২৭০. কপিলকথিত মোক্ষধর্ম্ম—জ্ঞান-কৰ্ম্মের সমাধান

২৭০তম অধ্যায়

কপিলকথিত মোক্ষধর্ম্ম—জ্ঞান-কৰ্ম্মের সমাধান

“কপিল কহিলেন, মহর্ষে! সমুদয় লোক বেদকে প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকে, কেহ কখন বেদে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে না। ব্রহ্মা দুই প্রকার—শব্দব্রহ্মা ও পরব্রহ্ম। শব্দব্রহ্ম অবগত হইতে পারিলেই পরব্রহ্ম লাভ করা যায়। পিতা পুত্রোৎপাদনপূর্ব্বক বেদমন্ত্রদ্বারা তাহার শরীর সংস্কার করিয়া থাকেন। পুত্র সংস্কারসম্পন্ন হইলেই বিশুদ্ধদেহ ও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়া জ্ঞানোপার্জ্জনের উপযুক্ত পাত্র হয়। কর্ম্মের ফল চিত্তশুদ্ধি, এক্ষণে উহার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। চিত্তশুদ্ধি হইল কি না, অনুষ্ঠানকর্ত্তাই তাহা অবগত হইতে পারেন; অন্য ব্যক্তি বেদ বা অনুমানদ্বারা কখনই উহা স্থির করিতে সমর্থ হয় না। যাঁহারা নিস্পৃহ, ধনসংগ্রহপরিশূন্য ও রাগদ্বেষবিবর্জ্জিত হইয়া কেবল ধর্ম্মানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, তাঁহারাই ধন্য। সৎপাত্রে প্রদান করাই তাঁহাদিগের ধনব্যয়ের সৎপথ।

‘পুৰ্ব্বকালে অনেকানেক বিশুদ্ধজ্ঞানসম্পন্ন, ক্রোধশূন্য, অসুয়াবিহীন, নিরহঙ্কার, নির্ম্মৎসর, সৰ্ব্বভূতহিতাকাঙ্ক্ষী, কৰ্ম্মযাজী গৃহ, রাজা ও ব্রাহ্মণ বর্ত্তমান ছিলেন। তাঁহারা কখনই পাপকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেন না। সঙ্কল্পমাত্রেই তাঁহাদিগের কাৰ্য্য সিদ্ধ হইত। উহারা সকলেই শীলতাসম্পন্ন, সন্তুষ্টচিত্ত, সত্যসঙ্কল্প, পবিত্র ও পরমব্রহ্মে ভক্তিমান ছিলেন। তাঁহারা পূৰ্ব্বাপর বিবেচনা করিয়া যথানিয়মে ব্রতচৰ্য্যা করিতেন। বিষম সঙ্কট উপস্থিত হইলেও কখন ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ হইতেন না। পূৰ্ব্বে তাঁহাদিগের এই এক উৎকৃষ্ট সুখ ছিল যে, তাঁহারা একত্র মিলিত হইয়া ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতেন। তাঁহাদিগকে কখনই প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত না। সত্যধর্ম্মপ্রভাবে তাঁহারা বিলক্ষণ তেজস্বী ছিলেন। তাঁহারা বুদ্ধিবলনিরপেক্ষ হইয়া কেবল শাস্ত্রানুসারে যে ধৰ্ম্ম উৎকৃষ্ট হইত, তাঁহারই অনুষ্ঠান করিতেন বলিয়া কখন তাঁহাদিগের ধর্ম্মবিষয়ে ছল প্রকাশ করিবার প্রয়োজন হইত না। ফলতঃ এরূপ নিয়মে অবস্থান করিলে কখন প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় না। যাহারা ঐ নিয়মানুষ্ঠানে অক্ষম হয়, তাহাদিগকেই প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করিতে হয়।

এইরূপে পূৰ্ব্বতন অসংখ্য ব্রাহ্মণ ত্রিবেদজ্ঞ, পবিত্র, সদ্ব্যবহারসম্পন্ন, যশস্বী, নিস্পৃহ, বন্ধনমুক্ত, যজ্ঞশীল, কামক্রোধ পরিশূন্য, স্ব স্ব কাৰ্য্যবলে বিখ্যাত, নম্রস্বভাব, শান্ত গুণাবলম্বী ও স্বকৰ্ম্মপরায়ণ ছিলেন। তাঁহারা যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন, কৰ্ম্মানুষ্ঠান, শাস্ত্রানুশীল ও সঙ্কল্পসমুদয়ই ব্ৰহ্ম বলিয়া জ্ঞান করিতেন।

