২৭০তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক জয়দ্রথসৈন্য-বধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরনাথ! তখন সিন্ধুদেশাধিপতি দুরাত্মা জয়দ্ৰথ ‘থাক’, ‘প্রহার কর’, ‘ধাবমান হও’ বলিয়া সেই সমুদয় ভূপতিগণকে সংগ্রামে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার সৈন্যগণ রণস্থলে যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ পঞ্চপাণ্ডবকে দেখিয়া ঘোরতর শব্দ করিতে লাগিল। শিবি, সৌবীর ও সিন্ধুদেশীয় ভূপতিগণ ব্যাঘ্রের ন্যায় বলসম্পন্ন সেই পঞ্চপুরুষব্যাঘ্রকে অবলোকন করিয়া সাতিশয় বিষণ্নমনাঃ হইলেন।
তখন মহাবলপরাক্রান্ত ভীম সুবর্ণচিত্ৰিত অতিভীষণ লৌহময় গদা গ্রহণপূর্ব্বক জয়দ্রথের প্রতি ধাবমান হইলে নরপতি কোটিকাস্য তদর্শনে সত্বর বহুসংখ্যক রথদ্বারা ভীম ও জয়দ্রথের মধ্যবর্ত্তী পথ অবরোধ করিলেন এবং ভীমসেনের উপর শক্তি, তোমর, নারাচ প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর কোটিকাস্যের অস্ত্রাঘাতে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া প্ৰত্যুত গদাঘাতে গজ, গজারোহী ও চতুর্দ্দশ জন পদাতিককে সংহার করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন জয়দ্রথকে আক্রমণ করিবার মানসে মহাবলপরাক্রান্ত মহারথী পঞ্চশত পার্ব্বতীয় সৈন্যকে বিনাশ করিলেন।
অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির স্বয়ং নিমেষমধ্যে শতসংখ্যক সুবীরদেশীয় বীরপুরুষকে সংহার করিলেন। বলবীৰ্য্যসম্পন্ন নকুল খড়্গধারণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া পদাতিগণের মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক বীজের ন্যায় ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। যেমন লোকে বৃক্ষ হইতে পক্ষিসমূহ নিপাতিত করে তদ্রূপ সহদেব রথে আরোহণ করিয়া নারাচ্য নিক্ষেপপূর্ব্বক গজারোহিগণকে ভূতলে পাতিত করিলেন।
তখন ধনুৰ্দ্ধর ত্ৰিগর্ত্ত রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া গদাঘাতে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের বাহন-চতুষ্টয় সংহার করিলে ধর্ম্মরাজ কুন্তীনন্দন সেই সমীপগত পদচারী ত্রিগর্তের বক্ষঃস্থলে অৰ্দ্ধচন্দ্ৰবাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ত্রিগর্ত্ত যুধিষ্ঠিরের বাণাঘাতে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া রুধির বমন করিতে করিতে ছিন্নমূল পাদপের ন্যায় তাঁহার সম্মুখে নিপতিত হইলেন। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ইন্দ্ৰসেন-সমভিব্যাহারে সেই অশ্ববিহীন রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সহদেবের রথে আরোহণ করিলেন।
বর্ষাকালীন মেঘ যেমন মুষলধারে বারিবর্ষণ করে, তদ্রূয়প ক্ষেমঙ্কর ও মহামুখ-নামক বীরদ্বয় নকুলের উভয়পর্শ্বে থাকিয়া তাঁহার উপর অনবরত তোমর ও বিবিধ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ত্ৰিগর্ত্তরাজ সুরথ নকুলের রথের অগ্রভাগে আরোহণপূর্ব্বক গজদ্বারা ঐ রথ আক্রমণ করিলেন। তখন নকুল রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক খড়্গ ঘূর্ণিত করিয়া পর্ব্বতের ন্যায় স্থিরতরপদে দণ্ডায়মান রহিলেন। নরপতি সুরথ তদর্শনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নকুলের বধের নিমিত্ত এক মত্ত কুঞ্জর প্রেরণ করিলেন। করিবর শুণ্ড উত্তোলন করিয়া নকুলের সম্মুখে ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। নকুল তদর্শনে সত্বর তাহার গণ্ডদেশে এরূপ বলপূর্ব্বক এক খড়্গাঘাত করিলেন যে, তাহাতেই তাহার দন্তদ্বয় ও শুণ্ড ছিন্ন হইয়া গেল। সেই হস্তী তখন চীৎকার করিতে করিতে ভূতলে নিপতিত হইয়া বহুসংখ্যক হস্তিপকের প্রাণনাশ করিল। মহাবলপরাক্রান্ত মাদ্রীনন্দন সেই দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদনানন্তর ভীমসেনের রথে আরোহণ করিয়া সুস্থ ও সুখী হইলেন।
