২৭১. অর্থপ্রার্থনার সার্থকতা—কুণ্ডধার-দ্বিজসংবাদ

২৭১তম অধ্যায়

অর্থপ্রার্থনার সার্থকতা—কুণ্ডধার-দ্বিজসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বেদে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনেরই স্তুতিবাদ [প্রশংসা] কীৰ্ত্তিত হইয়াছে; কিন্তু এই তিনের মধ্যে কি লাভ করা সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়ঃ, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে পূৰ্ব্বে কুণ্ডধারনামে মেঘ যে প্রীতিযুক্ত হইয়া এক ব্রাহ্মণের উপকার করিয়াছিল, সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“একদা এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ফলাকাঙ্ক্ষী হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করিতে স্থির করিলেন; কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠান করা অর্থসাধ্য এই বিবেচনা করিয়া অর্থলাভের নিমিত্ত ঘোরতর তপস্যা করিতে লাগিলেন। তিনি তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া ভক্তিসহকারে বহুকাল দেবগণের পূজা করিলেন; কিন্তু তথাপি ধনলাভ হইল না। তখন তিনি মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, কোন্ দেবতা মনুষ্যকর্ত্তৃক আরাধিত হয়েন নাই? আমি এক্ষণে তাঁহারই উপাসনা করিব, তাহা হইলে তিনি শীঘ্র আমার প্রতি প্রসন্ন হইবেন।

“দ্বিজবর মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন, যে, কুণ্ডধারনামা জলধর তথায় অবস্থান করিতেছেন। কুণ্ডধারকে দর্শন করিবামাত্র ব্রাহ্মণের অন্তঃকরণে ভক্তিসঞ্চার হইল; তখন তিনি বিবেচনা করিলেন, ‘কোন মনুষ্যই ইহার নিকট বর প্রার্থনা করে নাই। ইনি দেবলোকের সমীপে অবস্থান করিতেছেন। ইহার আকারও মহতের ন্যায় লক্ষিত হইতেছে; অতএব ইনি অচিরাৎ আমাকে ঐশ্বৰ্য্য প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।’ ব্রাহ্মণ মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দিব্যধূপ, গন্ধ ও বিবিধ উপহারদ্বারা কুণ্ডধারকে পূজা করিতে আরম্ভ করিলেন।

প্রার্থিদ্বিজের প্রতি কুণ্ডধারের অর্থপ্রাপ্তির ইঙ্গিত

“তখন জলধর কুণ্ডধার দ্বিজবরের ভক্তিদর্শনে অচিরাৎ প্রীত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দ্বিজবর! সাধুব্যক্তিরা ব্রহ্মঘ্ন, মদ্যপায়ী, তস্কর ও ব্ৰতহীন মানবদিগেরও প্রায়শ্চিত্তবিধান করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু কৃতঘ্ন ব্যক্তির কোন প্রকার প্রায়শ্চিত্তই নাই। আমার পুত্র অধৰ্ম্ম, অসূয়ার পুত্র ক্রোধ ও নিকৃতির পুত্র লোভ। কিন্তু কৃতঘ্নতা বন্ধ্যা। উহার অপত্য কেহই নহে।’ কুণ্ডধার এইমাত্র কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।

“অনন্তর সেই তপঃপরায়ণ, ভক্তিবিশুদ্ধস্বভাব ব্রাহ্মণ সেই দিন রজনীযোগে কুশাসনে শয়ন করিয়া কুণ্ডধারের প্রভাবে স্বপ্নযোগে সমস্ত প্রাণীকে দর্শন করিলেন। ঐ সমস্ত প্রাণীমধ্যে তেজঃপুঞ্জকলেবর যক্ষরাজ মণিভদ্রনন্দন লোকের শুভাশুভ কৰ্ম্মানুসারে অর্থদান ও অর্থ পুনর্গ্রহণ [অশুভকর্ম্মের জন্য প্রদত্ত অর্থের প্রত্যাহরণ] করিবার নিমিত্ত দেবগণকে আদেশ করিতেছিলেন। দেবগণও লোকের শুভকৰ্ম্ম অনুসারে রাজ্যাদি দান ও অশুভ কৰ্ম্মানুসারে পূর্ব্বপ্রদত্ত অর্থাদি পুনগ্রহণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ঐ কুণ্ডধার যক্ষগণের সমক্ষে দেবগণের সন্নিহিত ভূমিতে নিপতিত হইলেন। তদ্দর্শনে দেবতারা মণিভদ্রতনয়ের নিকট সেই বৃত্তান্ত নিবেদন করিলে যক্ষরাজ তথায় আগমন করিয়া ভূতলনিপতিত কুণ্ডধারকে সম্বোধনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কুণ্ডধার! তুমি কি প্রার্থনা কর?’ কুণ্ডধার কহিলেন, ‘যক্ষরাজ! যদি দেবগণ আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি আমার একান্ত ভক্ত ও অনুরক্ত এই ব্রাহ্মণের যাহাতে কিছু সুখোৎপত্তি হইতে পারে, এরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করুন।’ তখন মণিভদ্রতনয় পুনরায় কুণ্ডধারকে কহিলেন, ‘কুণ্ডধার! তোমার মঙ্গল হউক, তুমি কৃতকাৰ্য্য হইয়াছ, এক্ষণে উত্থিত হও। যদি তোমার প্রিয়বয়স্য এই ব্রাহ্মণ অর্থ প্রার্থনা করেন, তাহা হইলে ইঁহাকে প্রার্থনানুসারে অর্থ প্রদান কর। ইনি যে পরিমাণে অর্থ প্রার্থনা করিবেন, আমি দেবগণের নির্দ্দেশানুসারে ইঁহাকে তাহাই প্রদান করিব।’

