২৭৩তম অধ্যায়
কাম্যকর্ম্মে স্বেচ্ছাচারের আশঙ্কা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মনুষ্য যে-যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান, করিয়া পাপে লিপ্ত হয় এবং যে-যে কাৰ্য্যদ্বারা ধৰ্ম্ম, বৈরাগ্য ও মোক্ষলাভ করিতে পারে, আপনি তৎসমুদয় আমার নিকট কীর্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! কোন ধর্ম্মই তোমার অবিদিত নাই। তুমি কেবল আত্মজ্ঞান দৃঢ়ীভূত করিবার নিমিত্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ। যাহা হউক, আমি তোমার নিকট মোক্ষ, বৈরাগ্য, পাপ ও ধর্ম্মলাভের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। লোকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এই পাঁচ ভোগ্য বিষয়ের আস্বাদ পরিজ্ঞাত হইয়া প্রথমে তৎসমুদয় ভোগ করিতে ইচ্ছা করে। ঐ সমুদয় ভোগ্যবিষয়ের প্রভাবেই লোকের কাম ও দ্বেষ উৎপন্ন হয়। তখন সে অভিলষিত বস্তুলাভ ও দ্বেষ্য ব্যক্তির অনিষ্টসাধন করিতে যত্নবান্ হইয়া মহৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করে এবং বারংবার রূপরসাদি ভোগ করিতে যত্নবান হয়। তৎপরে তাহার অন্তঃকরণে ক্রমে ক্রমে লোভ, মোহ, রাগ ও দ্বেষের প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে। মনুষ্য লোভমোহে অভিভূত ও রাগদ্বেষে সমাক্রান্ত হইলে তাহার ধর্ম্মবুদ্ধি এককালে তিরোহিত হইয়া যায়। তখন কপট ধর্ম্মাচরণ ও ছলপূৰ্ব্বক অর্থসংগ্রহ করিয়া থাকে। ছলসহকারে অনায়াসে অর্থ সংগৃহীত হইলে তাহার ঐরূপ অর্থোপার্জ্জন করিতে নিতান্ত স্পৃহা জন্মে। তাহার সুহৃদ ও পণ্ডিতগণ ঐ বিষয়ে নিবারণ করিলে সে বিবিধ হেতুবাদ প্রদর্শনপূৰ্ব্বক তাহাদের বাক্যে উত্তর করে। ঐ পাপাত্মার রাগ ও মোহজনিত পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান, পাপকার্য্যের চিন্তা ও পাপকাৰ্য্য প্রকাশনিবন্ধন কায়িক, মানসিক ও বাচনিক এই ত্রিবিধ অধৰ্ম্ম পরিবর্দ্ধিত হয়। সাধুব্যক্তিরা অসন্তুষ্টচিত্তে সেই অধার্ম্মিকের দোষ দর্শন করিয়া থাকেন। পাপাত্মারা আত্মতুল্য ব্যক্তিদিগের সহিত মিলিত হইয়া মিত্ৰতা করে। উহারা ইহলোক বা পরলোকে সুখানুভব করিতে সমর্থ হয় না। এই আমি তোমার নিকট পাপাত্মার বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিলাম।
“হে বৎস! এক্ষণে ধৰ্ম্মাত্মাদিগের কার্য্য কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মারা অন্যের কুশলাকাঙ্ক্ষী হইয়া স্বয়ং কুশল লাভ করিয়া থাকেন। পরোপকাররূপ ধৰ্ম্মদ্বারাই পরমগতি প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি সুখদুঃখবিচারক্ষম হইয়া জ্ঞানপ্রভাবে পূর্ব্বোক্ত দোষসমুদয় দর্শনপূৰ্ব্বক সাধুদিগের সহিত বাস করেন তাঁহারই ধৰ্ম্মবুদ্ধি পরিবর্দ্ধিত হয় এবং তিনিই যথার্থ ধর্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবনধারণ করিতে পারেন। ধার্ম্মিক ব্যক্তি, ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়াই অর্থোপার্জ্জনে প্রবৃত্ত হয়েন, যে কাৰ্য্যদ্বারা গুণলাভ হয়, তাহাই সতত অনুশীলন করেন এবং আত্মতুল্য সুশীল ব্যক্তির সহিতই মিত্রতা সংস্থাপিত করিয়া থাকেন। সুশীল মিত্র ও ধৰ্ম্মাৰ্জিত ধনলাভনিবন্ধন [ধন হইতে] তাহার ইহলোক ও পরলোকে যারপরনাই আনন্দলাভ হয়। মনুষ্য ধৰ্ম্মপ্রভাবেই উৎকৃষ্ট রূপ দর্শন, রস আস্বাদন, গন্ধ আঘ্রাণ, শ্রবণ ও স্পর্শসুখানুভব করিতে পারে।
“তত্ত্বজিজ্ঞাসু [তত্ত্ব জানিতে অভিলাষী] ব্যক্তি ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের ফললাভ করিয়াও উহাতে পরিতৃপ্ত না হইয়া জ্ঞানপ্রভাবে বৈরাগ্য অবলম্বন করেন। যখন রূপ, রস, গন্ধ প্রভৃতি ভোগ্যবিষয় হইতে মনকে নিবৃত্ত করিতে পারেন, সেই সময় তিনি সৰ্ব্বকাম হইতে বিমুক্ত হয়েন এবং সমুদয় লোক বিনশ্বর দর্শন করিয়া, কাম্যধর্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিষ্কামধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া মোক্ষলাভের নিমিত্ত যত্ন করেন। ফলতঃ যে ব্যক্তি ক্রমে ক্রমে পাপকাৰ্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বৈরাগ্য গ্রহণ করিতে পারেন, তাঁহাকেই যথার্থ ধার্ম্মিক বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। ধার্ম্মিক ব্যক্তিই মোক্ষলাভে সমর্থ হয়েন।
“এই আমি তোমার নিকট পাপ, ধৰ্ম্ম, মোক্ষ ও বৈরাগ্যের বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিলাম। অতএব তুমি সমুদয় অবস্থাতেই ধৰ্ম্মপথে অবস্থান করিবে। ধার্ম্মিকেরাই শাশ্বত সিদ্ধিলাভে সমর্থ হইয়া থাকেন।”