২৬৬তম অধ্যায়
জয়দ্রথের কুপ্ৰস্তাবে দ্ৰৌপদীকর্ত্তৃক তিরস্কার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরনাথ! সমুদয় রাজগণ তথায় সমূপবিষ্ট হইলে পর কোটিকাস্য দ্রৌপদীসমক্ষে যাহা যাহা কহিয়াছিলেন, তৎসমুদয় তাঁহাদিগের নিকট কহিলেন। পাপাত্মা জয়দ্ৰথ কোটিকাস্যের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিল, “হে শৈব্য! ঐ সর্ব্বলোকলালামভূতা ললনার বাক্য শ্রবণমাত্র আমার মন উহাতে রত হইয়াছে; তুমি কিরূপে উহার নিকট হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলে? আমি যে অবধি উহাকে অবলোকন করিয়াছি, তদবধি অন্যান্য কামিনীগণকে বানরী বলিয়া আমার বোধ হয়। ঐ কামিনী দর্শনাবধি আমার মনোহরণ করিয়াছে; অতএব সে মানুষী কি না, আমাকে বল।”
কোটিকাস্য কহিলেন, “ঐ কামিনী রাজতনয়া; উহার নাম দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের মহিষী; তাঁহারা সকলেই উহার প্রতি একান্ত অনুরক্ত। তুমি উহাকে লইয়া সৌবীরাভিমুখে প্ৰস্থান কর।”
বৃক যেমন সিংহগোষ্ঠে প্রবেশ করে, তদ্রূপ দুষ্টমতি জয়দ্রথ কোটিকাস্যের বাক্য-শ্রবণানন্তর ‘আমি দ্রৌপদীকে দেখিব’ বলিয়া পাণ্ডবগণের আশ্রমে প্রবেশ করিল এবং কৃষ্ণাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, “হে বরারোহে! তোমার মঙ্গল ত’? তুমি সতত যাঁহাদের কুশল কামনা কর, তাঁহারা সকলে ও তোমার ভর্ত্তৃগণ ত’ কুশলে আছেন?”
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “তোমার রাজ্য, কোষ ও বলের কুশল ত’? তুমি একাকী ধর্ম্মানুসারে সৌবীর ও সন্ধিদেশ ত’ উত্তমরূপে শাসন করিতেছ? মহারাজ যুধিষ্ঠির ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ প্রভৃতি আমরা সকলেই কুশলে আছি। তুমি আর যাঁহাদের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, তাহাদের সকলেরই মঙ্গল। এই পাদ্য ও আসন গ্ৰহণ কর। আমি তোমার প্রাতরাশ [প্ৰাতঃকালীন খাদ্যদ্রব্য]-সম্পাদনের নিমিত্ত পঞ্চশত মৃগ প্রদান করিতেছি। কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির আসিয়া স্বয়ং তোমাকে এণ, পৃষত, ন্যঙ্কু, হরিণ, শরভ, শশ, ঋক্ষ, রুরু, শম্বর, গবয়, বরাহ ও মহিষ প্রভৃতি বিবিধ পশুরাশি প্রদান করিবেন।”
জয়দ্ৰথ কহিলেন, “হে বরাননে! তুমি আমাকে যে-সমুদয় প্রাতরাশ প্রদান করিতে বাসনা করিয়াছ, উহা পরমোৎকৃষ্ট। এক্ষণে আমার রথে আরোহণ কর; সুখে কালযাপন করিবে। শ্ৰীহীন হৃতরাজ্য অরণ্যচারী পাণ্ডবগণের আর উপাসনা করিও না। প্রাজ্ঞ-ব্যক্তিরা শ্ৰীহীন ভর্ত্তার উপাসনা করেন না। হে নিতম্বিনি! সাতিশয় কষ্টস্বীকার করিয়া রাজ্যভ্ৰষ্ট শ্ৰীবিহীন পাণ্ডুতনয়গণের প্রতি ভক্তি করার কোন আবশ্যক নাই। উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া আমার ভাৰ্য্যা হও, তাহা হইলে আমার সহিত সমুদয় সিন্ধু ও সৌবীররাজ্য পরমসুখে যাবজ্জীবন ভোগ করিতে পরিবে।’
দ্রুপদতনায়া পাঞ্চালী জয়দ্রথ-মুখে এই হৃদয়কম্পন বাক্য শ্রবণ করিয়া ভ্রূকুটিমুখে তাহার বাক্যে অনাস্থ্য প্রদর্শনপূর্ব্বক তথা হইতে গমন করিতে উদ্যত হইয়া সিন্ধুরাজকে কহিলেন, “রে দুরাত্মন! তোমার লজ্জা হয় না? তুমি এরূপ বাক্য কদাচ প্রয়োগ করিও না।” জয়দ্ৰথ তাহাতেও ক্ষান্ত না হওয়াতে দ্রৌপদী স্বীয় পতিগণের আগমন প্রতীক্ষা করিয়া মিষ্টবাক্যদ্বারা সেই দুরাত্মাকে প্রলোভিত করিতে লাগিলেন।