“তখন কুণ্ডধার মনুষ্যদেহ অস্থির ও ক্ষণভঙ্গুর বিবেচনা করিয়া ব্রাহ্মণের তপানুষ্ঠান করাই শ্রেয়স্কর অনুধাবনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘যক্ষরাজ! আমি এই ব্রাহ্মণের নিমিত্ত অর্থ প্রার্থনা করিতেছি না। ইহার প্রতি আপনাকে অন্যপ্রকার অনুগ্রহ প্রদান করিতে হইবে। আমি ইঁহার নিমিত্ত রত্নপূর্ণা পৃথিবী প্রার্থনা করি না। এক্ষণে আপনার অনুগ্রহে ইনি ধর্ম্মপরায়ণ হউন। ইহার বৃদ্ধি ধৰ্ম্মেরই আশ্রয় ও ধৰ্ম্মেই শান্তি লাভ করুক।’

“তখন মণিভদ্রতনয় কুণ্ডধারের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘কুণ্ডধার! এই ব্রাহ্মণ শারীরিক ক্লেশশূন্য হইয়া ধৰ্ম্মের ফলস্বরূপ রাজ্য ও বিবিধ সুখ উপভোগ করুন।’ দেবগণ ঐ কথা কহিলে কুণ্ডধার তাহাতেও সম্মত না হইয়া ঐ ব্রাহ্মণের নিমিত্ত বারংবার ধৰ্ম্মই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। দেবগণ কুণ্ডধারের আগ্রহাতিশয় দর্শন করিয়া সাতিশয় সন্তোষ লাভ করিলেন।

“অনন্তর মণিভদ্রতনয় কুণ্ডধারকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘কুণ্ডধার! দেবগণ তোমার ও এই ব্রাহ্মণের প্রতি নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছেন। এক্ষণে ইনি ধৰ্ম্মপরায়ণ হইবেন এবং ইঁহার বুদ্ধি নিয়তই ধর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত থাকিবে। মণিভদ্রতনয় এই কথা কহিলে, কুণ্ডধার নিতান্ত দুর্লভ অভিলষিত বর লাভ করিয়া যারপরনাই প্রীত হইলেন।

যক্ষসংসর্গে বৈরাগ্যপ্রাপ্ত দ্বিজের ধৰ্ম্মোপাসনা

“ব্রাহ্মণ স্বপ্নযোগে এই ঘটনা দর্শন করিয়া পুনরায় ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপপূৰ্ব্বক দেখিলেন যে, আপনার চতুর্দ্দিকে সূক্ষ্মচীবর [সন্ন্যাসীদিগের পরিধেয় জীর্ণবস্ত্র] সমুদয় নিপতিত রহিয়াছে। তদ্দর্শনে তাঁহার অন্তঃকরণে বৈরাগ্য উপস্থিত হইল। তখন তিনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘আমি কুণ্ডধারের বিস্তর উপাসনা করিয়াছি, কিন্তু এই ব্যক্তি প্রত্যুপকারপরায়ণ নহে। এক্ষণে আর কাহার নিকটই বা উপকার প্রার্থনা করিব। অতএব আমি ধনাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত অরণ্যে প্রস্থান করি।’

“ব্রাহ্মণ এইরূপে দেবগণের অনুগ্রহপ্রভাবে বৈরাগ্য লাভ করিয়া অরণ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক ঘোরতর তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া দেবগণের অর্চ্চনা ও অতিথিবর্গের আহারাবসানে ফলমূল ভক্ষণ করিয়া জীবনধারণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার ধৰ্ম্মবুদ্ধি ক্রমশঃ বদ্ধমূল হইতে লাগিল। কিয়দ্দিন পরে তিনি ফলমূল পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পত্রমাত্র ভক্ষণে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎপরে পত্রপরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল জলপান করিয়া জীবনধারণ করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে বায়ু ভক্ষণ করিয়া বহু বৎসর অতিক্রম করিলেন; কিন্তু সেই সমস্ত কঠোরতাদ্বারা তাঁহার কিছুমাত্র বলক্ষয় হইল না। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল।

