২৬৭তম অধ্যায়
অহিংসনীতি—দ্যুমৎসেন-সত্যবানের শাসন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজা কাহারও হিংসা না করিয়া কিরূপে প্রজাপালন করিবেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই উপলক্ষ্যে মহারাজ দ্যুমৎসেন ও তাঁহার পুত্র সত্যবানের পুরাতন ইতিহাস কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মহাত্মা সত্যবান স্বীয় পিতার শাসনানুসারে বধার্হ ব্যক্তিদিগকে সমানীত দেখিয়া পিতাকে কহিলেন, ‘তাত! ইহাদিগকে বধ করা আপনার ধর্ম্ম নহে। ধর্ম্মও কখন অধৰ্ম্ম এবং অধৰ্ম্মও কখন, কর্ত্তব্য বলিয়া পরগণিত হয় বটে, কিন্তু বধকে কখনই ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না।’
“দ্যুমৎসেন কহিলেন, ‘বৎস! যদি তুমি বধ্যের অবধকেও ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ কর, তবে অধৰ্ম্ম কি? দস্যুদিগকে নিপাতিত না করিলে সমুদয় লোকই ক্রমে ক্রমে অসৎপথে পদার্পণ করে। কলিযুগে মনুষ্যগণ অন্যের বস্তু সমুদয় আত্মসাৎ করিতে চেষ্টা করে। সুতরাং দুষ্টের দমন না করিলে কিরূপে লোকযাত্রা নির্ব্বাহ হইবে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।’
“সত্যবান কহিলেন, “পিতঃ। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই তিন বর্ণকেই ব্রাহ্মণের অধীন করা উচিত। ইহারা ধর্ম্মপাশে আবদ্ধ হইলে সূত মাগধাদি ব্যক্তিরাও [সূতাদি নীচজাতীয় জনগণও] ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত হইবে। কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণের বাক্য অতিক্রম করিলে ব্রাহ্মণ তাহা রাজার নিকট প্রকাশ করিবেন। রাজা ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক বিজ্ঞাপিত হইলেই উদ্ধৃঙ্খল ব্যক্তির দণ্ডসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন। যাহাতে কাহারও দেহনাশ না হয়, সেইরূপ শাসন করা আবশ্যক। অপরাধীর কাৰ্য্য ও যথাবিধি নীতিশাস্ত্র পর্য্যালোচনা না করিয়া বিনাশাত্মক দণ্ডবিধান করা কখনই বিধেয় নহে। রাজা দস্যুগণের সংহার করিলে তাহাদিগের নিরপরাধ পিতা, মাতা, ভার্য্যা ও পুত্রগণ কালগ্রাসে নিপতিত হইয়া থাকে; অতএব নরপতি দস্যুকর্ত্তৃক অপকৃত হইলে সম্যকরূপে কৰ্তব্য অবধারণ করিবেন। কখন কখন অসাধু ব্যক্তিও সাধু হইতে সচ্চরিত্রতা লাভ করে এবং অসাধু হইতেও সুসন্তান উৎপন্ন হইয়া থাকে; অতএব লোকের প্রাণ বিনষ্ট করা কখনই কৰ্তব্য নহে। দণ্ডার্হ ব্যক্তিদিগকে বধ না করিয়া তাহাদের সর্ব্বস্ব হরণ, বন্ধন ও মস্তক মুণ্ডনাদিদ্বারা দণ্ড করাই বিধেয়। তাহাদিগকে বধ করিয়া তাহাদিগের পরিজনদিগকে ক্লেশ প্রদান করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। অপরাধিগণ পুরোহিত সভায় পুরোহিতের শরণাপন্ন হইয়া “আমরা আর কদাচ এইরূপ পাপাচার করিব না” বলিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তাহাদিগকে দণ্ডদান না করিয়া পরিত্যাগ করাই কর্ত্তব্য। বিধাতা এইরূপ শাসন নির্দ্দিষ্ট করিয়া গিয়াছেন। ব্রাহ্মণ অপরাধী হইলে তাঁহাকে অজিন ও দণ্ড ধারণ করাইয়া তাঁহার মস্তকমুণ্ডন করা কর্ত্তব্য। গুরুতর ব্যক্তিগণ অপরাধী হইলে তাঁহাদিগকে একবার ক্ষমা করা উচিত, কিন্তু তাঁহারা বারংবার অপরাধ করিলে তাঁহাদিগকে কখনই ক্ষমা করা বিধেয় নহে।’
“দ্যুমৎসেন কহিলেন, ‘বৎস! প্রজাগণকে সৎপথে আনয়ন করা ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। যদি প্রজারা রাজাজ্ঞা লঙ্ঘনপূর্ব্বক সৎপথে সমাগত হইতে বাসনা না করে, তাহা হইলে রাজা তাহাদিগকে যে কোন প্রকারে হউক, সম্মার্গগামী [১] করিতে চেষ্টা করিবেন। দস্যুগণ ধৰ্ম্মলঙ্ঘন করিলেও যদি তাহাদিগকে নিপাতিত না করা যায়, তাহা হইলে তাহাদের কর্ত্তৃক সমুদয় লোকই পরাভূত হইবে। পূৰ্ব্বকালে মানবগণ মৃদুস্বভাব, সত্যপরায়ণ, অল্পদ্রোহনিরত [সামান্যরূপ শত্রুতাকারী] ও ক্রোধবিহীন ছিল; সুতরাং তৎকালে ধিক্কাররূপ দণ্ড প্রদান করিলেই যথেষ্ট হইত। তৎপরে মনুষ্যগণের দোষ ক্ৰমশঃ বৃদ্ধি হওয়াতে বাগদণ্ড [তিরস্কার] ও ধনদণ্ড [অর্থদণ্ড—জরিমানা] প্রচলিত হয়। এক্ষণে কলিযুগে মানবগণ নিতান্ত পাপপরায়ণ হওয়াতে বধদণ্ড [প্রহার-প্রাণদণ্ডাদি] প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। এখন দস্যুদিগকে বধ করিয়াও অন্যান্য ব্যক্তিকে শাসন করা যায় না। এই ভূমণ্ডলমধ্যে কেহই কাহার নহে; বিশেষতঃ দস্যুদিগের সহিত মনুষ্য, দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব ও পিতৃগণের কোন বিশেষ সম্বন্ধ নাই; অতএব তাহাদিগকে বধ করিলে তাহাদিগের পরিজনগণের বিশেষ কষ্ট হইবার সম্ভাবনা কি? বিশেষতঃ যাহারা শ্মশান হইতে শবাভরণ [শবের অলঙ্কার] ও ভূতাবিষ্ট [ভূতে পাওয়া] অজ্ঞান ব্যক্তির নিকট হইতে বস্ত্রাদি গ্রহণ করে, শপথাদিদ্বারা তাহাদিগকে সৎপথে আনয়ন করা কাহার সাধ্য?’
