২৭৮তম অধ্যায়
রাবণের সহিত জটায়ুর যুদ্ধ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! অরুণাত্মজ গৃধ্ররাজ জটায়ু রাজা দশরথের সখা এবং মহাশূর সম্পাতির সহোদর ছিলেন। তিনি বধু জানকীকে রাবণের অঙ্গে নিরীক্ষণপূর্ব্বক ক্ৰোধাভরে দ্রুতবেগে রাক্ষসেশ্বরসমীপে উপনীত হইয়া কহিলেন, ‘ওরে দুষ্ট নিশাচর! সীতা আমার ক্ষুষা, তুই আমার সমক্ষে কিরূপে ইহাকে হরণ করিবি? যদি তোর জীবনরক্ষা করিবার বাসনা থাকে, তবে অবিলম্বে জানকীকে পরিত্যাগ কর।” গৃধ্ররাজ জটায়ু এই কথা বলিয়া প্রচণ্ড নখাঘাত ও পক্ষপ্ৰহারদ্বারা নিশাচরের শরীর জর্জ্জরীভূত করিথে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ হইতে প্রস্রবণের ন্যায় অজস্র রুধিরধারা বিনিঃসৃত হইতে লাগিল।
“রাবণ রামহিতৈষী জটায়ুকর্ত্তৃক অত্যন্ত আহত হইয়া খড়গ গ্রহণপূর্ব্বক পক্ষীন্দ্রের পক্ষযুগল ছেদন করিয়া তাঁহাকে মৃতকল্প করিলেন এবং সীতাকে লইয়া আকাশপথে উপস্থিত হইলেন। বৈদেহী পথিমধ্যে যে যে স্থানে আশ্রমমণ্ডল, সরোবর ও নদী অবলোকন করিলেন, তথায় স্বীয় অলঙ্কার উন্মোচনপূর্ব্বক নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে গিরিপ্রস্থে পাঁচটি বানর দর্শন করিয়া তথায় দিব্য উত্তরীয়বসান নিক্ষেপ করিলেন। যেমন বারিদমধ্যে বিদ্যুৎ বিরাজিত হয়, তদ্রূপ সেই পীতবর্ণ বসন বায়ুবেগে বানরগণের মধ্যে পতিত হইয়া শোভিত হইল। খেচর নিশাচর অচিরকালমধ্যে সীতাসমভিব্যাহারে বিশ্বকর্ম্মাবিনির্ম্মিত, পরমরমণীয়, প্রকারবেষ্টিত, বহুদ্বারোপশোভিত লঙ্কাপুরী প্রবেশ করিলেন।
“এদিকে রাম মৃগরূপী মারীচের প্রাণসংহার করিয়া প্রত্যাগত হইতেছেন, এমন সময় পথিমধ্যে লক্ষ্মণকে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে এই বলিয়া ভ্রাতাকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন যে, লক্ষ্মণ কিরূপে সেই রাক্ষস পূর্ণ জনশূন্য অরণ্যে সীতাকে একাকিনী পরিত্যাগ করিয়া আগমন করিলেন? অনন্তর তিনি মৃগরূপী রাক্ষসদ্বারা আপনার আকর্ষণ ও লক্ষ্মণের আগমনে নিতান্ত শঙ্কিত ও একান্ত চিন্তাকুল হইয়া আপনাদিগকে নিন্দা করিয়া শীঘ্র তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘লক্ষ্মণ! বৈদেহী ত’ জীবিত আছেন?” তখন লক্ষ্মণ, সীতা তাহার প্রতি যে সকল অসদৃশ দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় নিবেদন করিলেন। তাহার বাক্য শ্রবণ করিয়া রামের হৃদয় দগ্ধ হইতে লাগিল।
রামকর্ত্তৃক জটায়ুর সৎকার
“অনন্তর তিনি আশ্রমে উপস্থিত হইয়া পর্ব্বতপ্রতিম মৃতের ন্যায় নিপতিত গৃধ্ররাজকে অবলোকন করিয়া রাক্ষসভ্রমে শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক লক্ষ্মণ-সমভিব্যাহারে তাহার প্রতি ধাবমান হইলেন। গৃধ্ররাজ রাম ও লক্ষ্মণকে নয়নগোচর করিয়া কহিলেন, “বৎস! তোমাদিগের মঙ্গল হউক, আমি রাজা দশরথের সখা; আমার নাম জটায়ু৷” ভ্রাতৃযুগল তাঁহার বাক্য-কৰ্ণগোচর করিয়া পরস্পর কহিলেন, ‘ইনি কে, আমাদিগের পিতার নাম করিতেছেন? পরে তাঁহারা সেই ছিন্নপক্ষ পক্ষীর নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, “অদ্য সীতার নিমিত্ত দুরাত্মা রাবণ হইতে আমার এই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে।” তখন রাম জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তাত! রাবণ কোন পথে প্রস্থান করিয়াছে?” পক্ষীন্দ্র বাঙ-নিষ্পত্তি করিতে অসমর্থ হইয়া শিরশ্চালনীদ্বারা পথের নিরূপণ করিয়া তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। দাশরথি গৃধ্ররাজের ইঙ্গিত-দর্শনে রাবণ দক্ষিণদিকে গমন করিয়াছে বুঝিতে পারিলেন এবং স্বীয় পিতৃবন্ধু জটায়ুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিয়া তথা হইতে লক্ষ্মণ-সমভিব্যাহারে আশ্রমে গমন করিলেন; দেখিলেন, আশ্রম শূন্য হইয়া রহিয়াছে। তন্ত্ৰত্য মঠ সমুদয় ভগ্ন হইয়া গিয়াছে। কলসসকল চূৰ্ণ হইয়াছে এবং শত শত গোমায়ুগণ ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে।
