২৬তম অধ্যায়
উলূকযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষীয় যুযুৎসুর পরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পুত্র যুযুৎসু অরাতিসৈন্যগণকে বিভ্রাবিত করিতেছিলেন, মহাবীর উলূক ‘থাক থাক’ বলিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন যুযুৎসু বজ্রসদৃশ শিতধার শরদ্বারা উলূককে তাড়িত করিতে লাগিলেন; মহাবীর উলূকও ক্রুদ্ধ হইয়া নিশিতক্ষুরপ্রে তাঁহার শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে কর্ণিদ্বারা তাড়িত করিলেন। মহাবীর যুযুৎসু তৎক্ষণাৎ সেই ছিন্ন চাপ পরিত্যাগ ও বেগশালী অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক রোষকষায়িতনয়নে ষষ্টিবাণে উলূককে ও তিন বাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন উলূক কোপাবিষ্ট হইয়া স্বর্ণভূষিত বিংশতিশরে যুযুৎসুকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার কাঞ্চনময় ধ্বজচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর যুযুৎসুও উলূকের শরে ধ্বজ উন্মথিত হওয়াতে ক্রোধে অধীর হইয়া পাঁচবাণে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। তখন উলূক তৈলধৌত ভল্লদ্বারা যুযুৎসুর সারথির মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সারথির ছিন্ন মস্তক অম্বরতলপরিভ্রষ্ট বিচিত্র তারকার ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। অনন্তর উলূক যুযুৎসুর চারি অশ্বকে নিহত করিয়া তাঁহাকে সাতবাণে বিদ্ধ করিলেন। আপনার পুত্র যুযুৎসু উলুকের শরে সাতিশয় বিদ্ধ হইয়া অন্য রথ লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন; উলূকও তাঁহাকে পরাজিত করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।
সঙ্কুলযুদ্ধ-সুতসোমের অলৌকিক অসিযুদ্ধ
“এদিকে আপনার পুত্র শ্রুতকর্ম্মা নিশিতশরনিকরে পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে নিপীড়িত করিয়া অকুতোভয়ে নিমেষাৰ্দ্ধমধ্যে শতানীকের অশ্বসমুদয় ও সারথিকে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহারথ শুতানীক সেই অশ্ববিহীন রথে অবস্থানপূর্ব্বক আপনার পুত্রের প্রতি গদা নিক্ষেপ করিলেন। ঐ গদা শ্রুতকর্ম্মার অশ্ব, সারথি ও রথ সংচূর্ণিত করিয়া অবনী বিদারণ করিয়াই যেন নিপতিত হইল। এইরূপে সেই কুরুকুলকীৰ্ত্তিবৰ্ধন বীরদ্বয় পরস্পরের আঘাতে বিরথ হইয়া পরস্পরের প্রতি নেত্রপাত করিয়া যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইলেন। তখন আপনার পুত্র শ্রুতকর্ম্মা বিবিংশুর রথে ও শতানীক সত্বর প্রতিবিন্ধ্যের রথে আরোহণ করিলেন।
“ঐ সময় সুবলনন্দন শকুনি ক্রুদ্ধ হইয়া সুতসোমকে নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু বারিবেগ যেমন পৰ্ব্বতকে চালিত করিতে অসমর্থ হয়, সেইরূপ তাঁহাকে কম্পিত করিতে পারিলেন না। সুতসোম পিতার পরমশত্রু শকুনিকে অবলোকন করিয়া বহুসহস্র শরে তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন অস্ত্রপ্রয়োগদক্ষ বিচিত্র যোদ্ধা শকুনি শরজালে সুতসোমের শরনিকর ছেদনপূর্ব্বক তিনবাণে তাঁহাকে নিপীড়িত করিয়া তাঁহার ধ্বজ, সারথি ও অশ্বগণকে তিলপ্রমাণে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে