না।” তখন হেমমালী বালী প্রিয়তমা তারাকে কহিলেন, “প্রিয়ে! তুমি ত’ বুদ্ধিবলে সকল প্রাণীরই কণ্ঠস্বর অনুধাবন করিতে পার, অতএব আমার ভ্রাতা সুগ্ৰীব কাহার আশ্রয় লাভ করিয়াছে, বলিয়া দাও।”
“অনন্তর তারা মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া মহাবীর বালীকে কহিল, মহারাজ! হৃতদার দাশরথি সুগ্ৰীবের সহিত তুল্যাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া মিত্ৰতা সংস্থাপন করিয়াছেন, সুতরাং সুগ্ৰীবের মিত্র তাঁহার মিত্র ও সুগ্ৰীবের শত্রু তাঁহার শত্রু। আর উঁহার ভ্রাতা লক্ষ্মণ সুগ্ৰীবের কাৰ্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত একান্ত যত্নবান আছেন এবং মৈন্দ, দ্বিবিদ, হনুমান ও ঋক্ষরাজ জাম্ববান ইঁহারা সুগ্ৰীবের মন্ত্রি। ইঁহারা সকলেই মহাবলপরাক্রান্ত ও বুদ্ধিমান; বিশেষতঃ রামবলবীর্য্যের আশ্রয় করিয়া তোমার বিনাশে অবশ্যই কৃতকাৰ্য্য হইবেন।” তখন বালী তারার হিতবাক্যে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক ঈর্ষাবশে তাহাকে সুগ্ৰীবানুরাগিণী মনে করিয়া বারংবার ভৎসনাপূর্ব্বক সত্বর গুহা হইতে নিৰ্গত হইলেন এবং মাল্যবান পর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী সুগ্ৰীবকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, ‘রে দুরাচার! আমি পূর্ব্বে তোকে বারংবার পরাজয় করিয়া জ্ঞাতিবোধে পরিত্যাগ করিয়াছি; এক্ষণে পুনর্ব্বার মৃত্যু ইচ্ছা হইয়াছে কেন?” তখন সুগ্ৰীব কহিলেন, “হে মহারাজ! তুমি আমার ভাৰ্য্যা ও রাজ্য অপহরণ করিয়াছ, সুতরাং আমার জীবনের আর গৌরব কি? এই জন্যই আমি পুনরায় আগমন করিয়াছি।”
বালী-সুগ্ৰীবের যুদ্ধ-বালিবধ
“এইরূপ কথোপকথনানন্তর বালী ও সুগ্ৰীব শাল, তাল ও শিলা গ্রহণপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা পরস্পর প্রহার, ভূতলে পাতিত ও মুষ্ট্যাঘাত করিয়া বিচিত্র লম্ফ প্ৰদান করিতে লাগিলেন। তাঁহারা উভয়ে পরস্পর নখ-দন্ত প্রহার দ্বারা রুধিরাক্তকলেবর হইয়া পুম্পিত কিংশুকপাদপের ন্যায় শোভিত হইলেন। সেই ঘোরতর যুদ্ধে যখন বালী ও সুগ্ৰীবের আকারগত কোন ইতরবিশেষ লক্ষিত হইল না, তখন হনুমান সুগ্ৰীবের কণ্ঠদেশে মাল্য প্রদান করিলেন। যেমন মেঘমালাদ্বারা মহাশৈল মলয় শোভিত হয়, তদ্রূপ মহাবীর সুগ্ৰীব হনুমৎ-প্রদত্ত মাল্যদ্বারা শোভমান হইলেন।
“তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ রাম সেই মাল্যদ্বারা সুগ্ৰীবকে চিনিতে পারিয়া বালীকে লক্ষ্য করিয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক বাণ পরিত্যাগ করিলেন। মহাবীর বালী রামের দারুণ শরে বিদ্ধহৃদয় হইয়া রক্ত বমনপূর্ব্বক লক্ষ্মণসমবেত রামকে আবলোকন করিলেন এবং তাঁহাকে ভৎসনা করিতে করিতে মুর্ছিত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন তারা তারাপতিসদৃশ ভূতলশায়ী স্বীয় পতিকে নিরীক্ষণ করিয়া শোকসাগরে মগ্ন হইল।
“এইরূপে বালী নিহত হইলে পর সুগ্ৰীব কিষ্কিন্ধ্যারাজ্য ও পূর্ণেন্দুমুখী তারাকে প্রাপ্ত হইলেন; রামও সুগ্ৰীবকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া চারি মাস মাল্যবান-পর্ব্বতের উপর অধিবাস করিলেন।
সীতার অশোকবনে বাস-বিবিধ বিলাপ
