২৬৫. গোমেধযজ্ঞের নিন্দা—বিচখনৃপসংবাদ

২৬৫তম অধ্যায়

গোমেধযজ্ঞের নিন্দা—বিচখনৃপসংবাদ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! মহারাজ বিচখ্যু প্রাণীগণের প্রতি সদয় হইয়া যাহা বলিয়া গিয়াছেন, এক্ষণে সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে ঐ নরপতি গোমেধযজ্ঞে যজ্ঞভূমিস্থ নির্দ্দয় ব্রাহ্মণগণ ও ক্ষতদেহ বৃষকে দর্শন এবং গোসমূহের আর্ত্তনাদ শ্রবণপূৰ্ব্বক দয়া হইয়া কহিয়াছিলেন, আহা! গোসমুদয় কি কষ্ট ভোগ করিতেছে! অতঃপর সমুদয় লোকে গোসমূহের মঙ্গললাভ হউক। বিশৃঙ্খল সংশায়াত্মা মূঢ়প্রকৃতি নাস্তিকেরাই হিংসাযজ্ঞকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছে। মানবগণ কেবল কামনার বশবর্তী হইয়াই যজ্ঞভূমিতে পশুহিংসা করিয়া থাকে। ধর্ম্মপরায়ণ মনু অহিংসারই প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। অতএব সেই প্রমাণানুসারে সূক্ষ্ম ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করাই পণ্ডিতগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। অহিংসাই সমুদয় ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানবান ব্যক্তি দৃঢ়ব্রত হইয়া বেদোক্ত ধৰ্ম্মফল ও গৃহস্থাচার পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করিবে। ক্ষুদ্রস্বভাব ব্যক্তিরাই ফলাকাঙ্ক্ষী হইয়া থাকে। যেসকল মনুষ্য যজ্ঞ, বৃক্ষ ও যূপগণের উদ্দেশ্যে পশুচ্ছেদন করিয়া বৃথামাংস ভোজন করে, তাহাদিগের সেই কৰ্ম্ম কখনই প্রশংসনীয় নহে। ধুৰ্ত্তেরাই মদ্য, মাংস, মধু [মদ্য-মধুমক্ষিকা-আহৃত মধুপানে বেদের নিষেধ নাই, পরন্তু বেদ বিহিত শ্রাদ্ধে ‘মধু বাতা ঋতায়তে’ মন্ত্রের প্রশংসাই কীৰ্ত্তিত আছে। নেশার জন্য পেয় যে মধু, তাহা কোনপ্রকার উগ্ৰমাদক মদ্য। মহিষাসুর যুদ্ধে দেবী এই মধু পান করিয়াছিলেন, ইহা যে মদ্য তাহা কাহারও মত। “গর্জ্জ গর্জ্জ ক্ষণং মূঢ়! মধু যাবৎপিবাম্যহম্” (চণ্ডী)। ], মৎস্য, তালরস ও যবাগূতে আসক্ত হইয়া থাকে। বেদে ঐ সমুদয় ভক্ষণের বিধি নাই। বস্তুতঃ কাম, লোভ ও মোহবশতঃই লোকের ঐ সকল দ্রব্যে প্রবৃত্তি হইয়া থাকে। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ সমুদয় যজ্ঞেই বিষ্ণুর আবির্ভাব আছে, ইহা পরিজ্ঞাত হইয়া বেদকল্পিত যজ্ঞীয় বৃক্ষ, পুষ্প ও সুস্বাদু পায়সদ্বারা তাতাঁর আরাধনা করিয়া থাকেন। শুদ্ধভাবাপন্ন মহানুভবগণকর্ত্তৃক যে-যে বস্তু উৎকৃষ্ট বলিয়া পরিগণিত হয়, তৎসমুদয়ই দেবোদ্দেশে প্রদান করা যাইতে পারে, সন্দেহ নাই।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপদ শরীরকে শুষ্ক করে এবং শরীর আপদের নাশ ইচ্ছা করে; অতএব নিতান্ত হিংসাবিহীন হইলে কিরূপে লোকযাত্ৰা নির্ব্বাহ হইতে পারে?”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মানবগণ যাহাতে শরীর বিনষ্ট হয় এবং অহিংসা-ধৰ্ম্ম প্রতিপালিত হয়, এরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে।”