পাতাল হইতে উঠি সকল বানর।
যোড়হাতে দাণ্ডাইল অঙ্গদ গোচর।।
পাতালে প্রবেশি মোরা সকল বানর।
কোথাও না দেখিলাম সীতা লঙ্কেশ্বর।।
বলেন অঙ্গদ বীর, হে বানরগণ।
সাবধান হৈয়া শুন আমার বচন।।
সীতাবার্ত্তা জানিতে হৈল এক মাস।
মাসের অধিক হৈলে সবার বিনাশ।।
অন্যের যে হউক মম সংশয় জীবন।
সুগ্রীব মারিতে মোরে করিয়াছে পণ।।
পিতারে মারিতে যায় না হৈল মমতা।
পুত্রেরে মারিবে সে যে, এবা কোন্ কথা।।
দক্ষিণ হস্তেতে রাম অগ্নি সাক্ষী করে।
যত হিত করিলেন সকল পাসরে।।
আমি যুবরাজ নাহি পিতা বিদ্যমানে।
সে পদ দিলেন রাম আমারে বিধানে।।
খুড়ার গণনে নহে আমার সম্বন্ধ।
আমাকে মারিতে খুড়া, করেন প্রবন্ধ।।
আমারে মারিবে খুড়া, না হয় খণ্ডন।
আমার নিস্তার নাই শুন কপিগণ।।
যোড়হাতে কপিগণ কহিছে কাহিনী।
জীবনের আশা নাই ত্যজিব পরাণী।।
তারক বানর ছিল বুদ্ধে বৃহস্পতি।
অঙ্গদেরে বুঝায় সে উত্তম প্রকৃতি।।
সুগ্রীবের ভয় হেতু না যাইব দেশ।
সকলে পাতালে গিয়া করিব প্রবেশ।।
রাজ্যভোগ আছে তথা সোণার আবাস।
পরম আনন্দে তথা করিব নিবাস।।
ফুল ফল পাব তথা জল সুবাসিত।
সুগ্রীবের ভয় তুমি না কর কিঞ্চিৎ।।
কি করিবে সুগ্রীব শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ।
কোন ভয় না করিহ, শুন মিত্রগণ।।
নিশ্চিন্তে থাকিব গিয়া পাতাল ভুবনে।
কি করিবে সুগ্রীব রাজা শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
তারকের বাক্যে সবে দিল অনুমতি।
মনে মনে হনুমান করেন যুকতি।।
প্রমাদ বচনে ভাবে হনুমান বীর।
আপনার মনে বুদ্ধি করিলেন স্থির।।
মোর বিদ্যমানে রামকার্য্য হয় হানি।
সভার মধ্যেতে হনুমান কহে বাণী।।
হনুমান বলেন, অঙ্গদ যুবরাজ।
এক কার্য্যে আসি তুমি কর অন্য কাজ।।
কোন্ যুক্তে কর তুমি লয়ে কপিগণ।
তোমার উচিত নহে এ সব কথন।।
পলাইয়া যাবে তুমি পাতাল-ভুবনে।
ধর্ম্মাধর্ম্ম কিছু না ভাবিলে কেন মনে।।
পলাইবা কোথায়, সুগ্রীব সব জানে।
পলাইয়া বাঁচিতে নারিবে কোন খানে।।
উচিত বলিতে তোমা আমার কি ডর।
তোমার সহিত কেবা পলাবে বানর।।
স্ত্রী পুত্র লইয়া করে কিষ্কিন্ধ্যায় বাস।
তোমা লাগি কে ছাড়িবে স্ত্রী পুত্রের আশ।।
তোমা হেন স্ত্রী পুত্র ছাড়িবে কোন্ জন।
একাকী কেবল তুমি ফের বনে বন।।
মনে কর পলাইয়া পাবে অব্যাহতি।
যত কাল জীবে তব থাকিবে অখ্যাতি।।
তোমার বাপেরে রাম মারে এক বাণে।
তার হাত ছাড়াইবা গিয়া কোন্ খানে।।
সুগ্রীব বলেন যদি শ্রীরামের প্রতি।
পাতালে বসিয়া তুমি না পাবে নিষ্কৃতি।।
নির্ভয়ে কেমনে তুমি পাইবা উদ্ধার।
রাম-বাণে মুক্ত হবে সুড়ঙ্গের দ্বার।।
বিষ্ণু-অবতার রাম জগতে পূজিত।
তোমার এমন যুক্তি না হয় উচিত।।
নির্ব্বুদ্ধি তোমারে বলি শুন যুবরাজ।
বীর হয়ে পলাইবা মুখে নাহি লাজ।।
যত দূর যাবে, তার চৌটি নাহি আসি।
গৃহ পাছু যুক্তি কর ভাল নাহি বাসি।।
সবর্বদেশ দেখি যদি নহে দরশন।
সুগ্রীবের ঠাঁই গিয়া লইব শরণ।।
ধার্ম্মিক সুগ্রীব রাজা ধর্ম্মের চরিত।