“এইরূপে ব্রাহ্মণ অতি কঠোর তপানুষ্ঠানদ্বারা বহুকাল অতিক্রমপূৰ্ব্বক সিদ্ধ হইলে তাঁহার দিব্যজ্ঞান জন্মিল, তখন তিনি বিবেচনা করিলেন, ‘যদি আমি সন্তুষ্ট হইয়া কাহাকে ধন প্রদান করি, তাহা হইলে সে অবশ্যই ধনী হইবে। আমি এক্ষণে তপঃসিদ্ধ হইয়াছি; সুতরাং যাহা কহিব, কদাচ তাহার অন্যথা হইবে না।’ ব্রাহ্মণ এইরূপ চিন্তা করিয়া হৃষ্টচিত্তে পুনরায় তপস্যা আরম্ভ করিলেন এবং কিয়দ্দিন পরে পুনরায় পূৰ্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টতর সিদ্ধিলাভ করিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন যে, আমি যদি এক্ষণে সন্তুষ্ট হইয়া কাহাকে রাজ্য প্রদান করি, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই রাজা হইবে।’

ভোগকামনায় নরকক্লেশ

“ব্রাহ্মণ মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিতেছেন, এমন সময় কুণ্ডধার ব্রাহ্মণের তপোবল ও তাঁহার সহিত বন্ধুত্বনিবন্ধন তথায় সমাগত হইলেন। ব্রাহ্মণ কুণ্ডধারকে সমাগত দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে তাঁহাকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিলেন। তখন কুণ্ডধার তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! আপনি তপোবলে দিব্যচক্ষু লাভ করিয়াছেন। এক্ষণে উহার প্রভাবে ভূপাল ও অন্যান্য লোকদিগের গতি নিরীক্ষণ করুন।” কুণ্ডধার এই কথা কহিলে ব্রাহ্মণ স্বীয় দিব্যচক্ষুপ্রভাবে দূর হইতে ভূপালগণকে ঘোর নরকে নিপতিত দেখিতে পাইলেন। তখন কুণ্ডধার কহিলেন, ‘দ্বিজবর! যদি তুমি ভক্তিপূৰ্ব্বক আমাকে পূজা করিয়া দুঃখভোগ করিতে, তাহা হইলে আমাকর্ত্তৃক তোমার কি হিত সমাহিত হইত এবং তুমিই বা আমার কি অনুগ্রহ লাভ করিতে? ঐ দেখ, ভূপতিগণ কামনাপরতন্ত্র হইয়া কত কষ্টভোগ করিতেছে। ঐ দেখ, কামক্রোধাদিদ্বারা মানবগণের স্বর্গদ্বার রুদ্ধ হইয়াছে। অতএব মনুষ্যের কি কামনাপরতন্ত্র হওয়া উচিত?’

“কুণ্ডধার এই কথা কহিবামাত্র ব্রাহ্মণ দেখিলেন যে, অসংখ্য লোক কাম, ক্রোধ, লোভ, ভয়, মত্ততা, নিদ্রা, তন্দ্রা ও আলস্যে অভিভূত হইয়া অবস্থান করিতেছে। তখন কুণ্ডধার কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! এই কামক্রোধাদি লোকসমুদয়কে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। দেবগণ ঐ কামাদিনিবন্ধন মনুষ্য হইতে ভীত হইয়া থাকেন এবং ঐ কামাদি দেবতাদিগের আজ্ঞানুসারে মানবগণের বিঘ্নবিধান করিয়া থাকে। ফলতঃ দেবতাদিগের অনুগ্রহ ব্যতীত কেহ কখন ধার্ম্মিক হইতে সমর্থ হয় না। এই দেখ, এক্ষণে তুমি তপঃপ্রভাবে মানবগণকে রাজ্য ও প্রভূত ধনদান করিতে সমর্থ হইয়াছ।’

“কুণ্ডধার এই কথা কহিলে ব্রাহ্মণ তাঁহার পদতলে নিপতিত হইয়া কহিলেন, “ভগবন্! আপনি আমার প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। আমি আপনার স্নেহস্বভাব বুঝিতে না পারিয়া কাম ও লোভপ্রযুক্ত আপনার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্ব্বক যে অপরাধ করিয়াছি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া তাহা মার্জ্জনা করুন।

“তখন কুণ্ডধার ‘আমি তোমার অপরাধ ক্ষমা করিয়াছি’ এই কথা কহিয়া ব্রাহ্মণকে আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। ব্রাহ্মণও কুণ্ডধারের অনুগ্রহে তপঃপ্রভাবে সিদ্ধিলাভ করিয়া সমুদয় লোক পরিভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ফলতঃ ধৰ্ম্মপ্রতিপালন ও যোগাভ্যাসদ্বারা আকাশপথে গমনের ক্ষমতা, সঙ্কল্পসিদ্ধি ও পরমগতি লাভ হইয়া থাকে। দেবতা, ব্রাহ্মণ, যক্ষ, মনুষ্য ও চারণ প্রভৃতি সকলেই ধাৰ্ম্মিকদিগকে পূজা করিয়া থাকেন, ধনাঢ্যকামীদিগকে কখনই পূজা করেন না। হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে একান্ত আসক্ত বলিয়া দেবগণ তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছেন। ধন হইতে অতি অল্প সুখলাভ হইয়া থাকে; কিন্তু ধৰ্ম্মপ্রভাবে অনন্ত সুখলাভ হয়, সন্দেহ নাই।”