২৬৪. হিংসা-অহিংসাতত্ত্ব—জাজলি-পক্ষিগণসংবাদ

২৬৪তম অধ্যায়

হিংসা-অহিংসাতত্ত্ব—জাজলি-পক্ষিগণসংবাদ

ভীষ্ম কহিলেন, ‘মহাত্মা তুলাধার পুনঃ জাজলিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আপনি সাধু ও অসাধু এই উভয়বিধ লোকের মধ্যে কাহারা অহিংসারূপ ধৰ্ম্মকে আশ্রয় করে, ইহা প্রত্যক্ষ করিলেই অহিংসা প্রধান ধর্ম্ম কি না, তাহা অবগত হইতে পারিবেন। ঐ দেখুন, আপনার মস্তকসম্ভূত পক্ষিগণ এই স্থানে বিচরণপূর্ব্বক পক্ষপাদাদি সঙ্কুচিত করিয়া স্ব স্ব কুলায়মধ্যে প্রবিষ্ট হইতেছে। আপনি উহাদিগের প্রতি সুতনির্ব্বিশেষে স্নেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন বলিয়া উহারাও আপনাকে পিতার ন্যায় সম্মান করিতেছে। আপনি উহাদিগের পিতাস্বরূপ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। উহারাই আপনার অহিংসা প্রধান ধর্ম্ম কি না, এই সন্দেহ নিরাকৃত করিবে।’

“তুলাধার এই কথা কহিলে, মহাত্মা জাজলি পক্ষিগণকে আহ্বান করিবামাত্র তাহারা সমাগত হইয়া তুলাধারের আদেশানুসারে জাজলিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘ব্রহ্মন্‌! অহিংসাদি কর্ম্মসমুদয় উভয় লোকেই মানবগণকে পরিত্রাণ করে, আর হিংসাদি কৰ্ম্ম লোকের বিশ্বাস বিনষ্ট করে। বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়, সন্দেহ নাই। যাহারা শমদমাদিগুণে বিভূষিত হইয়া লাভালাভে সমান জ্ঞান এবং ফলানুসন্ধান না করিয়া কেবল শাস্ত্ৰশাসননিবন্ধন যজ্ঞানুষ্ঠান করে, তাহারাই ধৰ্ম্মের যথার্থ ফলভাগী হইয়া থাকে।

শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা—মহর্ষি ধর্ম্মদর্শনের ব্রহ্মগীতি

‘ব্রহ্মবিষয়িণী শ্ৰদ্ধা সত্ত্বগুণ হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। ঐ শ্রদ্ধা সকলকে প্রতিপালন ও বিশুদ্ধ জন্ম প্রদান করিয়া থাকে। উহা ধ্যান ও জপ হইতে শ্রেষ্ঠ। কৰ্ম্ম মন্ত্রবিহীন বা ব্যগ্রতানিবন্ধন অঙ্গহীন হইলেও একমাত্র শ্রদ্ধাভাবে অনায়াসে সুসম্পন্ন হয়; কিন্তু উহা শ্রদ্ধাবিহীন হইলে কি মন্ত্র, কি অনুষ্ঠান, কি যজ্ঞ, কিছুতেই সুসিদ্ধ হইতে পারে না। এই উপলক্ষে পূর্ব্ববৃত্তান্তবেত্তারা যে ব্রহ্মগীত বাক্য কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ কর। দেবতারা শ্রদ্ধাবিহীন পবিত্র ও পরিত্ৰতাবিহীন শ্রদ্ধাবান্ এই উভয়ের যজ্ঞে প্রতিপাদিত ধন সমান এবং বেদজ্ঞ কৃপণ ও অতিবদান্য বৃদ্ধিজীবী এই উভয়ের অন্ন তুল্য বলিয়া নির্ণয় করাতে ভগবান প্রজাপতি তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবগণ! তোমাদিগকে এরূপ নিরূপণ করা ন্যায়ানুগত হয় নাই। শ্রদ্ধাবান ও পবিত্র এই উভয়ের মধ্যে অশ্রদ্ধানিবন্ধন পবিত্র ব্যক্তিই অপেক্ষাকৃত নিন্দনীয় এবং বেদজ্ঞ কৃপণ ও অতিবদান্য বৃদ্ধিজীবী এই উভয়ের মধ্যে বেদজ্ঞ কৃপণের অন্ন গ্রহণ করা কর্ত্তব্য; কিন্তু বৃদ্ধিজীবী ব্যক্তি অতিবদান্য হইলেও তাহার অন্ন গ্রহণ করা কদাপি বিধেয় নহে। ফলতঃ ধৰ্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিরা শ্রদ্ধাবিহীন ব্যক্তির যজ্ঞানুষ্ঠানে অধিকার নাই ও তাহার অন্ন অভক্ষ্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। অশ্রদ্ধা অপেক্ষা গুরুতর পাপ ও শ্রদ্ধা অপেক্ষা পাপনাশের প্রধান উপায় আর কিছুই নাই। সর্প যেমন স্বীয় জীর্ণ নির্ম্মোক পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি শ্রদ্ধাবলে পাপকে দূরীকৃত করিয়া থাকেন। শ্রদ্ধাসহকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হওয়া সমুদয় পবিত্র কার্য্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যিনি স্বভাবতঃ দোষসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শ্রদ্ধাবান হইতে পারেন, তিনিই যথার্থ পবিত্র। তাঁহার তপস্যা, আচার, ব্যবহার ও অন্যান্য প্রযত্নে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। জগতীস্থ সমুদয় জীব শ্রদ্ধাময়। সমুদয় লোকেরই সত্ত্ব, রজ ও তম এই গুণত্রয়ের অন্যতমে শ্রদ্ধা থাকে। তন্মধ্যে যাহার সত্ত্বগুণে শ্রদ্ধা থাকে, সে সাত্ত্বিক; যাহার রজোগুণে শ্রদ্ধা থাকে, সে রাজস ও যাহার তমোগুণে শ্রদ্ধা থাকে, সে তামস বলিয়া বিখ্যাত হয়। ধর্ম্মার্থদর্শী সাধুব্যক্তিরা এইরূপে ধৰ্ম্ম নির্দ্দেশ করিয়াছেন। আমরা মহর্ষি ধর্ম্মদর্শনের নিকট ধর্ম্মবিষয় জিজ্ঞাসা করাতে তিনি এইরূপ ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। অতএব আপনি শ্রদ্ধাবান্ হউন, তাহা হইলেই ধৰ্ম্ম লাভ করিতে পারিবেন। স্বপথস্থিত শ্রদ্ধাবান্ ব্যক্তিই ধার্ম্মিক ও সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! অনন্তর মহর্ষি জাজলি ও তুলাধার উভয়ে স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন এবং অনতিকালবিলম্বে স্ব স্ব কৰ্ম্মপ্রভাবে স্বর্গারোহণপূৰ্ব্বক পরমসুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহাত্মা জাজলি মহানুভব তুলাধারের নিকট বিবিধ সনাতন ধর্ম্ম শ্রবণপূৰ্ব্বক শান্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন। এই আমি তোমার নিকট তুলাধারের সমুদয় কথা কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আর কি শ্রবণ করিতে বাসনা হয়, প্রকাশ কর।”