দোষ গুণ বুঝিয়া সে করিবে উচিত।।
ডর করি পলাইলে বড় হবে দোষ।
হইলে শরণাপন্ন রামের সন্তোষ।।
যে দেশ বলিবে রাজা যাইবে সে দেশে।
তারপর যা হবার হইবেক শেষে।।
তোমারে প্রধান করি সে সুগ্রীব বৈসে।
তোমার প্রসাদে আমাদের ভয় কিসে।।
কুপিল অঙ্গদ হনুমানের বচনে।
লজ্জা দিল হনুমান সবা-বিদ্যমানে।।
জ্যেষ্ঠ ভাতৃ-রমণী রাজার বিবাহিতা।
শাস্ত্রমত জ্যেষ্ঠ হয় কনিষ্ঠের পিতা।।
ইতর পুরুষ পিতা পুত্রে হেন গণি।
অপরজ্ঞ পরজায়া যেমন জননী।।
জ্যেষ্ঠ ভাই সম পিতা সর্ব্বশাস্ত্রে কয়।
তার পত্নী কেবল মায়ের তুল্য হয়।।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃ-জায়া হবে কিসের বাখান।
জানিতে সীতার বার্ত্তা পাঠায় কুস্থান।।
কার্য্য না করিলে রাম হইবে দুঃখী।
সর্ব্বথা আমার মৃত্যু হনুমান দেখি।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম তার দেখি বীর হনুমান।
কোন কার্য্যে ভাল নহে সুগ্রীবের জ্ঞান।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ কার্য্য করিলেন যত।
চোরা-যুদ্ধে আমার পিতারে করে হত।।
সম্মুখ-সমর যদি করিতেন পিতা।
কে কেমন বীর, তুমি তবে ত জানিতা।।
রাম কেন না বলিলেন আমার বাপেরে।
গলে ধরি আনিতেন রাজা লঙ্কেশ্বরে।।
যেখানে থাকিত সীতা আনিত রাবণ।
তবে কেন সীতা লাগি দুঃখী কপিগণ।।
তুমি কিবা নাহি জান বীর হনুমান।
পিতা চারি সাগরে করেন সন্ধ্যা স্নান।।
দিগ্বিজয় করিয়া সে বেড়াত রাবণ।
পিতারে জিনিতে আইল কিষ্কিন্ধ্যা-ভুবন।।
রাবণ দেখিল মোর বাপ নাই ঘরে।
আহ্নিক করেন তিনি সাগরের তীরে।।
পাছু বাটে রাবণ ধরিল মোর বাপে।
সাপটিয়া ধরিল সে অতুল প্রতাপে।।
ধ্যান ভঙ্গ না হইল লেজেতে বান্ধিয়া।
সাগরে রাবণেরে ফেলান ডুবাইয়া।।
দীঘল পিতার লেজ যোজন পঞ্চাশ।
রাবণে তোলেন পিতা উপর আকাশ।।
বারেক আকাশে তুলি পুনঃ ডুবান নীরে।
নাকানি চোবানি খাইয়ে বেটা শেষে মরে।।
চারি সাগরের তপ হয় অবশেষ।
সন্ধ্যাকালে পিতা মম আইলেন দেশ।।
রাবণের দশ মাথা করে নড় বড়।
কিষ্কিন্ধ্যায় আসি বেটা দাঁতে করে খড়।।
দয়া করি মোর বাপ ছাড়েন তাহারে।
লঙ্কায় পলায়ে গেল রাবণ তৎপরে।।
সে রাবণ আসিয়া সীতারে করে চুরি।
ইহার কারণেতে আমরা সবে মরি।।
যদি রাম লইতেন পিতার শরণ।
কোন তুচ্ছ পিতার সে পাপিষ্ঠ রাবণ।।
পিতাকে মারিয়া রাম করিল কুকর্ম্ম।
রাজা হৈয়া করিলেন সম্পূর্ণ অধর্ম্ম।।
আপন অধর্ম্মে রাম এত দুঃখ পান।
ধর্ম্ম-মত ভাব তুমি বীর হনুমান।।
কার্য্য না করিলে রাম হইবেন দুঃখী।
সব কার্য্যে হনুমান মোর মৃত্যু দেখি।।
সুগ্রীবের হবে যশ আমার মরণ।
সীতা না পাইলে আমি ত্যজিব জীবন।।
হনুমান বলে যত বল কিছু মিথ্যা নয়।
জ্যেষ্ঠের রমণী হৈলে মাতৃতুল্য হয়।।
আমরা বানর পশুজাতি, ইহা পারি।
যে শাস্ত্র কহিলা সে কেবল মনুষ্যেরি।।
যত দেশ বলে রাজা খুঁজি একবার।
পশ্চাতে করিব আমি ইহার বিচার।।
রামনাম স্মরণেতে পাপের বিনাশ।
রচিল কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।