বলবীৰ্য্যসম্পন্ন বৃকোদর ক্ষুরদ্বারা সমরাঙ্গনে সমাগত কোটিকাস্যের সারথির শিরচ্ছেদন করিলেন; কিন্তু তিনি কিছুই জানিতে পারিলেন না। সারথি নিহত হওয়াতে তাঁহার অশ্বগণ বিশৃঙ্খলা হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিল। এই অবসরে ভীমসেন প্রাসদ্বারা তাঁহাকে সংহার করিলেন। বীরবরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় নিশিত ভল্লদ্বারা দ্বাদশজন সৌবীরের শরাসন ও মস্তক ছেদন করিয়া বহুসংখ্যক শিবি, ইক্ষ্বাকু, ত্ৰিগর্ত্ত ও সিন্ধুদেশীয় বীরগণের প্রাণনাশ করিতে লাগিলেন। অনেকানেক মাতঙ্গ ও মহারথ তাঁহার শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত হইয়া শমনসদনে যাত্রা করিল। সেই সময় যুদ্ধক্ষেত্র মস্তকশূন্য কলেবর ও কলেবর-শূন্য মস্তকদ্বারা একবারে ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। কুকুর, গৃধ্র, কঙ্ক, কাকোল, ভাস, গোমায়ূ ও বায়সগণ নিহত বীরপুরুষসমূহের মাংস ভক্ষণ ও শোণিত পান করিয়া পরম পরিতৃপ্ত হইতে লাগিল।
পাণ্ডবভীত জয়দ্রথের পলায়ন
ক্ষত্ৰিয়াকুলকলঙ্ক-দূরাত্মা জয়দ্ৰথ সেই সমুদয় বীরপুরুষগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্ত্রস্তচিত্তে দ্ৰৌপদীকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিবার মানস করিল। পরে সেই নরাধম প্রাণভয়ে নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া সৈন্যসমুদয়সঙ্কুল সংগ্রামস্থলে কৃষ্ণাকে রথ হইতে অবতারণপূর্ব্বক স্বয়ং পলায়ন করিতে লাগিল। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধৌম্য-সমভিব্যাহারিণী দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাকে নিরীক্ষণ করিয়া মাদ্রীসুতের সহিত তাঁহাকে রথে আরোহণ করাইলেন।
এইরূপে পাপাত্মা জয়দ্ৰথ সমরস্থল পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিলে পর তাহার সৈন্যগণ ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর বৃকোদর নারাচদ্বারা তাহাদিগকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় সব্যসাচী ধনঞ্জয় জয়দ্রথকে পলায়ন করিতে অবলোকন করিয়া ভীমসেনকে জয়দ্রথের সৈন্য সংহার করিতে নিষেধ করিয়া কহিলেন, “দেখ, যে দুরাত্মার অত্যাচারনিবন্ধন আমাদিগকে এতাদৃশ ক্লেশ সহ্য করিতে হইল, তাহাকেই এই সমরাঙ্গনে অবলোকন করিতেছি না; অতএব আইস, আমরা তাহারই অন্বেষণ করি; বৃথা সৈন্য বিনাশ করিবার প্রয়োজন নাই।”
বলবান্দিগের অগ্রগণ্য ভীমসেন ধীমান ধনঞ্জয়ের বাক্যশ্রবণানন্তর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! রিপুগণ প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে; যাহারা অবশিষ্ট আছে, তাহারাও ইতস্ততঃ পলায়ন করিতেছে, অতএব আপনি নকুল, সহদেব ও ধৌম্য-সমভিব্যাহারে কৃষ্ণাকে লইয়া আশ্রমে গমনপূর্ব্বক সাত্ত্বনা প্রদান করুন। দুরাত্মা জয়দ্ৰথ যদি পাতালতলে পলায়ন করে, আর সুররাজ ইন্দ্র উহার সারথি হয়েন, তথাপি আমি ঐ নরাধমকে নিধন করিব, তাহার সন্দেহ নাই।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহাবীর! নরাধম জয়দ্ৰথ নিতান্ত দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু ভগিনী দুঃশলা ও জ্যেষ্ঠতাতপত্নী যশস্বিনী গান্ধারীকে স্মরণ করিয়া উহাকে সংহার না করাই কর্ত্তব্য।”
