২৭৪. রাবণ-কুম্ভকৰ্ণ-বিভীষণ-তপস্যা

২৭৪তম অধ্যায়

রাবণ-কুম্ভকৰ্ণ-বিভীষণ-তপস্যা

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! মহর্ষি পুলস্ত্যের দেহাৰ্দ্ধসমুৎপন্ন বিশ্রাবা বৈশ্রাবণকে সতত ক্ৰোধদৃষ্টিতে অবলোকন করিতেন। রাক্ষসেশ্বর কুবের স্বীয় পিতাকে ক্ৰোধপরতন্ত্র জানিয়া সান্ত্বনা করিতে চেষ্টা করিতেন। নরবাহন বৈশ্রাবণের আবাসস্থান লঙ্কা। পুষ্পোৎকটা, রাকা ও মালিনীনাম্নী তিনজন রাক্ষসীকে স্বীয় পিতা বিশ্রবার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত করিয়া দিলেন। ঐ রাক্ষসীত্ৰয় নৃত্য ও গীতে সাতিশয় সুনিপুণ। উহারা সকলেই স্ব স্ব শ্রেয়োলাভের নিমিত্ত পরস্পর স্পৰ্দ্ধাসহকারে মহর্ষি বিশ্রবার সন্তোষ-সম্পাদনে যত্ন করিতে লাগিল।

“মহর্ষি বিশ্রবা তাহাদের আস্থা-দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়া অভিলাষানুসারে তিনজনকেই লোকপালসদৃশ অপত্য প্রদান করিলেন। পুষ্পোৎকটার [রামায়ণমতে নিকষা] গর্ভে বারশ্রেষ্ঠ রাবণ ও কুম্ভকৰ্ণ, মালিনীর গর্ভে মহাত্মা বিভীষণ এবং রাকার গর্ভে খর ও শূৰ্পণখা জন্ম পরিগ্রহ করেন। উহাদের মধ্যে বিভীষণ সর্ব্বাপেক্ষা রূপবান, ধার্ম্মিক ও সৎকর্ম্মনিরত, সর্ব্বজ্যেষ্ঠ রাবণ মহাবল পরাক্রান্ত ও উৎসাহশীল; কুম্ভকৰ্ণ সর্ব্বাপেক্ষা বলবান, মায়াবী, সংগ্রামনিপুণ ও প্রচণ্ড এবং খর ব্ৰহ্মদ্বেষী, মাংসলোলুপ ও মহাধনুৰ্দ্ধর ছিলেন। ঘোররূপা শূৰ্পণখা সতত সিদ্ধগণের বিঘ্ন উৎপাদন করিত। রাবণ প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ সকলেই মহাবলপরাক্রান্ত, বেদবেত্তা ও ব্রতচারী ছিলেন। উঁহারা স্বীয় পিতার সমভিব্যাহারে গন্ধমাদন-পর্ব্বতে বাস করিতেন।

“একদা দশাননাদি ভ্রাতৃগণ পরমসমৃদ্ধিসম্পন্ন নরবাহন বৈশ্রাবণকে পিতার সহিত একত্র সমাসীন অবলোকনপূর্ব্বক সাতিশয় ঈর্ষান্বিত হইয়া তপানুষ্ঠানে যত্নবান হইলেন। তাঁহারা অতি কঠোর তপস্যাদ্বারা ব্ৰহ্মাকে পরিতুষ্ট করিতে লাগিলেন। দশানন পঞ্চাগ্নিমধ্যস্থ ও বায়ুভূক, কুম্ভকৰ্ণ অধঃশিরা ও সংযতাহার এবং বিভীষণ শীর্ণপত্ৰমাত্র ভক্ষণপূর্ব্বক উপবাসনিরত ও জপপরায়ণ হইয়া সহস্ৰ বৎসর অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিলেন। খরা ও শূৰ্পণখা রাবণাদির তপানুষ্ঠানকালে হৃষ্টচিত্তে তাঁহাদের পরিচর্য্যা করিতে লাগিল। সহস্ৰ বৎসর সম্পূর্ণ হইলে দুৰ্দ্ধৰ্ষ দশানন আপনার মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিলেন।

