২৬৮তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের জয়দ্ৰথ অনুসরণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এ দিকে পাণ্ডবেরা শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ভিন্ন ভিন্ন দিকে গমন করিয়া বরাহ, মৃগ মহিষ প্রভৃতি নানাবিধ পশুর প্রাণসংহার করিয়া পুনরায় একত্ৰ মিলিত হইলেন। অনন্তর যুধিষ্ঠির মৃগপক্ষিসমাকুল কাম্যকবনমধ্যে মৃগগণের করুণালাপ শ্রবণ করিয়া ভ্রাতৃবর্গকে কহিলেন, “এই বনস্থ সমস্ত মৃগপক্ষী পূর্ব্বদিকে উপস্থিত হইয়া পরুষশব্দদ্বারা দুঃসহ ক্লেশ ব্যক্ত করিতেছে; বোধ হয়, শক্ৰকর্ত্তৃক কাম্যাকবন অত্যন্ত উপদ্রুত হইয়া থাকিবে, অতএব তোমরা শীঘ্র নিবৃত্ত হও। আমাদিগের মৃগে প্রয়োজন নাই; আমার মন নিতান্ত বিষগ্ন ও দগ্ধ হইতেছে, বুদ্ধি বিমোহিত হইতেছে এবং অন্তরাত্মা শোকাকুল হইয়া একান্ত উদভ্ৰান্ত হইতেছে। গরুড়কর্ত্তৃক ভুজঙ্গম-সকল অপহৃত হইলে সরোবরের যেরূপ অবস্থা হয়, হস্তিগণ নিঃশেষরূপে জলপান করিলে শূন্য কুম্ভের যেমন শোভা হয় এবং রাজলক্ষ্মী অপহৃত ও স্বামীবিহীন হইলে রাজ্য যেমন শোচনীয় দশা প্ৰাপ্ত হয়, আদ্য কাম্যাকবনও সেইরূপ প্রতীত হইতেছে।”
অনন্তর সেই সমস্ত মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষেরা উত্তমোত্তম রথ ও মারুতগামী তুরঙ্গমে আরোহণপূর্ব্বক আশ্রমাভিমুখে গমন করিলেন। তাঁহাদিগের বামপার্থে গোমায়ুগণ চীৎকার-শব্দ করিতে লাগিল। রাজা যুধিষ্ঠির তদর্শনে সাতিশয় অনিষ্টাশঙ্কা করিয়া ভীম ও অর্জ্জুনকে কহিলেন, “দেখ, বায়স ও শৃগাল প্রভৃতি অশুভসূচক জন্তুগণ অকস্মাৎ আমাদিগের পার্শ্বে আসিয়া যখন ভীষণ শব্দ করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, পাপাত্মা কৌরবেরা আশ্রমে উপস্থিত হইয়া বলপূর্ব্বক আমাদিগের অবমাননা বা গুরুতর অপকার করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
তাঁহারা অরণ্যানী ভ্রমণ ও মৃগয়া করিতে করিতে এইরূপ দুর্নিমিত্তসন্দর্শনে নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া পরিশেষে কাম্যকবনে প্রবেশপূর্ব্বক দেখিলেন, প্রিয়তমার দাসপত্নী ধাত্রেয়িকা [পরিচারিকা] রোদন করিতেছে। ইন্দ্ৰসেন ত্বরায় রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দ্রুত পদসঞ্চারে তাহার নিকট গমনপূর্ব্বক সকাতরে জিজ্ঞাসা করিল, “ধাত্রেয়িকে! তুমি কি নিমিত্ত ধূলায় পতিত হইয়া রোদন করিতেছ? কি নিমিত্তই বা তোমার মুখ বিবর্ণ ও পরিশুষ্ক হইয়াছে? নৃশংস পাপিষ্ঠেরা কি রাজপুত্রী দ্রৌপদীর অবমাননা করিয়াছে? যদি সেই অচিন্ত্যরূপবতী পাণ্ডুবশরীরসমা দেবী পৃথিবী, স্বৰ্গ কিংবা সমুদ্রে প্রবেশ করেন, তাহা হইলে ধর্ম্মপুত্ৰ যেরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন, ইহাতে বোধ হয়, পাণ্ডবেরা সকলেই তাহার অনুগামী হইবেন। কোন মুঢ় ব্যক্তি অনুত্তম রত্নসদৃশ পাণ্ডবপত্নী দ্ৰৌপদীকে হরণ করিবার মানস করিয়াছে? সে কি জানে না যে, দ্রৌপদী দুর্জ্জয় অরাতিবিমর্দ্দন পাণ্ডবগণের প্রাণ অপেক্ষাও প্রয়িতমা? তিনি অনাথা নহেন, তিনি পাণ্ডবদিগের হৃদয়স্বরূপ। অদ্য সুতীক্ষ অতি ভয়ঙ্কর পাণ্ডবশর কোন্ হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া মহীতলে প্রবিষ্ট হইবে, বলিতে পারি না।