‘পূর্ব্বে সদাচাররূপ একমাত্র আশ্রম ছিল। ঐ আশ্রম অনবধানতা ও কামক্রোধাদিপরিশুন্য ছিল। উহার প্রভাবে পূজ্যপূজার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল না। পরিণামে মানবগণ ধৰ্ম্মের সূক্ষ্মতা রক্ষা করিতে না পারিয়া সেই শাশ্বত পুরাতন সদাচাররূপ একমাত্র আশ্রমকে চারিভাগে বিভক্ত করিয়াছে। সাধু ব্যক্তিমধ্যে কেহ কেহ গার্হস্থ্য আশ্রমের পর বানপ্রস্থ এবং কেহ কেহ ব্ৰহ্মচর্য্যের পর গার্হস্থ্য অবলম্বনপূৰ্ব্বক পরমগতি লাভ করিয়া থাকেন। সেই সমুদয় ব্রাহ্মণ জ্যোতির্ম্ময় দেহ ধারণপূর্ব্বক নভোমণ্ডলে তারাগণরূপে বিরাজিত হয়েন। ঐ সকল ব্রাহ্মণের মধ্যে অনেকেই ব্রহ্মভাবাপন্ন ও জীবন্মুক্ত হইয়াছেন। যদিও তাঁহারা প্রারব্ধকৰ্ম্মনিবন্ধন এই সংসারে পুনর্ব্বার জন্মগ্রহণ করেন, তথাপি তাঁহাদিগকে কখনই কৰ্ম্মফলে লিপ্ত হইতে হয় না। যে ব্রাহ্মণ ঐ সমুদয় মহাত্মার ন্যায় গুরুশুশ্রূষাপরতন্ত্র ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া ব্ৰহ্মচর্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি ব্রাহ্মণ নামের সার্থকতা সম্পাদন করেন। অন্যের ব্রাহ্মণ নামকরণ করা বিড়ম্বনা মাত্র। যখন কারা ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ নিরূপিত হইতেছে, তখন কর্ম্মকেই পুরুষের মঙ্গল ও অমঙ্গলের জ্ঞাপক বলিতে হইবে। যাঁহারা এইরূপে নিষ্কাম কর্ম্ম ও গুরুপদেশদ্বারা চিত্তশুদ্ধি লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা স্বীয় চিত্তমধ্যে সমুদয়ই ব্রহ্মময় দর্শন করিয়া থাকেন। সেই বিষয়তৃষ্ণাবিহীন, বিশুদ্ধচিত্ত মহাত্মাদিগের একমাত্র সমাধিই পরম ধৰ্ম্ম। ক্ষত্রিয়াদি অন্যান্য বর্ণসমুদয় তাতাঁদিগের ন্যায় সগুণসম্পন্ন হইলে ঐ ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতে পারে। শুদ্ধচিত্ত ব্রাহ্মণেরাই ব্ৰহ্মলাভে সমর্থ হয়েন। নিত্যসন্তুষ্ট বৈরাগ্যশালী ব্যক্তি জ্ঞানের আশ্রয় বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। সন্ন্যাসধর্ম্ম গুরুপরম্পরাগত। উহা কখন কখন অন্য ধর্ম্মের সহিত মিশ্রিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ব্রহ্মপদলিপ্সু হইয়া বৈরাগ্যবলে ঐ ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিতে পারেন, তাঁহারই সংসার হইতে মুক্তিলাভ হয়। বৈরাগ্যহীন ব্যক্তি কদাচ ঐ ধৰ্ম্মপ্রতিপালনে সমর্থ হয় না।

“স্যূমরশ্মি কহিলেন, ‘ভগবন! যাঁহারা বিষয়ভোগ, দান, যজ্ঞানুষ্ঠান ও বেদাধ্যয়নে প্রবৃত্ত হয়েন এবং যাঁহারা লব্ধ বিষয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসধৰ্ম্ম আশ্রয় করেন, তাঁহারা সকলেই দেহান্তে স্বর্গভোগ করিতে পারেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।

“কপিল কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্‌। গৃহধর্ম্মনিরত কামী ব্যক্তিরা নানা গুণসমলঙ্কৃত হইয়া বিবিধ বিষয়সুখ সম্ভোগ করিতে পারে, কিন্তু ত্যাগসুখ কখনই অনুভব করিতে সমর্থ হয় না।’

