২৬১তম অধ্যায়
ধর্ম্মসিদ্ধান্ত—তুলাধার-জাজলি রাক্ষসসংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে তুলাধার। জাজলি-রাক্ষসসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে জাজলিনামে এক বনচারী ব্রাহ্মণ সমুদ্রতটে আগমনপূৰ্ব্বক ঘোরতর তপস্যার অনুষ্ঠানে নিরত হইয়াছিলেন। ঐ অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ ঐ স্থানে চীর [বস্ত্রখণ্ড], অজিন [মৃগাদির চর্ম্ম] ও জটাধারণপূৰ্ব্বক পঙ্কদিগ্ধাঙ্গ [কাদামাখা দেহে], সংযমী ও নিয়মিত আহারী হইয়া অসংখ্য বৎসর অতিবাহিত করেন। একদা ঐ মহাতেজস্বী তপঃপ্রভাবে জলমধ্যে অবস্থানপূৰ্ব্বক ধ্যানবলে সমুদয় লোক বিচরণ ও নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিলেন যে, “এই বিশ্বসংসারমধ্যে আমিই অদ্বিতীয়। জলমধ্যে অবস্থান করিয়া আকাশগত গ্রহনক্ষত্রাদি অবগত হওয়া আমি ভিন্ন আর কাহারও সাধ্য নহে।’
‘তপস্বী জাজলি এই কথা বলিবামাত্র রাক্ষসগণ শূন্য হইতে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে কহিল, ‘ভদ্র! এরূপ বাক্যোচ্চারণ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। বারাণসীমধ্যে বণিক্ধর্ম্মাবলম্বী তুলাধার নামে যে যশস্বী মহাপুরুষ অবস্থান করিয়া থাকেন, তিনিও কখন এরূপ কথা উচ্চারণ করিতে পারেন না।’ রাক্ষসগণ এই কথা কহিলে মহাতপাঃ জাজলি তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘নিশাচরগণ! আমি সেই বিজ্ঞবর মহাযশস্বী তুলাধারের সহিত সাক্ষাৎকার করিতে অভিলাষ করি।’ তখন রাক্ষসগণ তাহাকে সমুদ্রমধ্য হইতে উদ্ধৃত করিয়া কহিলেন, ‘দ্বিজবর! তুমি এই পথ অবলম্বন করিয়া বারাণসীতে গমন কর।’ রাক্ষসগণ এইরূপে পথপ্রদর্শন করিলে জাজলি তাহাদের নির্দ্দিষ্ট পথ অবলম্বনপূর্ব্বক বারাণসীতে গমন করিয়া তুলাধারের সহিত সাক্ষাৎকার করিলেন।
জাজলির তপস্যা-বৃত্তান্ত
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! জাজলি পূৰ্ব্বে কি কঠোর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া অতি উৎকৃষ্ট সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বানপ্রস্থ-ধৰ্ম্মবেত্তা ভগবান জাজলি ঘোরতর তপানুষ্ঠানে নিযুক্ত হইয়া সায়ং ও প্রাতঃকালে স্নান, হুতাশনে আহুতি প্রদান, একাগ্রচিত্তে বেদপাঠ ও ভূমিশয্যায় শয়ন করিতেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে অনাবৃত স্থানে এবং হেমন্তে সলিলমধ্যে অবস্থানপূৰ্ব্বক যারপরনাই কষ্ট সহ্য করিয়া থাকিতেন; কিন্তু কখনও ‘আমি ধার্ম্মিক’ এইরূপ মনে করিয়া অহঙ্কার প্রকাশ করিতেন না। সময়ে সময়ে বর্ষাকাল সমুপস্থিত হইলে তিনি অনাবৃত স্থানে অবস্থানপূৰ্ব্বক মস্তকে ধারাপাত [বৃষ্টির ধারাপতন] সহ্য করাতে এবং বনমধ্যে বারংবার গমনাগমননিবন্ধন তাঁহার কেশপাশে সতত ধূলিপটল সংলগ্ন হওয়াতে তাঁহার মস্তকে জটাভার বদ্ধ ও গ্রন্থিযুক্ত হইয়া উঠিল। তৎপরে তিনি বায়ুমাত্র ভক্ষণ করিয়া কাষ্ঠস্তম্ভের ন্যায় কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া, দণ্ডায়মান রহিলেন। ঐ সময় দুইটি চটকপক্ষী [চড়ুই] তৃণাদি আহরণ করিয়া তাঁহার মস্তকস্থিত জটামধ্যে কুলায় নির্ম্মাণ করিল [বাসা বাঁধিল]। পরম দয়ালু মহর্ষি জাজলি তাহাতে সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করিলেন। তিনি স্থাণুর ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া অবস্থান করাতে বিহঙ্গমিথুন বিশ্বস্তচিত্তে সেই কুলায়মধ্যে অবস্থান করিতে লাগিল।
