২৬৩তম অধ্যায়
নিষ্কাম ও সকাম যজ্ঞের গুণাগুণবর্ণন
“জাজলি কহিলেন, “হে বণিক! তুমি বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইয়া এই ধৰ্ম্মনির্দ্দেশপূৰ্ব্বক মনুষ্যদিগের স্বর্গদ্বার ও বৃত্তি রোধ করিতেছ। কৃষিকাৰ্য্যদ্বারা ধান্যাদি উৎপন্ন হয়। তুমিও এই ধান্যাদিদ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া জীবিত রহিয়াছ। মনুষ্যেরা পশু ও ধান্যাদিদ্বারাই জীবন ধারণ করিতেছে। উহারা জীবিত থাকিয়া পশ্চাৎ যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে। তুমি এক্ষণে নিতান্ত নাস্তিকের ন্যায় বাক্য প্রয়োগ করিলে। জীবিকা পরিত্যাগ করিয়া কি কেহ কখন জীবন ধারণ করিতে সমর্থ হয়?
“তুলাধার কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মন! জীবগণ যেরূপে জীবিকা নির্ব্বাহ করিবে, তাহা আমি আপনার নিকট কীৰ্ত্তন করিব। আপনি আমাকে নাস্তিক জ্ঞান করিতেছেন, বস্তুতঃ আমি নাস্তিক নহি এবং যজ্ঞেরও নিন্দা করি না। কিন্তু যজ্ঞের অনুষ্ঠানবিশেষ পরিজ্ঞাত আছে, এরূপ লোক নিতান্ত দুর্লভ। আমি ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য, অন্তর্য্যাগ ও অন্তর্য্যাগবেত্তা মহাত্মাদিগকে নমস্কার করি। যাহা হউক, এক্ষণে ব্রাহ্মণেরা আপনাদের কর্ত্তব্য, অন্তর্য্যাগ [সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক যাগ—মানসযজ্ঞ] পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্ষত্রিয়গণের কর্ত্তব্য হিংসাময় জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। দেখুন, লুব্ধস্বভাব ধনপরায়ণ আস্তিকেরা বেদবাক্যের যথার্থ মৰ্ম্ম অবগত না হইয়া, সত্যের ন্যায় লক্ষিত মিথ্যাময় ক্ষত্রিয়যজ্ঞের অনুষ্ঠান ও যজমানকে বিবিধ বস্তুদানে উৎসাহ প্রদান করিয়া থাকেন। যজমান সেই সমস্ত দ্রব্য সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার অসৎ উপায় অবলম্বন করে এবং তন্নিমিত্ত নানাপ্রকার তস্কর প্রভৃতি বিবিধ অসকাৰ্য্যের প্রাদুর্ভাব হয়। যে হবনীয় দ্রব্য ন্যায়পথে উপার্জ্জিত হয়, তদ্বারাই দেবতারা সন্তোষলাভ করিয়া থাকেন। শাস্ত্রে এইরূপ নির্ণত আছে যে, নমস্কার, হবিঃ, স্বাধ্যায় ও ওষধিদ্বারা দেবগণের পূজা সমাহিত হইয়া থাকে। যাহারা কামনাসম্পন্ন হইয়া ইষ্টাপূৰ্ত্তাদি অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগের সেই সমস্ত যজ্ঞপ্রভাবে লুব্ধ সন্তান উৎপন্ন হয়। লুব্ধ হইতে লুব্ধ ও রাগদ্বেষাদিশূন্য ব্যক্তি হইতে রাগদ্বেষশূন্য পুত্র উৎপন্ন হইয়া থাকে। যজমান ও ঋত্বিক্ সকাম হইলে তাহাদের পুত্র সকাম ও নিষ্কাম হইলে তাহাদিগের সন্তানও নিষ্কাম হয়, সন্দেহ নাই। যেমন নভোমণ্ডল হইতে নিৰ্ম্মল সলিল উৎপন্ন হয়, সেইরূপ যাগযজ্ঞ হইতে পুত্রের উৎপত্তি হইয়া থাকে।