“স্যূমরশ্মি কহিলেন, ‘মহর্ষে! শাস্ত্রে কথিত আছে যে, সমুদয় আশ্রমেই ভক্তিলাভ করা যাইতে পারে; সুতরাং আপনারা জ্ঞানিনিষ্ঠ হইয়া যে ফল প্রাপ্ত হইবেন, গৃহস্থেরাও কর্ম্মপরায়ণ হইয়াও সেইরূপ লাভ করিতে পারিবে? এই বিষয়ে আমার বিলক্ষণ সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে; অতএব আপনি জ্ঞান ও কর্ম্ম এই উভয়ই কি সমান অথবা কৰ্ম্ম জ্ঞানের অঙ্গ, তাহা শাস্ত্রানুসারে আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।

‘কপিল কহিলেন, ব্রহ্মন্‌! কৰ্ম্মসমুদয় স্থূল ও সূক্ষ্মশরীরের শুদ্ধিসম্পাদন এবং জ্ঞান ও মোক্ষলাভের উপায়স্বরূপ। কর্ম্মদ্বারা চিত্তদোষের পরিপাক [ক্ষয়—অপসারণ] ও শাস্ত্রজনিত ব্ৰহ্মজ্ঞান হইতে লোকের অনৃশংসতা, ক্ষমা, শান্তি, অহিংসা, সত্য, সরলতা, অদ্রোহ, অনভিমান, লজ্জা ও তিতিক্ষা উৎপন্ন হইয়া থাকে। ঐ সমুদয় গুণ ব্ৰহ্মলাভের উপায়স্বরূপ। মনুষ্য ঐ সমুদয় গুণদ্বারাই পরব্রহ্ম লাভ করিয়া থাকে। বিজ্ঞ ব্যক্তি বৈরাগ্য উৎপত্তি হইলেই চিত্তদোষের পরিপাকই যে কর্ম্মের ফল, তাহা স্পষ্টরূপে অবগত হইতে পারেন। বিশুদ্ধজ্ঞানসম্পন্ন প্রশান্তচিত্ত ব্রাহ্মণগণ যে গতি লাভ করিয়া থাকেন, তাহাকেই পরমগতি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। যে ব্যক্তি বেদ, বেদপ্রতিপাদ্য কৰ্ম্ম, কাৰ্য্যানুষ্ঠান ও ব্রহ্মজ্ঞান পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনিই বেদবিদ্‌ বলিয়া অভিহিত হয়েন; আর যে ব্যক্তি ঐ সমুদয় জ্ঞাত হইতে পারে না, তাহার জন্ম নিরর্থক। সে কেবল কর্ম্মকারের ভস্ত্রার [হাপরের] ন্যায় বৃথা শ্বাস-প্রশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া থাকে। বেদে সমুদয় বিষয় প্রতিষ্ঠিত আছে; সুতরাং বেদজ্ঞ ব্যক্তিরা সকল বিষয়ই অবগত হইতে পারেন। সমুদয় শাস্ত্রেই জগতের অস্তিত্ব ও অসদ্ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। অজ্ঞ ব্যক্তিরাই উহার অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া থাকে, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞ মহাত্মারা কোন কালে উহার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। যে ব্যক্তি জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার একতাসম্পাদনে সমর্থ হয়েন, তিনিই বেদনিষ্ঠিত পরব্রহ্ম লাভ করিতে পারেন। মোক্ষই অবিচ্ছিন্ন ব্ৰহ্মানন্দের একমাত্র আধার। পণ্ডিতেরা মোক্ষকেই নিত্যসিদ্ধ, সৰ্ব্বভূত, সৰ্ব্বলোকবিখ্যাত জ্ঞাতব্য, স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় প্রাণীর আত্মা ও দেহস্বরূপ, সুখপ্রদ, মঙ্গলপ্রদ, পরব্রহ্মের আধার ও অক্ষয় বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা জ্ঞানচক্ষুঃপ্রভাবে তেজ, ক্ষমা ও শান্তিগুণদ্বারা যে নিরাময়, জগৎকারণ, সনাতন পরমপদার্থ লাভ করিয়া থাকেন, আমি সেই ব্রহ্মবিদ হইতে অভিন্ন পরমব্রহ্মকে নমস্কার করি।’ ”