তত্ৰত্য সকল লোকই চীৎকার করিয়া উঠিল। ধনুর্দ্ধর সুতসোম এইরূপে হতাশ্ব, বিরথ ও ছিন্নধ্বজ হইয়া সত্বর শরাসনহস্তে রথ হইতে ভূতলে অবতরণপূর্ব্বক স্বর্ণপুঙ্খ শিলাশিত বিবিধ বিশিখদ্বারা শকুনির রথ সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহারথ শকুনি সেই রথসমীপে সমাগত শলভরাজিসন্নিভ শরজাল সন্দর্শনে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া শরনিকরে তৎসমুদয় ধ্বংস করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় তত্ৰত্য সমুদয় যোদ্ধা ও আকাশস্থিত সিদ্ধগণ সুতসোমকে পদাতি হইয়া রথস্থ শকুনির সহিত যুদ্ধ করিতে দেখিয়া পরম পরিতুষ্ট ও চমৎকৃত হইলেন। তখন সুবলনন্দন নতপর্ব্ব সুতীক্ষ্ণ ভল্লদ্বারা সুতসোমের শরাসন ও তূণীর ছেদন করিয়া ফেলিলেন। রথবিহীন সুতসোম এইরূপে ছিন্নচাপ হইয়া বৈদূৰ্য্য ও উৎপলের ন্যায় প্রভাযুক্ত হস্তিদন্তনির্ম্মিত মুষ্টিদেশসম্পন্ন খড়্গ সমূদত করিয়া সিংহনাদ করিতে আরও করিলেন। শকুনি সুতসোমের সেই বিমলাম্বরসন্নিভ সঞ্চালিত খড়্গকে কালদণ্ডের ন্যায় বোধ করিতে লাগিলেন। তখন শিক্ষাবলসম্পন্ন সুতসোম সেই অসি ধারণপূর্ব্বক সহসা ভ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত, আবৃত, আপ্লুত, বিপ্লুত, সম্পাত ও সমুদীর্ণ প্রভৃতি চতুর্দ্দশ প্রকার মণ্ডল প্রদর্শনপূর্ব্বক বারংবার সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর বলবীর্য্যসম্পন্ন সুবলনন্দন সুতসোমের প্রতি শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সুতসোমও অসিদ্বারা তৎসমুদয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। শকুনি তদ্দর্শনে কোপাবিষ্ট হইয়া পুনরায় তাঁহার প্রতি আশীবিষসদৃশ শরসমূহ পরিত্যাগ করিলেন। গরুড়তুল্য পরাক্রমশালী সুতসোম স্বীয় বল ও শিক্ষাপ্রভাবে হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক তৎসমুদয়ও খড়গদ্বারা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে সেই বীরপুরুষ বীরত্ব প্রদর্শনপূর্ব্বক মণ্ডলাকারে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে শকুনি সুতীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্রদ্বারা তাঁহার প্রভাসম্পন্ন অসি ছেদন করিলেন। সেই মহাখড়গ ছিন্ন হইলে উহার অর্দ্ধভাগ ভূতলে নিপতিত হইল ও অৰ্দ্ধভাগ মাত্র সুতসোমের হস্তে রহিল। তখন মহারথ সুতসোম স্বীয় খড়্গ ছিন্ন অবগত হইয়া ছয় পদ গমনপূর্ব্বক শকুনির অভিমুখে সেই হস্তস্থিত খড়্গাৰ্দ্ধ নিক্ষেপ করিলেন। সুতসোমনিক্ষিপ্ত অর্দ্ধছিন্ন খড়গ মহাত্মা সৌবলের স্বর্ণহীরকবিভূষিত সগুণ শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। তখন মহাবীর সুতসোম সত্বর শ্রুতকীৰ্ত্তির রথে আরোহণ করিলেন। শকুনি অন্য দুর্জয় কার্ম্মুক গ্রহণপূর্ব্বক শত্রুগণকে নিপীড়িত করিয়া পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর সুবলনন্দন সমরে নির্ভয়ে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে ঘোরতর নিনাদ সমুত্থিত হইল। তখন মহাত্মা শকুনি সেই শস্ত্রধারী গর্ব্বিত পাণ্ডবপক্ষীয় সৈনিকগণকে বিদ্রাবিত করিয়া দেবরাজ যেমন দৈত্যসেনাগণকে বিনাশ করিয়াছিলেন, সেইরূপ তাহাদিগকে সংহার করিতে লাগিলেন।”