২৭৫তম অধ্যায়
দেহ-জীবাত্মার সম্বন্ধ—নারদ-দেবলসংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “যুধিষ্ঠির! এই স্থলে নারদ-দেবলসংবাদ নামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা দেবর্ষি নারদ বুদ্ধিমান বৃদ্ধ অসিতদেবলকে সমাসীন অবলোকন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্ৰহ্মন্! এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্ব কাহা হইতে সৃষ্ট হইয়াছে এবং প্রলয়কালে কাহাতে লীন হইবে, আপনি ইহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।
“দেবল কহিলেন, নারদ! পরমাত্মা সৃষ্টিকাল উপস্থিত হইলে যেসমস্ত বস্তু হইতে ভূত সৃষ্টি করেন, বিজ্ঞানসম্পন্ন মহাত্মারা তৎসমুদয়কে পঞ্চমহাভূত বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। জীবাত্মা পরমাত্মাকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়াই ঐ সমস্ত মহাভূতে অন্যান্য ভূতের সৃষ্টি করেন। যাঁহারা এই পরমাত্মা, জীব ও পঞ্চভূত ভিন্ন সৃষ্টিক্রিয়াবিষয়ে অন্য অচেতন বা চেতন কারণ আছে বলিয়া নির্দ্দেশ করেন, তাঁহাদিগের বাক্য নিতান্ত অমূলক। ঐ পঞ্চমহাভূত তেজঃস্বরূপ, নিত্য ও নিশ্চল। জীব উহাদের ষষ্ঠ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু ও আকাশ এই পাঁচটি মহাভূত। এই পাঁচমহাভূত হইতে স্বতন্ত্র কোন পদার্থই নাই। যাঁহারা ইহার অতিরিক্ত পদার্থের অস্তিত্ব স্বীকার করে, তাঁহাদের বাক নিতান্ত যুক্তিবিরুদ্ধ। পঞ্চভূত হইতেই দেহাদি কাৰ্য্য উৎপন্ন হয়। এই পঞ্চভূত ও জীব যাহার কারণ, তাহা বিনশ্বর, সন্দেহ নাই। পঞ্চভূত, জীব, পূৰ্ব্বসংস্কার ও অজ্ঞান এই আটটি ভূত প্রাণীগণের জন্মমৃত্যুর কারণ। প্রাণীগণ এই আটটি পদার্থ হইতে উদ্ভূত ও ঐ সমুদয়েই লীন হইয়া থাকে। জন্তু বিনষ্ট হইলে তাহার শরীর পাঁচভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। আবার উহার উৎপত্তিকালে ভূমি হইতে দেহ, আকাশ হইতে শ্রোত্র, তেজ হইতে চক্ষু, বায়ু হইতে বেগ ও জল হইতে শোণিত উৎপন্ন হয়।
‘চক্ষু, নাসিকা, কর্ণ, ত্বক ও জিহ্বা এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়। বাহ্য পদার্থের জ্ঞানসাধক দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্পর্শন ও আস্বাদন এই পাঁচটি উহাদের ক্রিয়া। ঐ পাঁচ ইন্দ্রিয় রূপরস প্রভৃতি আপনাদিগের বিষয়সমুদয় স্বয়ং অনুভব করিতে সমর্থ হয় না, আত্মাই উহাদের দ্বারা ঐ সমস্ত অনুভব করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয় হইতে চিত্ত, চিত্ত হইতে মন, মন হইতে বুদ্ধি ও বুদ্ধি হইতে আত্মাই শ্রেষ্ঠ। মনুষ্য সর্ব্বাগ্রে ইন্দ্রিয়দ্বারা রূপাদি বিষয়সমুদয় জ্ঞাত হয়; পরে মনোবৃত্তিদ্বারা ঐ সমস্ত সম্যক্ বিচার করিয়া বুদ্ধিদ্বারা ঐ সমুদয়ের নিশ্চয় করিয়া থাকে। পাঁচ ইন্দ্রিয়, মন, চিত্ত ও বুদ্ধি এই আটটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; আর হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ ও মুখ এই পাঁচটি কৰ্ম্মেন্দ্রিয়। বাক্যপ্রয়োগ ও অভ্যবহারার্থ [আহারের জন্য] মুখ, গমনের নিমিত্ত চরণ, কার্য্যানুষ্ঠানের নিমিত্ত হস্ত, পুরীষত্যাগের নিমিত্ত পায়ু ও রেতোনিঃসারণের নিমিত্ত উপস্থ নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। এই পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় ভিন্ন আর একটি কৰ্ম্মেন্দ্রিয় আছে; উহার নাম প্রাণ। উহাকে ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই আমি তোমার নিকট জ্ঞান ও কর্ম্মেন্দ্রিয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম।