হুতাশনে আহুতি প্রদান করিলে তাহা আদিত্যমণ্ডলে সংক্রামিত হয়। পরে আদিত্য হইতে বৃষ্টি, বৃষ্টি হইতে অন্ন ও অন্ন হইতে প্রজা উৎপন্ন হইয়া থাকে। পূর্ব্বতন ব্যক্তিরা কামনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া আনুষঙ্গিক সমস্ত কামনা লাভ করিয়াছিলেন। তৎকালে তাঁহাদিগকে মনোরথ পূর্ণ করিবার নিমিত্ত হিংসাধৰ্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে হইত না। পৃথিবী লাঙ্গলদ্বারা কর্ষিত না হইয়াই প্রচুর ফল উৎপন্ন করিত। জগতের শুভানুধ্যানদ্বারাই লতাদি সঞ্জাত হইত। ঐ সমস্ত পূর্ব্বতন পুরুষ যজ্ঞকে ফলপ্রদ ও আত্মাকে ফলভাগী বলিয়া বিবেচনা করিতেন না।
‘যাহারা যজ্ঞে ফল জন্মে কি না, এইরূপ সংশয় করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করে, তাহাদিগকে পরজন্মে অসাধু, ধূর্ত্ত ও লুব্ধপ্রকৃতি হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে হয়। যে ব্যক্তি কুতর্কদ্বারা দেবগণকে অশুভফলসম্পাদক বলিয়া প্রতিপন্ন করে, সেই অকৃতজ্ঞ আপনার অশুভ কৰ্ম্মপ্রভাবে পাপাত্মাদিগের গতি লাভ করিয়া থাকে। যিনি নিত্যকর্ম্মকে কর্ত্তব্য বলিয়া অবগত আছেন, যিনি সেই নিত্যকর্ম্মে অকারণে ভীত হন, যিনি ব্রহ্মকে মন্ত্ৰাগ্যাদিরূপে [মন্ত্র ও অগ্নি প্রভৃতি রূপে] অবস্থিত বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকেন এবং যাঁহার আপনাতে কর্ত্তৃত্বাভিমান নাই তিনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ। তাঁহার কাৰ্য্যে অঙ্গহানি হইলেও উহা শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হয়। যদি শূকরাদি জন্তু তাঁহার যজ্ঞের ব্যাঘাত জন্মাইয়া দেয়, তাহাও উৎকৃষ্ট; কিন্তু যেসকল ব্যক্তি সকাম হইয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে, তাহাদের এইরূপ ব্যাঘাত উপস্থিত হইলে তাহাদিগকে প্রায়শ্চিত্তদ্বারা শুদ্ধিলাভ করিতে হয়। পরমপুরুষার্থলাভে লোলুপ বৈরাগ্যযুক্ত ও মসৎসরতাশূন্য ব্যক্তিরা সত্যপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া থাকেন। যাঁহারা দেহ ও আত্মার বিষয় অবগত আছেন, যোগই তাহাদের প্রধান কার্য্য। যাঁহারা সতত প্রণব পাঠ করিয়া থাকেন, তাঁহারা অনায়াসে অন্যকে সন্তুষ্ট করিতে সমর্থ হয়েন।
‘ব্রহ্মই সমস্ত দেবতা; যাঁহারা সেই ব্রহ্মকে অবগত আছেন, দেবতারা তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া থাকেন। তিনি সন্তুষ্ট থাকিলে দেবতারা সন্তুষ্ট হয়েন এবং তিনি ভোগসুখে তৃপ্ত হইলে তাঁহারাও তৃপ্তিলাভ করিয়া থাকেন। যেমন কোন ব্যক্তি সমস্ত রস আস্বাদনপূর্ব্বক পরিতৃপ্ত হইলে নীরস দ্রব্য অভিলাষ করে না, সেইরূপ যিনি জ্ঞানতৃপ্ত, তিনি অন্য কোন বিষয়ে তৃপ্তিসুখ অনুভব করেন না। যাঁহারা ধর্ম্মের আধার, কাৰ্য্যাকাৰ্য্যবিচারসমর্থ এবং যাঁহারা