২৭৮. মুক্তিকামীর আচার—সমদর্শিতা

২৭৮তম অধ্যায়

মুক্তিকামীর আচার—সমদর্শিতা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! লোকে কিরূপ চরিত্র, আচার, জ্ঞান ও আশ্রয়সম্পন্ন হইলে নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মপদ লাভ করিতে পারে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যে ব্যক্তি মোক্ষধৰ্ম্মের অনুশীলনে যত্নবান, অল্পাহারনিরত এবং জিতেন্দ্রিয় হয়েন, তিনিই নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মপদলাভ করিতে পারেন। অতএব লাভালাভে সমজ্ঞান ও উপস্থিত বিষয়ে নিরপেক্ষ হইয়া গৃহাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করাই কৰ্ত্তব্য। প্রত্যক্ষে হউক বা পরোক্ষেই হউক, বাক্য, মন ও ইঙ্গিতদ্বারাও কোন ব্যক্তির নিন্দা করা উচিত নহে। হিংসা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সকলের সহিত মিত্ৰতা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। এই বিনশ্বর দেহ ধারণ করিয়া কোন ব্যক্তির সহিত শত্রুতা করা কদাপি বিধেয় নহে। কেহ নিন্দা করিলে তাহা সহ্য করা উচিত। অন্য অপেক্ষা আপনাকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা নিতান্ত গর্হিত। কেহ নিন্দাদিদ্বারা ক্রোধ উদ্দীপন করিবার চেষ্টা করিলে, তাহার প্রতি প্রিয়বাক্য এবং কেহ প্রহার করিলে তাহার প্রতি হিতবাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য।

“কোন ব্যক্তির প্রতি অনুকূল বা প্রতিকূল হওয়া দণ্ডী[দণ্ড্যাশ্রমীর—সন্ন্যাসীদিগের]দিগের ধৰ্ম্ম নহে। যদি তাঁহারা অনেকে গৃহ পৰ্য্যটনপূৰ্ব্বক ভিক্ষালাভ করিতে না পারেন, তথাপি পূৰ্বে নিমন্ত্রিত হইয়া কোন গৃহস্থের ভবনে গমন করিবেন না। মূঢ়ব্যক্তিকর্ত্তৃক অপমানিত হইয়াও তাহার প্রতি অপ্রিয়-বাক্য প্রয়োগে প্রবৃত্ত হইবেন না। সতত স্বধৰ্ম্মনিরত, দয়াবান, প্রত্যুপকারপরাঙ্মুখ [পরের অপকারে বিমুখ], নির্ভয় ও নিরহঙ্কার হইয়া কালহরণ করিবেন। যখন গৃহস্থদিগের ভবন ধূমবিহীন ও অঙ্গারশূন্য হইবে, যখন উহার মধ্যে মুষলধ্বনি [চাউল, ডাউল প্রস্তুত—উখলিতে ধান, কড়াই ফেলিয়া মুষলের আঘাত প্রভৃতি ব্যাপার] শ্রবণগোচর হইবে না এবং যখন গৃহস্থেরা ভোজনাবসানে ভোজনপাত্রসমুদয় পরিত্যাগ করিবেন, সেই সময়েই তাহাদিগের গৃহে ভিক্ষার্থ উপস্থিত হওয়া সন্ন্যাসীদিগের কর্ত্তব্য। কেহ অধিক পরিমাণে ভক্ষ্য প্রদান করিলে তাহারা তাহা হইতে কেবল প্রাণধারণোপযোগী খাদ্য গ্রহণ করিবেন। বস্ত্রাদিসঞ্চয়ের কথা দূরে থাকুক, আহারসংগ্রহেও যত্নবান্ হইবেন না। লাভ হইলে হৃষ্ট ও লাভ না হইলে অসন্তুষ্ট হওয়া তাঁহাদিগের নিতান্ত অবিধেয়। তাঁহারা সাধারণোপভোগ্য মাল্যচন্দনাদিলাভের বাসনা করিবেন না। নিমন্ত্রিত হইয়া ভোজন করা তাঁহাদিগের কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। তাঁহারা অন্নের দোষগুণ কীৰ্ত্তন করিবেন না। নির্জ্জনপ্রদেশে শয়ন ও উপবেশন করিবেন। শূন্যাগার, বৃক্ষমূল, অরণ্য, গিরিগুহা বা অন্য কোন প্রকার জনশূন্য প্রদেশে বাস করাই তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য। তাঁহারা তিরস্কার ও পুরস্কারে সমজ্ঞানসম্পন্ন ও নিশ্চল হইবেন। কৰ্ম্মানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক পাপপুণ্য উপার্জ্জন করিবেন না। বৈরাগ্য আশ্রয়পূৰ্ব্বক নিত্য তৃপ্ত, পরম পরিতুষ্ট, প্রসন্নবদন, প্রফুল্লেন্দ্রিয়, ভয়শূন্য, জপপরায়ণ ও মৌনাবলম্বী হইয়া থাকিবেন। প্রাণীগণের জন্মমৃত্যু বারংবার হইতেছে এবং সকলেরই দেহ ও ইন্দ্রিয়সমুদয় বিনশ্বর, ইহা বিশেষরূপে অনুধাবনপূৰ্ব্বক সৰ্ব্ববিষয়ে নিস্পৃহ, সৰ্ব্বভূতে সমদশী, আত্মারাম, প্রশান্তচিত্ত, অল্পাহারনিরত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অন্নাদি বা ফলমূলাদিদ্বারা জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করা তাহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহারা বাক্য, মন, ক্রোধ, উদর ও উপস্থের বেগ ধারণ করিবেন এবং কেহ নিন্দা করিলে ব্যথিত হইবেন না। নিন্দা ও প্রশংসাতে সমজ্ঞানসম্পন্ন হইয়া মধ্যস্থের ন্যায় অবস্থান করাই সন্ন্যাসাশ্রমের প্রধান ধর্ম্ম।

‘সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বী মহাত্মারা দমগুণান্বিত, সহায়বিহীন, গৃহশূন্য, প্রশান্তচিত্ত ও সাবধান হইয়া থাকিবেন। একবারের অধিক কোন স্থানে ভিক্ষার্থ গমন করিবেন না। বানপ্রস্থাশ্রমী বা গৃহীর ভবনে বাস করা তাঁহাদিগের কখনই কৰ্ত্তব্য নহে। যদৃচ্ছালব্ধ অনিন্দিত দ্রব্য ভক্ষণ করা ও হর্ষে একান্ত অভিভূত না হওয়াই তাঁহাদিগের পরমধর্ম্ম।

“মহাত্মা হারীত সন্ন্যাসধর্ম্মকেই মোক্ষলাভের প্রধান সাধন বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। জ্ঞানবান ব্যক্তিরাই এই ধর্ম্ম আশ্রয় করিয়া মোক্ষলাভ করিতে পারেন; কিন্তু অজ্ঞানেরা এই ধৰ্ম্ম পালন করিতে চেষ্টা করিলে তাহাদিগের পরিশ্রমমাত্র সার হয়, সন্দেহ নাই। ফলতঃ যে ব্যক্তি সমুদয় প্রাণীকে অভয়দান করিতে গৃহাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করিতে পারেন, তিনিই পরমব্রহ্মলাভে সমর্থ হয়েন।”