রাবণাদির বরলাভ

“তখন ভগবান ব্ৰহ্মা রাবণের সেই অলোকসামান্য কাৰ্য্য সন্দর্শনে পরামপ্রীত হইয়া স্বয়ং তাঁহাদের সমীপে আগমনপূর্ব্বক সকলকে পৃথক পৃথক বরদানদ্বারা প্রলোভিত করিবার নিমিত্ত তপানুষ্ঠান হইতে নিবৃত্ত করিয়া কহিলেন, “হে বৎসগণ! আমি তোমাদের প্রতি প্ৰসন্ন হইয়াছি, আর তপস্যা করিতে হইবে না, এক্ষণে অমরত্ব ব্যতীত স্ব স্ব অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। বৎস রাবণ! তুমি মহত্ত্বলাভবাসনায় আপনার মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক অগ্নিতে আহুতি প্ৰদান করিয়াছ, তন্নিমিত্ত তোমার যত ইচ্ছা ততই মস্তক হইবে, কিন্তু উহাদ্বারা তোমার দেহের কিছুমাত্র বৈরূপ্য জন্মিবে না; তুমি কামরূপী ও সংগ্রামে শক্রগণের নিহন্তা হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“রাবণ কহিলেন, “হে প্ৰভো! দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস, সর্প, কিন্নর ও ভূতগণ ইহাদের নিকট যেন আমার পরাভব না হয়।”

“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে রাবণ! তুমি মনুষ্য প্রভৃতি প্রাণী ভিন্ন যাহাদিগের নাম কীর্ত্তন করিলে তাহাদের নিকট তোমার কিছুমাত্র ভয়ের বিষয় নাই; তুমি অনায়াসে জয়লাভ করিবে।’ নরমাংসাশী রাবণ মনুষ্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করিতেন, সুতরাং ব্ৰহ্মার বাক্য-শ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইলেন।

“অনন্তর সর্ব্বলোকপিতামহ ভগবান ব্ৰহ্মা কুম্ভকৰ্ণকে বর প্রার্থনা করিতে কহিলে মোহাক্ৰান্তচিত্ত কুম্ভকৰ্ণ আমার ‘দীর্ঘকাল নিদ্রা হউক’ বলিয়া বর প্রার্থনা করিলেন। ব্ৰহ্মা ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহাকে বরপ্রদানপূর্ব্বক বিভীষণকে বর গ্রহণ করিতে কহিলেন। বিভীষণ কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! সুমহান আপৎকাল সমুপস্থিত হইলেও যেন আমার মতি ধর্ম্ম হইতে বিচলিত না হয় এবং অশিক্ষিত [অনধীত—যাহাতে শিক্ষাপ্ৰাপ্ত নহে] ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ যেন স্বতঃ আমাতে প্ৰতিভাত থাকে।” ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে বৎস! তুমি যখন রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াও অধর্ম্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়াছ, তখন আমি তোমাকে অমরত্ব প্ৰদান করিলাম।”

রাবণের প্রতি কুবেরের অভিশাপ

“মহাবীর দশান্ন ব্রহ্মার নিকট বরগ্রহণানন্তর কুবেরকে সংগ্রামে পরাজয় ও রাজ্যচ্যুত করিয়া লঙ্কা অধিকার করিলেন। ধনেশ্বর তখন লঙ্কা পরিত্যাগপূর্ব্বক যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব্ব ও কিম্পুরুষ-সমভিব্যাহারে গন্ধমাদন-পর্ব্বতে প্ৰস্থান করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত রাবণ তাঁহার পুষ্পনামক বিমান বলপূর্ব্বক হরণ করিলে তিনি তখন ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে রাবণকে অভিসম্পাত করিলেন, ‘রে দুরাত্মন! এই পুষ্পক কখনই তোকে বহন করিবে না। যিনি সমরাঙ্গনে তোকে সংহার করিবেন, এই বিমান সেই মহাবীরকে বহন করিবে; আর আমি তোর জ্যেষ্ঠভ্রাতা, গুরু, তুই যেমন আমার অপমান করিলি, এই অপরাধে তোকে ত্বরায় শমন-সদনে গমন করিতে হইবে।”

‘ধর্ম্মাত্মা বিভীষণ সজ্জনাচরিত পথ স্মরণপূর্ব্বক কুবেরের অনুগমন করিলেন। ভগবান ধনেশ্বর স্বীয় ভ্রাতা বিভীষণের প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে যক্ষরাক্ষস-সৈন্যের আধিপত্য প্রদান করিলেন।

“এ দিকে নরমাংসলোলুপ মহাবলপরাক্রান্ত পিশাচগণ একত্ৰ হইয়া দশাননকে লঙ্কারাজ্যে অভিষেক করিল। আকাশগামী কামরূপী মহাবলপরাক্রান্ত দশগ্ৰীব দেবগণ ও দৈত্যগণকে আক্রমণপূর্ব্বক তাঁহাদের সমুদয় রত্ন হরণ করিলেন। তিনি দেবগণেরও মনে ভয় সমুৎপাদন করিয়াছিলেন। মহাবীর দশানন সমস্ত লোককে রাবিত অর্থাৎ তাহাদের হিংসা করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার নাম রাবণ হইল।”