ধৰ্ম্মেই সুখানুভব করেন, তাঁহারা অন্তরাত্মাতে পরমাত্মাকে অবস্থিত অবলোকন করিয়া থাকেন। যাঁহারা জ্ঞানবান, সংসারসাগরের পরপারাভিলাষী, তাঁহারা যে স্থানে শোক, দুঃখ ও পতনের ভয় নাই, সেই পবিত্র-জনসেবিত পরম পাবন ব্রহ্মলোকে গমন করেন। তাঁহারা স্বর্গ, যশ বা ধনলাভের অভিলাষে যজ্ঞানুষ্ঠান করেন না; কেবল সজ্জনসেবিত পথের অনুসরণ করিয়া থাকেন এবং হিংসাধৰ্ম্মে লিপ্ত না হইয়া যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন। ঐ সকল মহাত্মা বনস্পতি, ওষধি ও ফলমূলকেই যজ্ঞসাধক বলিয়া অবগত আছেন। লুব্ধস্বভাব ঋত্বিক্গণ উঁহাদিগের নিকট কিছুমাত্র ফললাভের প্রত্যাশা নাই বলিয়া উহাদিগকে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান করান না। যেসকল ব্রাহ্মণ যথার্থ জ্ঞানবান, তাঁহার আপনাদিগকেই যজ্ঞীয় উপকরণরূপে কল্পনা করিয়া প্রজাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত মানসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। আর লুব্ধ ঋত্বিগণ স্বর্গলাভাই ব্যক্তিদিগকেই যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করাইয়া থাকেন এবং স্বধৰ্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা প্রজাদিগের স্বর্গলাভের উপায়বিধান করিয়া দেন। আমি এই উভয়বিধ সম্প্রদানের কাৰ্য্য দর্শন করিয়া সৎকার্য্যেরই অনুসরণ করিয়া থাকি।
‘সকাম ব্রাহ্মণ হিংসাত্মক ও জ্ঞানী ব্রাহ্মণ মানসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। তাঁহারা উভয়েই দেবগণের নির্দ্দিষ্ট পথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক গমন করেন, কিন্তু যিনি তন্মধ্যে সকাম, তিনি পুনরায় ভূমণ্ডলে আগমন করেন; আর যিনি জ্ঞানী, তাঁহাকে আর প্রতিনিবৃত্ত হইতে হয় না। জ্ঞানীদিগের সংকল্পমাত্রেই বৃষসকল যানে যোজিত হইয়া উহাদিগকে বহন এবং ধেনুসকল দুগ্ধ প্রদান করিয়া থাকে। তাঁহারা সঙ্কল্পমাত্রেই ঘূপগ্রহণপূৰ্ব্বক প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে যজ্ঞানুষ্ঠানে সমর্থ হয়েন। যাঁহারা এইরূপে যোগবলে বিশুদ্ধচিত্ত হইয়াছেন, তাঁহারা যজ্ঞে গোহত্যা করিলেও করিতে পারেন। কারণ, তাঁহাদিগকে গোবধজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না; তথাপি তাহারা পশুঘাতে একান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া ওষধিদ্বারাই যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। আর সকাম মূঢ় ব্যক্তিরা ওষধি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পশুহিংসাদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। হে তপোধন! আমি সকাম ও ত্যাগশীল জ্ঞানীর মধ্যে জ্ঞানীর কাৰ্য্যই সর্ব্বোৎকৃষ্ট অবগত হইয়া তাঁহারই বিষয় সবিশেষ নির্দ্দেশ করিলাম। এক্ষণে