রাম-লক্ষ্মণকর্ত্তৃক কবন্ধবধ
“তখন তাঁহারা জানকীহরণ জন্য শোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়া ক্ৰমিক দক্ষিণাভিমুখে দণ্ডকারণ্যে গমন করিলেন। যাইতে যাইতে দেখিলেন, ঐ ঘোর অরণ্যমধ্যে সহস্ৰ সহস্ৰ মৃগযূথ বায়ুবেগে চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইতেছে এবং অন্যান্য জন্তুগণ ক্ৰমবৰ্দ্ধমান দাবাগ্নির ন্যায় ঘোরতর শব্দ করিতেছে। তাঁহারা কিয়ৎক্ষণ পরেই এক ঘোরদর্শন মহাভুজ কবন্ধ অবলোকন করিলেন। উহার আকার নিবিড় মেঘ ও পর্ব্বতের ন্যায় এবং স্কন্ধাদেশ শালসদৃশ। উহার বিশাল নেত্রদ্বয় বক্ষঃস্থলে ও ভীষণ বদনমণ্ডল উদরে সন্নিহিত রহিয়াছে। কবন্ধ যাদৃচ্ছাক্রমে লক্ষ্মণের হস্তধারণ করাতে তিনি সাতিশয় বিষণ্ন হইলেন। কবন্ধ তখন লক্ষ্মণকে আকর্ষণ করিয়া রামের অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। তখন সুমিত্ৰানন্দন রামকে অবলোকন করিয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “মহাশয়! আমার দুরবস্থা দৰ্শন করুন। বৈদেহীর হরণ, আমার এই আকস্মিক বিপৎপাত, আপনার রাজ্যনাশ ও পিতার মরণ, এই সমুদয় অমঙ্গল এককালে উপস্থিত হইয়াছে। হায়! আমি কোশল-নগরে বৈদেহী সমভিব্যাহারে আপনাকে পিতৃপতামহ রাজ্য শাসন করিতে দেখিলাম না; আপনি যখন কুশ, লাজ ও শমীদ্বারা রাজ্যে অভিষিক্ত হইবেন, তখন ধন্য ব্যক্তিরাই মেঘনিমুক্ত শশধরের ন্যায় আপনার মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিবেন।’ লক্ষ্মণ এই প্রকার বহুবিধ বিলাপ করিলেন।
“সূৰ্য্যবংশাবতংস মহাবীর রাম সেই বিপৎকালেও কিছুমাত্র ভীত না হইয়া কহিলেন, “হে নরশ্রেষ্ঠ! তুমি কিছুমাত্র বিষণ্ন হইও না। আমি জীবিত থাকিতে উহার নিকট তোমার ভয়ের বিষয় কি? আমি এই দুরাত্মার বামবাহু ছেদন করিতেছি; তুমি শীঘ্র উহার দক্ষিণবাহু ছেদন কর।” মহাবীর রাম এই কথা বলিতে বলিতে তীক্ষ্ন খড়্গাঘাতে অনায়াসে কবন্ধের বামবাহু ছেদরপূর্ব্বক পাতিত করিলেন। লক্ষ্মণও তদর্শনে সাহসী হইয়া খড়্গাঘাতে তাহার দক্ষিণবাহু ছেদনপূর্ব্বক পার্শ্বদেশে দৃঢ়তর আঘাত করিতে লাগিলেন। কবন্ধ দারুণ আঘাতে নিরতিশয় নিপীড়িত হইয়া ভূতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল।
রামের প্রতি শাপমুক্ত বিশ্বাবসুর উপদেশ
“অনন্তর সূৰ্য্যসদৃশ তেজস্বী দিব্যদর্শন এক পুরুষ কবন্ধের দেহ হইতে বহির্গত হইলেন; রাম তদর্শনে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে? অনুগ্রহপূর্ব্বক পরিচয় প্রদান করুন, আমি আপনাকে নিরীক্ষণ করিয়া চমৎকৃত হইয়াছি।” দিব্যপুরুষ কহিলেন, “হে ভূপনন্দন! আমি গন্ধর্ব্ব, আমার নাম বিশ্বাবসু; ব্ৰহ্মশাপপ্রভাবে রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম। হে মহাত্মন! লঙ্কাধিবাসী দুরাত্মা রাবণ সীতাকে হরণ করিয়াছে। আপনি সুগ্ৰীবের নিকট গমন করুন; তিনি আপনার সহিত সখ্যস্থাপন করিবেন। এই যে পবিত্ৰতোয়া হংসকারণ্ডবসনাথা পম্পা পুষ্করিণী দেখিতেছেন, ইহার অনতিদূরে ঋষ্যমূক-পর্ব্বত। সুগ্ৰীব চারিজন সচিব-সমভিব্যাহারে ঐ পর্ব্বতে বাস করিতেছেন। মহাবীর সুগ্ৰীব বানররাজ বালীর সহোদর। আপনি তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া তাঁহাকে আপনার দুঃখের কথা জ্ঞাপন করুন। তিনিও আপনার ন্যায় ভাৰ্য্যাবিয়োগী; অতএব অবশ্যই আপনার সাহায্য করিবেন। আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, আপনি নিঃসন্দেহ জানকীর সন্দর্শন পাইবেন; বানররাজ সুগ্ৰীব নিশ্চয়ই রাবণদিগকে জানেন।” মহাপ্রভাসম্পন্ন দিব্যপুরুষ এই কথা বলিয়া অন্তৰ্হিত হইলে মহাবীর রামলক্ষ্মণ বিস্ময়ান্বিত হইলেন।”