লজ্জানম্রমুখী দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণে ব্যাকুলিতচিত্ত হইয়া কোপকম্পিত্যকলেবরে ভীম ও অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে বীরদ্বয়! যদি আমার প্রিয়ানুষ্ঠান করা তোমাদিগের কর্ত্তব্য হয়, তবে অবশ্যই ঐ দুরাত্মাকে সংহার করিও; দেখ, যে ব্যক্তি ভাৰ্য্যা বা রাজ্য অপহরণ করে, সে সংগ্রামে শরণাগত হইলেও তাহাকে নিধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য।” ভীম ও অর্জ্জুন দ্রৌপদীর বাক্যশ্রবণানন্তর জয়দ্রথকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির নকুল, সহদেব ও ধৌম্য-সমভিব্যাহারে কৃষ্ণাকে লইয়া সেই বহুবিধমঠসঙ্কুল আশ্রমে আগমন করিলেন এবং দেখিলেন, মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ব্ৰাহ্মণগণ একত্র মিলিত হইয়া দ্ৰৌপদীর নিমিত্ত সন্তাপ করিতেছেন। তখন ধর্ম্মরাজ ভাৰ্য্যা, ভ্রাতৃদ্বয় ও পুরোহিতসমভিব্যাহারে সেই দ্বিজগণসম্মুখে সমুপস্থিত হইলে তাহাঁরা যুধিষ্ঠির শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়া দ্রৌপদীকে আনয়ন করিয়াছেন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন। তৎপরে মহারাজ যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণ পরিবৃত হইয়া তথায় উপবেশন করিলেন; বরবর্ণিনী কৃষ্ণা নকুল ও সহদেবসমভিব্যাহারে আশ্রমমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।
এ দিকে ভীমসেন ও অর্জ্জুন জয়দ্ৰথ তথা হইতে একক্রোশ পথ পলায়ন করিয়াছে জানিয়া বায়ুবেগে অশ্বচালনা করিতে লাগিলেন। ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাবীর অর্জ্জুন সেই স্থান হইতে জয়দ্রথের অশ্বগণকে সংহার করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত দিব্যাস্ত্ৰধারী সব্যসাচী বিপৎকালেও বিচলিত হৃদয় হইতেন না, তিনি মন্ত্রপূত শরনিকরদ্ধারা অনায়াসে ঐ অদ্ভুত ব্যাপার সাধন করিলেন। অনন্তর তাঁহারা দুই জনে জয়দ্রথকে লক্ষ্য করিয়া বেগে ধাবমান হইলে ক্ষত্ৰিয়াপসদ জয়দ্রণ অশ্বগণ নিহত হইয়াছে ও ধনঞ্জয় অতিবিক্রমের কার্য্য করিতেছেন নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় ভীত ও দুঃখিত হইয়া পলায়নমানসে প্ৰাণপণে বনমধ্যে ধাবমান হইল।
মহাবীর ধনঞ্জয় জয়দ্রথকে পলায়নপরায়ণ দেখিয়া তাহার অনুগমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “ওহে রাজপুত্র! তুমি এই সাহসে বলপূর্ব্বক কামিবা হরণ করিতে বাসনা করিয়াছিলে? নিবৃত্ত হও, নিবৃত্ত হও, তোমার পলায়ন করা নিতান্ত অনুচিত। তুমি কি বলিয়া শক্রমধ্যে অনুচরগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছ?” ক্ষত্ৰিয়কুলপাংশুল অনুচরগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছ?” ক্ষত্ৰিয়কুলপাংশুল দুরাত্মা জয়দ্ৰথ অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়াও পলায়নে নিবৃত্ত হইল না। তখন মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর ‘থাক্ থাক্’ বলিয়া সহসা জয়দ্রথের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। দয়াশীল অর্জ্জুন “উহার প্রাণসংহার করিও না” বলিয়া ভীমসেনকে নিষেধ করিলেন।
দ্রৌপদীহরণপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত