২৭৬তম অধ্যায়
নিস্পৃহতার নিদান—জনক-মাণ্ডব্যসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যখন আমরা অর্থাকাঙক্ষী হইয়া পিতা, ভ্রাতা, জ্ঞাতি ও সুহৃদগণকে কালকবলে নিক্ষেপ করিয়াছি, তখন আমাদিগের তুল্য ক্রূর পাপাত্মা আর কেহই নাই। আমরা কেবল বিষয়তৃষ্ণাপ্রভাবেই এইরূপ ঘোরতর পাপাচরণ করিয়াছি; এক্ষণে যাহাতে আমাদিগের সেই তৃষা নিরাকৃত হয়, আপনি তাহার উপায় কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই উপলক্ষে জনকরাজ মাণ্ডব্যের নিকট যাহা কহিয়াছিলেন, সেই পুরাতন কথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“পূৰ্বে বিদেহরাজ তত্ত্বজিজ্ঞাসু মাণ্ডব্যকে কহিয়াছিলেন, ‘মহাত্মন! আমার কোন বস্তুতে অধিকার নাই; তথাপি আমি পরমসুখে জীবনযাপন করিতেছি। বিদেহনগরী দগ্ধ হইলেও আমার কিছুমাত্র দগ্ধ হয় না। বিবেকশীল মহাত্মারা ব্রহ্মলোককেও নিতান্ত দুঃখের কারণ বলিয়া জ্ঞান করেন; কিন্তু মূঢ়ব্যক্তিরা অল্পমাত্র বিষয়েই নিরন্তর বিমুগ্ধ হইয়া থাকে। কি ঐহিক সুখ, কি স্বর্গীয় সুখ, তৃষ্ণাক্ষয়জনিত বিশুদ্ধ সুখের ষোড়শাংশের একাংশেরও উপযুক্ত হইতে পারে না। যেমন বলীবর্দ্দের বৃদ্ধির সহিত তাহার শৃঙ্গের বৃদ্ধি হয়, তদ্রূপ ঐশ্বর্য্যের যত বৃদ্ধি হয়, বিষয়তৃষা ততই পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। লোকের অতি অল্পমাত্র পদার্থের প্রতি মমতা জন্মিলেও সেই পদার্থের নাশনিবন্ধন তাহাকে অবশ্যই অনুতাপ করিতে হয়। কামাসক্ত হওয়া কাহারও বিধেয় নহে। কামে অনুরক্ত হইলে নিশ্চয়ই, দুঃখভোগ করিতে হয়। অতএব অর্থলাভ করিয়া কামনা পরিত্যাগপূর্ব্বক ধর্ম্মবিষয়ে ব্যয় করা মনুষ্যের সব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিই সমুদয় প্রাণীকে আপনার ন্যায় জ্ঞান করেন এবং বিশুদ্ধচিত্ত ও কৃতকৃত্য হইয়া সমুদয় বিষয় পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়েন। মনুষ্যেরা সত্য, মিথ্যা, শোক, হর্ষ, প্রিয়, অপ্রিয় এবং ভয় ও অভয় পরিত্যাগ করিতে পারিলেই প্রশান্তচিত্ত ও নিরাময় হইতে পারে। দুৰ্ম্মতি মূঢ়েরা যাহাকে পরিত্যাগ করা দুঃসাধ্য বিবেচনা করে, শরীর জীর্ণ হইলেও যাহা জীর্ণ না হয় এবং মহাত্মারা যাহাকে প্রাণান্তকর রোগ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, সেই বিষয়তৃষ্ণাকে পরিত্যাগ করিতে পারিলে পরম সুখলাভ হইয়া থাকে। ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মারা বিশুদ্ধ ও সদাচারসম্পন্ন হইয়া ইহলোক ও পরলোকে অসাধারণ সুখানুভব ও কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া থাকেন।
“বিদেহরাজ এই কথা কহিলে মহর্ষি মাওব্য নিতান্ত প্রীত হইয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদানপূৰ্ব্বক মোক্ষমার্গ আশ্রয় করিলেন।”