‘অনন্তর বর্ষা অতীত ও শরৎকাল সমুপস্থিত হইলে তাহারা পরস্পর নিতান্ত কামাসক্ত হওয়াতে চটকীর গর্ভসঞ্চার হইল। কিয়দ্দিন পরে চটকী ঐ মহর্ষির মস্তকেই অণ্ড প্রসব করিল। তেজঃপুঞ্জকলেবর ধর্ম্মপরায়ণ দ্বিজবর তাহা অবগত হইয়াও অবিচলিতচিত্তে অবস্থান করিতে লাগিলেন। বিহঙ্গমিথুনও পরম আহ্লাদিত হইয়া প্রতিদিন ইতস্ততঃ বিচরণপূৰ্ব্বক পুনরায় তথায় আগমন করিয়া বিশ্বস্তমনে তাঁহার মস্তকে বাস করিতে লাগিল। কিয়দ্দিন পরে তাহাদের অণ্ডসকল পরিপূর্ণ ও তৎসমুদয় হইতে শাবকসমুদয় নির্গত হইল। শাবকগুলি জাজলির মস্তকে দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। তথাপি ঐ ব্রতধারী ধর্ম্মাত্মা নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কালক্রমে ঐ শাবকগুলি জাতপক্ষ হইলে তাহাদিগকে দর্শন করিয়া মহর্ষির মন নিতান্ত আহ্লাদিত হইয়া উঠিল। বিহঙ্গমমিথুনও স্বীয় শাবকগণকে ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইতে দেখিয়া মহা-আহ্লাদে তাহাদিগের সহিত সেই ঋষিমস্তকস্থিত কুলায়ে অবস্থান করিতে লাগিল। কিয়দ্দিন পরে দ্বিজবর সেই জাতপক্ষ শাবকগুলিকে প্রতিদিন সন্ধ্যাসময়ে ক্ষণমাত্ৰ ইতস্ততঃ উড্ডয়নপূৰ্ব্বক পুনরাগমন করিতে দেখিলেন। কিয়দ্দিন পরে তাহারা পিতামাতাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক আপনারাই একবার গমনপূৰ্ব্বক পুনরায় আগমন, কোন দিন সমস্ত দিবাভাগ অতিবাহিত করিয়া নিয়মাৰ্থ সায়ংকালে প্রত্যাগমন এবং কখন বা পাঁচদিন অতিক্রম করিয়া ষষ্ঠদিনে পুনরাগমন করিতে লাগিল। তথাপি মহাত্মা জাজলি কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না।
“এইরূপে পক্ষিগণ ক্রমে ক্রমে উড্ডয়ন অভ্যাস করিল। পরিশেষে যখন উহারা একবার জাজলির মস্তক হইতে অন্যত্র গমন করিয়া এক মাস অতীত হইলেও প্রত্যাগত হইল না, তখন জাজলি নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া সিদ্ধ হইয়াছি বলিয়া বিবেচনা করিলেন। ঐ অবধি তাঁহার অন্তঃকরণে অহঙ্কারের আবির্ভাব হইল। পক্ষিগণ যে তাঁহার মস্তকে নির্ব্বিঘ্নে জাত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া স্বেচ্ছানুসারে অন্য স্থানে গমন করিয়াছে, ইহা বিবেচনা করিয়া তাঁহার আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। তৎপরে তিনি নদীজলে স্নান ও হুতাশনে আহুতি প্রদান করিয়া সুৰ্য্যোপস্থাপন করিতে লাগিলেন।
দৈববাণীপ্রবুদ্ধ জাজলির তুলাধার সাক্ষাৎকার
“একদা মহাত্মা জাজলি স্বীয় মস্তকে চটকপক্ষিগণ সমুৎপন্ন হইল বিবেচনা করিয়া আশ্চর্য্যান্বিতচিত্তে ‘আমিই যথার্থ ধর্ম্মোপাৰ্জন করিয়াছি’ বলিয়া মহা আস্ফালন করিতেছিলেন, এমন সময় তাঁহার কর্ণকুহরে এই আকাশবাণী প্রবিষ্ট হইল, ‘জাজলে! তুমি কখনই ধর্ম্মানুষ্ঠানবিষয়ে মহাত্মা তুলাধারের তুল্য হইতে সমর্থ হইবে না। তুলাধারনামে যে মহাপ্রজ্ঞাশালী মহাত্মা বারাণসীমধ্যে অবস্থান করেন, তিনিও তোমার মত গৰ্ব্বিতবাক্যপ্রয়োগের উপযুক্ত নহেন।’ অন্তরীক্ষে এইরূপ দৈববাণী হওয়াতে জাজলি রোষাবিষ্ট হইয়া তুলাধারের সহিত সাক্ষাৎ করিবার এবং বহুকালের পর বারাণসীতে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, মহাত্মা তুলাধার সন্তুষ্টচিত্তে পণ্যদ্রব্যসমুদয় বিক্রয় করিতেছেন। ঐ মহাত্মা বণিক জাজলিকে সমাগত দেখিবামাত্র গাত্রোত্থানপূর্ব্বক প্রীতিমনে স্বাগতসম্ভাষণ ও অভ্যর্থনা করিয়া কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনি সমুদ্ৰকচ্ছে [সাগরতীরে] অবস্থান করিয়া ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিয়াছেন; কিন্তু ধৰ্ম্মের যথার্থ মহিমা কিছুমাত্র অবগত হয়েন নাই। আপনি তপঃসিদ্ধ হইলে আপনার মস্তকে কতকগুলি পক্ষিশাবক জন্মিয়াছিল। আপনি তাহাদিগকে কিছুমাত্র ভয়প্রদর্শন করেন নাই। কিন্তু যখন সেই শাবকগুলি জাতপক্ষ হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে আরম্ভ করিল, তখনই আপনি ধৰ্ম্মলাভ করিয়াছেন বিবেচনা করিয়া মহাগর্ব্বিত হইয়া উঠিলেন। ঐ সময় এক দৈববাণীপ্রভাবে আমার বৃত্তান্ত আপনার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হওয়াতে আপনি ঈর্ষাপরবশ হইয়া আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছেন। এক্ষণে আমাকে আপনার কি হিতানুষ্ঠান করিতে হইবে, অনুজ্ঞা করুন।’ ”