ইন্দ্রিয়সংযোগে বন্ধন—ইন্দ্রিয়নাশে মোক্ষ
‘ইন্দ্রিয়সমুদয় শ্রান্তি নিবন্ধন স্ব স্ব কাৰ্য্য হইতে নিবৃত্ত হইলেই মনুষ্য নিদ্রিত হইয়া থাকে। ইন্দ্রিয়গণের বিশ্রামকালে মনুষ্য কাৰ্য্যে নিরত থাকিয়া বিষয়ানুভব করিলে লোকের স্বপ্নদর্শন হইয়া থাকে। মনোবৃত্তি তিন প্রকার সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। তন্মধ্যে সাত্ত্বিকই সবিশেষ প্রশংসনীয়। ঐ বৃত্তিত্রয়ের প্রভাবে লোকে জাগ্ৰদবস্থাতে [জাগিয়া থাকার সময়ে] যাহা যাহা বাসনা করে, নিদ্রিতাবস্থায় স্বপ্নে তৎসমুদয় অনুভব করিয়া থাকে। সাত্ত্বিক পুরুষের অন্তরে জাগ্ৰদ্দশাতে [জাগ্রত অবস্থায়] সুখ, ঐশ্বৰ্য্য, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই চারিটি সতত বিরাজিত থাকে; এই নিমিত্ত তাঁহারা স্বপ্নযোগেও ঐ সমুদয় অনুভব করেন। সাত্ত্বিক পুরুষের ন্যায় রাজস ও তামস পুরুষের অন্তরে জাগ্ৰদবস্থায় তাহাদের মনোবৃত্তির অনুরূপ যে-যে ভাব সমুদিত হয়, তাহারা স্বপ্নযোগেও তৎসমুদয় অনুভব করিয়া থাকে। ফলতঃ জাগ্ৰদবস্থাতে সাত্ত্বিক প্রভৃতি ভাবত্রয়ের মধ্যে যে ভাবের উদয় হয়, তাহা স্বপ্নে এবং স্বপ্নে যাহার অনুভব হয়, তাহা জাগ্রদবস্থাতে অনুভূত হইয়া থাকে।
‘মনুষ্যের শরীরে পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও প্রাণ আর সাত্ত্বিক প্রভৃতি ভাবত্রয় এই সপ্তদশ গুণ বিদ্যমান আছে। জীবাত্মা উহাদের অষ্টাদশ। তিনি নিত্য ও অবিনশ্বর। যে সপ্তদশ গুণ মনুষ্যের শরীর আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে, জীবাত্মা অদর্শনপ্রাপ্ত হইলে তৎসমুদয় আর দেহে অবস্থান করিতে পারে না। এই অষ্টাদশ গুণ, দেহ ও জঠরানল এই বিংশতি পদার্থের একত্র অবস্থানকেই পাঞ্চভৌতিক সংঘাত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। জীব প্রাণবায়ুর সহিত সমবেত হইয়া এই শরীরকে রক্ষা করিতেছেন, আবার তিনিই এই দেহনাশের কারণ। জীব এক পাঞ্চভৌতিক দেহ আশ্রয় করিয়া প্রারন্ধের [অদৃষ্টের পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মফলের] ক্ষয় হইলেই দেহ পরিত্যাগ করেন এবং তৎপরে ঐ দেহে সঞ্চিত পুণ্যপাপপ্রভাবে পুনরায় অন্য দেহে অবস্থিত হয়েন। লোকে যেমন জীর্ণ গৃহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নূতন গৃহে গমন করে, সেইরূপ জীব কৰ্ম্মফলসমুৎপন্ন এক দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দেহান্তর পরিগ্রহ করিয়া থাকেন। যে মহাত্মারা এই বিষয় বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম করেন, তাঁহারা বন্ধুবিয়োগনিবন্ধন কিছুমাত্র অনুতাপ করেন না। নির্ব্বোধ লোকেরাই তদ্বিষয়ে বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া থাকে। বস্তুতঃ এই জীবলোকে কেহই কাহারও সম্বন্ধী নহে। একমাত্র জীবই লোককে সুখদুঃখ প্রদানপূৰ্ব্বক নিরন্তর তাহার দেহমধ্যে অবস্থান করিয়া থাকেন। জীবের জন্মমৃত্যু নাই। উনি সময়ক্রমে পাঞ্চভৌতিক দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মোক্ষলাভ করেন। কর্ম্মের নাশ হইলেই উহার পুণ্যপাপময়দেহ হইতে মুক্তি ও ব্রহ্মত্ব লাভ হইয়া থাকে। পুণ্যপাপের ক্ষয়ের নিমিত্ত সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ আবশ্যক। পুণ্যপাপ ক্ষয় হইলেই জীব ব্রহ্মত্ব লাভপূৰ্ব্বক উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’ ”