“সত্যবান্ কহিলেন, “পিতঃ! যদি আপনি হিংসা না করিয়া দস্যুদিগকে সাধু করিতে না পারেন, তাহা হইলে নরমেধ যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা তাহাদিগের সংহার করুন। রাজ্যে দস্যুভয় উপস্থিত হইলে ভূপতিদিগকে লজ্জিত হইতে হয়, এই নিমিত্ত তাঁহারা প্রজাগণের হিতাকাঙ্ক্ষী হইয়া দস্যুভয়নিবারণাৰ্থ তপস্যা করিয়া থাকেন। যখন ভয়-প্রদর্শনদ্বারা প্রজাগণকে সচ্চরিত্র করা যায়, তখন ইচ্ছা করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করা কর্ত্তব্য নহে। অতএব নরপতিগণ সদ্ব্যবহারদ্বারাই প্রজাগণের শাসন করিবেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যেরূপ ব্যবহার করেন, ইতর ব্যক্তিরাও ক্রমশঃ সেইরূপ ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়। যে রাজা স্বীয় চরিত্র সংশোধন না করিয়া প্রজার চরিত্রশোধনে যত্নবান হয়েন, সেই ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র বিষয়াসক্ত ভূপতিকে নিশ্চয়ই উপহাসাস্পদ হইতে হয়। যে ব্যক্তি দম্ভ ও মোহবশতঃ রাজার অল্পমাত্রও অহিতাচরণ করে, নরপতি বিবিধ উপায়দ্বারা তাহার শাসন করিয়া তাহাকে পাপ হইতে মুক্ত করিবেন। যে রাজা কুকৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার সর্ব্বাগ্রে আপনার চিত্ত বিশুদ্ধ করা আবশ্যক। বন্ধু ও পুত্ৰাদি অপরাধী হইলে তাহাদিগের প্রতি কঠিন দণ্ডবিধান করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে রাজ্যে পাপনিরত নীচ ব্যক্তিরা বিষম দুঃখভোগ না করে, সেই রাজ্যে নিশ্চয়ই পাপের বৃদ্ধি ও ধর্ম্মের হ্রাস হইয়া থাকে।
‘পূৰ্ব্বে একজন দয়াশীল বিদ্বান ব্রাহ্মণ আমাকে এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন এবং পূৰ্ব্বপিতামহগণও আমাকে এইরূপ কহিয়া গিয়াছেন। সত্যযুগে নরপতিগণ আশ্বাস প্রদান ও দয়াপ্রকাশপূর্ব্বক প্রজাগণকে বশীভূত করিতেন। যদি ত্রেতাযুগে ত্রিপাদধৰ্ম্ম, দ্বাপরযুগে দ্বিপাদধর্ম্ম ও কলিযুগে একপাদমাত্র ধর্ম্ম লক্ষিত হয়, তথাপি ঐ সকল যুগে প্রাণনাশরূপ দণ্ড পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্যবিধ দণ্ড প্রদান করাই রাজার উচিত। রাজার দুশ্চরিত্রতা নিবন্ধন কলিযুগ প্রবল হইলে ক্রমে ক্রমে একপাদমাত্র ধৰ্ম্মেরও ষোড়শাংশের একাংশমাত্র অবশিষ্ট থাকে; কিন্তু তখনও বধরূপ দণ্ডবিধান করা বিধেয় নহে। অহিংসারূপ দণ্ডদ্বারা প্রজাপালন করিলে সাধুদিগের পীড়ন করা হয় না; অতএব রাজা আয়ু, শক্তি ও কাল বিবেচনা করিয়া প্রজার দণ্ডবিধান করিবেন। স্বায়ম্ভূব মনু প্রাণীগণের প্রতি দয়া করিয়া কহিয়া গিয়াছেন, যাহারা ব্ৰহ্মলাভের অভিলাষ করেন, তাহাদিগের তত্ত্বজ্ঞান পরিত্যাগ করা কখনই কৰ্ত্তব্য নহে।’ ”