২৬৯তম অধ্যায়
পাণ্ডবদিগের প্রচণ্ড ক্ৰোধদর্শনে জয়দ্ৰথসৈন্যের ত্ৰাস
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর অমর্ষপরবশ ক্ষত্ৰিয়েরা ভীমার্জ্জুনকে নিরীক্ষণ করিয়া সেই অরণ্যমধ্যে ঘোরতর কোলাহল করিতে লাগিল। রাজা জয়দ্ৰথ ধ্বজাগ্রভাগ অবলোকনপূর্ব্বক ভগ্নোৎসাহচিত্তে দ্রৌপদীকে কহিল, “হে যজ্ঞসেনি! ঐ দেখ, অদূরে পঞ্চরথ লক্ষিত হইতেছে; বোধ হয়, উহাতে তোমার ভর্ত্তৃগণ আগমন করিতেছেন; অতএব এক্ষণে তুমি অনুক্ৰমে উহাদিগের পরিচয় প্রদান কর।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “রে মূঢ়! অতি নিদারুণ আয়ুঃক্ষয়কর কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া এক্ষণে ঐ সকল মহাবীরের পরিচয় লইয়া কি করিবে? উহারা সমবেত হইয়া উপস্থিত হইয়াছেন; আজি তোমাদিগের মধ্যে কেহই জীবিতাবিশিষ্ট থাকিবে না। এক্ষণে অনুজগণের সহিত ধর্ম্মরাজকে নিরীক্ষণ করিয়া আমার সকল ক্লেশই অপনীত হইল; আমি তোমা হইতে আর কোন অনিষ্ট আশঙ্কা করি না। তুমি যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, আমি ধর্ম্মানুরোধে তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর।
“যাহার ধ্বজাগ্রভাগে নন্দ ও উপনন্দনামক সুমধুর মৃদঙ্গদ্বয় নিনাদিত হইতেছে, যাঁহার বর্ণ কাঞ্চনের ন্যায় গৌর, নাসা উন্নত ও লোচনদ্বয় আয়ত, উনিই আমার পতি কুরুকলশ্রেষ্ঠ রাজা যুধিষ্ঠির। কুশলাভিলাষী মানুষ্যেরা ধর্ম্মার্থবেত্তা বলিয়া উঁহার অনুসরণ করিয়া থাকে। উনি শরণাগত শত্রুরও প্ৰাণ দান করেন; অতএব যদি তুমি আপনাদের শ্রেয়ঃ ইচ্ছা কর, তাহা হইলে অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে অবিলম্বেই উহার শরণাপন্ন হও।
“যিনি শালবৃক্ষের ন্যায় উন্নত, যাঁহার বাহুযুগল আজানুলম্বিত, আনন ভ্রূকুটিকুটিল, ভ্রূদ্বয় পরস্পর সংহত, যিনি মুহুর্মুহুঃ ওষ্ঠাধর দংশন করিতেছেন, উনি আমার পতি মহাবীর বৃকোদার। আয়নেয় [বেগগতিশীল অত্যুত্তম অশ্ব]-নামক মহাবল অশ্বেরা প্ৰফুল্লমনে উঁহাকে বহন করিয়া থাকে। উহার কর্ম্ম-সকল আলোকসামান্য এবং উঁহার ‘ভীম’ এই সার্থক নামটি পৃথিবীতে সুপ্রচার হইয়াছে। উহার নিকট অপরাধী হইলে অতিবলবতী জীবিতাশা পরিত্যাগ করিতে হয়। ইনি শক্ৰতা কদাচ বিস্মৃত হয়েন না এবং শত্রুর প্রাণান্ত না করিয়া অন্তঃকরণে অণুমাত্র শান্তিলাভ করেন না।
“ইঁহার নাম যশস্বী অর্জ্জুন। ইনি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতা ও প্রিয়শিষ্য; ভয়, লোভ বা কামপরতন্ত্র হইয়া কদাচ ধর্ম্মপথ পরিত্যাগ করেন না এবং নৃশংসাচারেও নিরত নহেন। ইনি ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য, সর্ব্বধর্ম্মার্থবেত্তা এবং ভয়ার্তের ত্রাতা, ইঁহার অসামান্য রূপলাবণ্য ত্ৰিলোকে প্রথিত আছে, অন্যান্য ভ্রাতৃবর্গ সততই এই প্ৰাণপ্রিয় অর্জ্জুনের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকেন। এই মহাবীরের নাম নকুল, ইনি আমার পতি। ইনি খড়গযুদ্ধে অদ্বিতীয়, আজি দৈত্যসৈন্য-মধ্যবর্ত্তী দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় রণস্থলে ইঁহার অদ্ভূত কর্ম্ম সমুদয় প্রত্যক্ষ করিবে। ইনি মহাবলপরাক্রান্ত, মতিমান ও মনস্বী, এবং ধর্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিরন্তর সন্তুষ্ট করিয়া থাকেন। আর যাঁহাকে সূৰ্য্যসম তেজঃসম্পন্ন দেখিতেছ, উনি আমার পতি সর্ব্বকনিষ্ঠ সহদেব, উহার তুল্য বুদ্ধিমান বক্তা আর নাই। উনি অনায়াসে প্রাণত্যাগ বা অগ্নিপ্রবেশ করিতে পারেন, তথাপি অধর্ম্ম-ব্যবহারে কদাচ প্ৰবৃত্ত হয়েন না এবং কিছুতেই অপ্রিয় সহ্য করিতে পারেন না, উনি আৰ্য্যা কুন্তীর প্রাণপ্রিয় এবং ক্ষত্রিয়ধর্ম্মে একান্ত নিরত।
“যেমন অর্ণবমধ্যে রত্নপরিপূর্ণ নৌকা মকর পৃষ্ঠে আহত হইলে চুর্ণ ও বিকীর্ণ হইয়া যায়, এক্ষণে আমি সৈন্যগণমধ্যে তদ্রূপ বিক্ষোভিত ও অসহায় হইয়াছি। তুমি মোহাবেশপরবশ হইয়া যাঁহাদিগকে এইরূপ অবমাননা করিতেছ, সেই পাণ্ডবেরা তোমাকে অবিলম্বেই ইহার সমুচিত প্রতিফল প্ৰদান করিবেন। কিন্তু অদ্য যদি তুমি তাঁহাদিগের নিকট পরিত্ৰাণ প্রাপ্ত হও, তাহা হইলে তোমার পূনর্জ্জন্মলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।” অনন্তর ইন্দ্ৰকল্প পঞ্চপাণ্ডব নিতান্ত ভীত ও বদ্ধাঞ্জলি পদাতিকদিগকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যান্য সৈন্যগণের প্রতি ক্ৰোধভরে অনবরত শর বর্ষণ করিতে লাগিলেন।”