“এদিকে রাবণ লঙ্কাপুরীগমনপূর্ব্বক তাপসাশ্রমসদৃশ অশোকবনসমীপবর্ত্তী নন্দনোপম ভবনে জানকীকে নিবেশিত করিলেন। ভর্ত্তৃস্মরণকৃশাঙ্গী তাপসীবেশধারিণী পৃথুলোচনা জানকী সেই স্থানে ফলমূলাশনে জীবনধারণপূর্ব্বক অতিকষ্টে বাস করিতে লাগিলেন। রাক্ষসাধিপতি তাঁহার রক্ষার নিমিত্ত প্রাস, অসি, শূল, পরশু, মুদগর ও অলাতধারিণী কতকগুলি রাক্ষসীকে নিযুক্ত করিলেন; তাহাদিগের মধ্যে কেহ দ্বিনেত্ৰা, কেহ ত্ৰিনেত্ৰা, কেহ বা ললাটনেত্ৰা; কাহারও বা দীর্ঘ জিহ্বা, কাহারও বা জিহ্বার চিহ্নমাত্ৰ নাই, কাহারও বা তিন স্তন, কাহারও বা এক পদ, কাহারও বা তিনটিমাত্ৰ জটা, কাহারও বা এক লোচন, কাহারও প্ৰজ্বলিত চক্ষু, কাহারও বা কেশকলাপ পিঙ্গলবর্ণ ও রুক্ষ; তাহারা দিবারাত্র অতন্দ্রিত হইয়া সীতাকে বেষ্টন করিয়া থাকিত এবং সর্ব্বদা পরুষবাক্যে “ভক্ষণ করিব, সংহার করিব, তিল তিল করিয়া খণ্ড খণ্ড করিব, এ আমাদের স্বামীকে অবমাননা করিয়াও জীবিত রহিয়াছে” এই বলিয়া তর্জ্জন ও ভৎসনা করিত।
“পতিশোকবিধুরা জানকী তাহাতে অতি ভীত হইয়া পুনঃ পুনঃ দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, “আৰ্য্যাগণ! আমাকে শীঘ্ৰ ভক্ষণ কর, আমার জীবনে কিছুমাত্র যত্ন নাই, আমি সেই নীলকুঞ্চিতকেশরাজীবলোচন প্ৰাণবল্লভবিরহে তালগত সর্পীর ন্যায় নিরাহারে শরীর শোষণ করিব। তোমরা নিশ্চিতই জানিও, আমি সেই রাঘব ব্যতীত অন্য পুরুষের মুখাবলোকন করিব না। ইহার পর যাহা কর্ত্তব্য থাকে, কর।”
ত্রিজটা-রাক্ষসীর সীতা-সান্ত্বনা
“রাক্ষসীগণ তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া রাক্ষস পতিকে তৎসমুদয় নিবেদন করিবার নিমিত্ত তথা হইতে প্ৰস্থান করিলে, ত্ৰিজয়ানামী প্রিয়বাদিনী এক রাক্ষসী তাঁহাকে সান্ত্বনাপূর্ব্বক কহিল, ‘সখি জানকি! আমাকে কিঞ্চিৎ বিশ্বাস কর, ভয় ত্যাগ করিয়া আমার বাক্য শ্রবণ কর। অবিন্ধ্যনামে একটি মেধাবী বৃদ্ধ রাক্ষস আছেন, তিনি রামের হিতান্বেষা, তিনি তোমার নিমিত্ত আমাকে কহিলেন, তুমি আমার বাক্যে সীতাকে আশ্বাসিত ও প্রসন্ন করিয়া কহিবে, তোমার ভর্ত্তা রাম এবং বলবান লক্ষ্মণ কুশলে আছেন, তিনি তোমার নিমিত্ত সচেষ্ট হইয়া শক্ৰসমতেজাঃ বানররাজ সুগ্ৰীবের সহিত সখ্যবন্ধন করিয়াছেন, হে ভীরু! লোকবিনিন্দিত রাবণ হইতে ভীত হইও না; তুমি নলকুবরশাপে সুরক্ষিত হইবে। পাপাত্মা রাবণ পূর্ব্বে রম্ভা-বধূকে বলপূর্ব্বক গ্রহণ করাতে এইরূপ অভিশপ্ত হইয়াছে যে, কোন অবশীভুত রমণীকে গ্ৰহণ করিতে সমর্থ হইবে না। তোমার ভর্ত্তা এবং সৌমিত্রি সুগ্ৰীবসহায় হইয়া শীঘ্র আগমনপূর্ব্বক তোমার উদ্ধার করিবেন। অদ্য আমি দুরাত্মা রাবণের সংহারসূচক এই ভয়ানক স্বপ্ন দর্শন করিয়াছি যে, দুষ্টাত্মা নিশাচর দেবগণকর্ত্তৃক স্পৰ্দ্ধিত ও কালোপহতচেতন হইয়া গর্দ্দভযুক্ত রথে নৃত্য করিতেছে, কুম্ভকৰ্ণাদি-রাক্ষসগণ নগ্ন, মুণ্ডিতমস্তক, রক্তমাল্যবিভূষিত হইয়া দক্ষিণ অভিমুখে গমন করিতেছে; বিভীষণ একাকী শ্বেতাতপত্র-উষ্ণীষধারী ও শুক্ল-মাল্যানুরঞ্জিত হইয়া শ্বেতপর্ব্বতে আরোহণ করিয়াছে, তাঁহার চারিজন মন্ত্রি শুক্লমাল্যধারী, শুক্লানুলেপনে অনুলিপ্ত ও শ্বেতপর্ব্বতারূঢ় হইয়া এই মহাভয় হইতে মুক্ত হইয়াছেন, সসাগরা পৃথিবী রামের অস্ত্রে পরিক্ষিপ্ত হইয়াছে এবং তোমার স্বামীর যশে পৃথিবী পরিপূর্ণ হইয়াছে। লক্ষ্মণ দশদিক দাহ করিয়া অস্থিরাশিতে আরোহণপূর্ব্বক মধু ও পায়স ভোজন করিতেছেন এবং তোমার সমুদয় শরীর রুধিরে আর্দ্র হইয়াছে ও একটি ব্যাঘ্র তোমাকে রক্ষা করিতেছে; অতএব হে মৃগশাবাক্ষি! তুমি অচিরকাল মধ্যে স্বামীর সহিত সমাগত হইয়া আনন্দিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“ত্ৰিজটার বাক্য শ্রবণ করিয়া জনকনন্দিনী সীতার পুনরায় ভর্ত্তৃসমাগমের আশা বলবতী হইয়া উঠিল। অনন্তর সেই সকল নিশাচরীগণ আগমনপূর্ব্বক দেখিল যে, সীতা ত্ৰিজটাসমভিব্যাহারে পূর্ব্বের ন্যায় উপবেশন করিয়া আছেন।”