“হে ভীরু! তুমি আর দ্রৌপদীর নিমিত্ত শোক করিও না; অতি শীঘ্রই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। পাণ্ডবেরা অচিরকালমধ্যেই সমগ্ৰ শত্রু বিনষ্ট করিয়া যশস্বিনী যাজ্ঞসেনীর সমভিব্যাহারে প্রত্যাগত হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
ধাত্রেয়িকা ইন্দ্রসেনের এবংবিধ আশ্বাসবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “সারথে! পাপবুদ্ধি জয়দ্ৰথ ইন্দ্ৰকল্প পাণ্ডবগণকে অবজ্ঞা করিয়া কৃষ্ণকে হরণপূর্ব্বক এই নূতন পথ দিয়া গমন করিয়াছে, বোধ হয়, রাজপুত্রী এখনও অধিক দূর নীত হয়েন নাই, দেখ, এই অভিনব ভগ্ন বৃক্ষসকলের পল্লবনিচয় অদ্যাপি স্নান হয় নাই। অতএব সত্বর তাহাকে প্রত্যাবর্ত্তিত কর। ইন্দ্ৰকল্প পাণ্ডবেরা শীঘ্র বর্ম্মধারণ ও সুমহৎ শরচাপ গ্ৰহণ করিয়া তাহার অনুগমন করুন।
“যদি পাণ।ডবেরা ত্বরায় দেবীর উদ্ধারসাধন না করেন, তাহা হইলে পাষণ্ডদিগের নির্ভৎসন ও দণ্ডভয়ে তাঁহার বদনসুধাকর মলিন হইয়া যাইবে এবং হতবুদ্ধি হইয়া হয়ত কোন অযোগ্য পাত্ৰেই আত্মসমর্পণ করিবেন। কিন্তু তাহা হইলে অদ্য উৎকৃষ্ট আজ্যপূর্ণ স্রুক্ ভস্মে নিপতিত, তুষানলে আহুতি প্রদত্ত, শ্মশানে কুসুমমালা নিপতিত ও দ্বিজগণকে মোহিত করিয়া কুক্কুরকর্ত্তৃক যজীয় সোমরস পীত হইবে, এবং শৃগাল মহারণ্যে মৃগয়া করিয়া সরোবরে অবগাহন করিবে। অতএব আর কালক্ষেপ করিবেন না, শীঘ্র এই পথে তাঁহার অনুসরণ করুন। কুক্কুর যেমন যজ্ঞীয় পুরোডাশ স্পর্শ করিয়া দূষিত করে, সেইরূপ কোন অধার্ম্মিক পাপিষ্ঠ পুরুষ যেন আপনাদিগের প্রিয়তমার সুপ্ৰসন্ন বদনসুধাকর স্পর্শ করিয়া দূষিত করিতে না পারে।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভদ্রে! নিবৃত্ত হও, পরুষবাক্যদ্বারা আর আমাদিগকে দগ্ধ করিও না। রাজাই হউক অথবা রাজপুত্ৰই হউক, বলপ্ৰমত্ত হইয়া যে ব্যক্তি এই কাৰ্য্য করিয়াছে, সে অবশ্যই স্বকৃত দুষ্কর্ম্মের প্রতিফল প্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবেরা এই কথা বলিয়া বারংবার শরাসন হইতে জ্যানিক্ষেপ ও সাপের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া শীঘ্ৰ সেই পথে প্রস্থান করিলেন। কিয়দ্দুর গমন করিয়া শত্রুসৈন্যের বাজিখুরোত্থিত গগনগামী ধূলিপটল অবলোকন করিলেন এবং পদাতিমধ্যগত ধৌম্য ‘শীঘ্ৰ গমন কর’ বলিয়া ভীম নিনাদ করিতেছেন শ্রবণ করিলেন। এ দিকে সেই সমস্ত রাজপুত্রেরা ধৌম্যকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, “হে মহাশয়! এরূপ ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই, আপনি স্বচ্ছন্দে আগমন করুন।”
শ্যেনগণ যেমন আমিষ-দ্রব্যের প্রতি ধাবমান হয় তদ্রূপ জয়দ্ৰথ-সৈন্যেরা বেগে ধাবমান হইল। মহাবলপরাক্রান্ত ক্রোধান্ধ শক্ৰগণের অবমাননায় দ্রৌপদীর ক্রোধানল সাতিশয় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। অনন্তর ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব ইঁহারা জয়দ্ৰথ ও তাহার রথস্থ দ্রৌপদীকে নিরীক্ষণ করিয়া সিন্ধুরাজের প্রতি এমন আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন যে, তদর্শনে শক্ৰগণের অন্তঃকরণে অতিশয় ভয়ের সঞ্চার হইল এবং তাহাদিগের দিগ্ভ্ৰম হইতে লাগিল।