কিরূপ হইলে জ্ঞানী বলিয়া নিরূপিত হইতে পারে, তাহাও সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘যিনি কৰ্ম্মফলপ্রত্যাশাবিরহিত ও কর্ম্মোদযোগশূন্য, যিনি অন্যের নমস্কার প্রতিগ্রহ বা অন্যকে নমস্কার করিতে সতত পরাঙ্মুখ থাকেন, যিনি অন্যের স্তবে তুষ্টিলাভ বা অন্যকে স্তব করেন না, যাঁহার কর্ম্মসমুদয় ক্ষয় হইয়া গিয়াছে এবং যিনি ব্ৰহ্মনন্দে পরিপূর্ণ, তিনিই যথার্থ জ্ঞানবান্ ব্রাহ্মণ। যে ব্যক্তি অন্যকে জ্ঞানোপদেশ প্রদান করে না এবং যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা ব্রাহ্মণগণকে অর্থদান না করিয়া কেবল আপনার অভিলাষানুসারে ভোগ্যবস্তু উপভোগ করে, সে কি দেবমার্গ, কি পিতৃমার্গ, কোন পথেই গমন করিতে সমর্থ হয় না। কিন্তু যিনি পূর্ব্বোক্ত নিষ্কাম ধৰ্ম্ম অবলম্বন করেন, তাঁহার ব্রহ্মপ্রাপ্তি হইয়া থাকে।’
“জাজলি কহিলেন, ‘হে বণিক! আমি আত্মজীদিগের তত্ত্ব কদাচ শ্রবণ করি নাই; উহা নিতান্ত দুরবগাহ। পূর্ব্বতন মহর্ষিগণের মধ্যে অনেকেই ইহার আলোচনা করেন নাই এবং যাঁহারা আলোচনা করিয়াছিলেন, তাঁহারাও তাহা সুপ্রচারিত করেন নাই। যাহা হউক, এক্ষণে যেসকল পশুপ্ৰায় মূঢ় ব্যক্তি মানসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে সমর্থ নহে, তাহা তুমি সবিস্তর কীৰ্ত্তন কর। তোমার বাক্যে আমার অতিশয় শ্রদ্ধা হইয়াছে।’
“তুলাধার কহিলেন, “তপোধন! যে দাম্ভিক পুরুষদিগের যজ্ঞ সম্যক অনুষ্ঠিত হইলেও তাহাদের দোষে অজ্ঞরূপে পরিণত হয়, তাহারা কোন যজ্ঞের অধিকারী নহে। যাঁহারা শ্রদ্ধাবান্ ও সমর্থ, তাঁহারা ঘৃত, দুগ্ধ, দধি ও পূর্ণাহুতিদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। আর যাঁহারা অসমর্থ, তাঁহারা গোপুচ্ছ ও গোশৃঙ্গক্ষালিত সলিল [গরুর শিংধোয়া জল] এবং গোপাদরজদ্বারা যজ্ঞ নির্ব্বাহ করেন। এইরূপে একমাত্র ধেনুই সমর্থ ও অসমর্থ উভয়েরই যজ্ঞানুষ্ঠানের সম্যক সহায়তা সম্পাদন করিয়া থাকে। যাঁহারা এইরূপে ঘৃতাদি দ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করেন, তাঁহাদিগের একমাত্র শ্রদ্ধাই সহধর্ম্মিণীর কাৰ্য্য সম্পাদন করে। এইরূপে পরম শ্রদ্ধা সহকারে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হইবে। অতএব পশুহিংসা অপেক্ষা পুরোডাশদ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করাই শ্রেয়স্কর। সকল নদীই সরস্বতীর ন্যায় শুদ্ধিপ্রদ, সমস্ত পৰ্ব্বতই পরম পবিত্র। ফলতঃ যে স্থানে আত্মার সহিত মনের সংযোগ হয়, সেই স্থানই উৎকৃষ্ট তীর্থ। অতএব তুমি তীর্থ পর্য্যটনৰ্থ দেশবিদেশ গমন করিও না। যে ব্যক্তি জ্ঞানী হইয়া এইরূপ ধৰ্ম্মাচরণ করে, তাহার নিশ্চয়ই শুভলোকপ্রাপ্তি হয়।’
“হে যুধিষ্ঠির! তুলাধার এইরূপ যুক্তিসম্মত সজ্জনসেবিত ধৰ্ম্মের সবিশেষ প্রশংসা করিয়াছেন।”