২৬০তম অধ্যায়
মুদগলসমীপে দেবদূতকর্ত্তৃক স্বর্গের গুণদোষ-বর্ণন
“দেবদূত কহিল, ‘মহর্ষে আপনি বুদ্ধিমান হইয়াও অবোধের ন্যায় কি নিমিত্ত স্বৰ্গসুখ উত্তম বলিয়া তাহার বহুমান করিতেছেন না? স্বৰ্গলোক উপরিভাগে অবস্থিত, তথায় নিরন্তর দেবযান
সকল গমনাগমন করিতেছে; সে স্থানে তপোবলবিহীন যজ্ঞানুষ্ঠানবিবর্জ্জিত মিথ্যাভিরত নাস্তিকেরা গমন করিতে সমর্থ হয় না। যাঁহারা ধার্ম্মিক, জিতাত্মা, শান্ত, দান্ত, নির্ম্মাৎসর, ধ্যান ও ধর্ম্মে একান্ত অনুরক্ত এবং সমরপ্রিয় মহাবীর, তাঁহারাই শমদমমূলক অনুত্তম ধর্ম্মানুষ্ঠানপূর্ব্বক সৎপুরুষগণ-নিষেবিত পবিত্র লোক প্রাপ্ত হয়েন।
‘স্বৰ্গে দেবতা, সাধ্য, বিশ্ব, মহর্ষি, যাম, ধাম, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণ ইঁহাদিগের কামফলপ্ৰদ অনেকানেক লোক দেদীপ্যমান রহিয়াছে। ত্ৰয়স্ত্রিংশৎ-যোজনবিস্তৃত হিরন্ময় অদ্রিরাজ মেরুতে নন্দন প্রভৃতি অনেকানেক পবিত্র পরমরমণীয় দেবোদ্যান শোভা পাইতেছে; সেই স্থান পুণ্যবান লোকদিগের বিহারভূমি; তথায় ক্ষুধা, পিপাসা, গ্লানি, ভয়, বীভৎস বা অন্য কোনপ্রকার অশুভ অনুভূত হয় না। সর্ব্বদাই পরমরমণীয় সুখস্পর্শ সুগন্ধ গন্ধবহ মন্দ মন্দ বেগে সর্ব্বত্র সঞ্চারিত হইতেছে। সে স্থানে শ্রুতিসুখাবহ শব্দ শ্রবণ ও মন মোহিত করিতেছে। তথায় শোক, তাপ, জরা ও আয়াসের লেশ নাই। হে মুনীন্দ্ৰ! লোকে স্বোপার্জ্জিত সুকৃতফলে সেই সর্ব্বসুখাস্পদ স্থান প্রাপ্ত হইয়া থাকে। তথায় গমন করিলে কর্ম্মজ তৈজস শরীর সমুদ্ভূত হয়; পিতৃ-মাতৃজ শরীর পরিগ্রহ করিতে হয় না; তথায় স্বেদ, পুরীষ, মূত্ৰ, দুৰ্গন্ধ ও রজঃ প্রভৃতি বস্তুদ্বারা বস্ত্র অপবিত্র বা মলিন হয় না। তত্ৰত্য লোকদিগের দিব্যগন্ধযুক্ত মনোহর মাল্যদাম ম্লান হয় না; তাঁহারা সর্ব্বদা বিমানদ্বারা গমনাগমন করেন; ঈর্ষ্যা, শোক ও শ্রমজনিত ক্লেশের লেশও অনুভব করেন না এবং নির্ম্মৎসর ও মোহবিবর্জ্জিত হইয়া পরমসুখে কালযাপন করিতেছেন। হে মুনিপুঙ্গব! ঈদৃশ লোক অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট লোক আছে; এইরূপে অশেষগুণসম্পন্ন অনেকানেক দিব্যলোক উপৰ্য্যুপরি অবস্থিতি করিতেছে।
“তথায় পূর্ব্বদিকে শুভাস্পদ তেজোময় ব্ৰহ্মলোক অবস্থিত। সেখানে পবিত্র স্বভাব ঋষিগণ স্ব স্ব শুভকর্ম্মফলে গমন করেন; তথায় ঋভুনামে দেবগণ আছেন, তাঁহাদিগের লোক সর্বোৎকৃষ্ট, দেবতারাও তাঁহাদিগের উদ্দেশে যজ্ঞ করিয়া থাকেন। তাঁহারা প্রভা-সম্পন্ন; সকলের অভীষ্ট-ফলপ্ৰদ; তাঁহাদিগের স্ত্রীকৃত তাপ নাই, ঐশ্বৰ্য্যজনিত মাৎসৰ্য্যও নাই। তাঁহারা আহুতিদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ ও অমৃতভোজন করেন না, তাঁহাদিগের শরীর দিব্য ও অনির্ব্বচনীয়, কোন প্রকার আকৃতি বা মূর্ত্তি নাই; তাহাঁরা দেবদেব ও সনাতন, তাঁহাদের সুখকামনা নাই, কল্প পরিবর্ত্তিত হইলে তাঁহারা পরিবর্ত্তিত হয়েন না, নিরন্তর একভাবেই থাকেন। তাঁহাদিগের জরা, মৃত্যু, হর্ষ, শোক, দুঃখ, রাগ ও দ্বেষ নাই; এই দুষ্প্রাপ্য পরমগতি দেবতাদিগেরও অভিলষণীয়; তাহা বিষয়বাসনানিরত জনগণের অগম্য। মনীষিগণ বিবিধ নিয়মানুষ্ঠান ও বিধিপূর্ব্বক দানাদিদ্বারা এই ত্ৰয়স্ত্রিংশৎ দেবলোক প্ৰাপ্ত হয়েন। আপনি লোকাতিশায়িনী বদান্যতাপ্রভাবে এই পরমসুখাবহ স্থান প্রাপ্ত হইয়াছেন, অতএব তপঃপ্রভাবসম্পন্ন হইয়া সুকৃতিলব্ধ সদগতি উপভোগ করুন।
‘হে বিপ্রেন্দ্র! স্বর্গের সুখ ও নানাবিধ লোকের বর্ণন করিলাম এবং স্বর্গের গুণসমূহ কীর্ত্তিত হইয়াছে, এক্ষণে উহার দোষ কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।
‘লোকে স্বৰ্গপ্রাপ্ত হইয়া পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের ফলভোগ করে, কিন্তু অন্য কোনরূপ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে না; সুতরাং পুণ্যপাদপ ক্রমে ক্ৰমে সমূলে উন্মূলিত হইয়া যায়। পুণ্যের ক্ষয় হইলে পুনরায় যে অধঃপতন হয়, ইহা আমার মতে মহাদোষ। কারণ, বহুদিবস সুখে কালাতিপাত করিয়া পরিশেষে দুৰ্গতিলাভ করিলে তাহা সাতিশয় ক্লেশকর হইয়া উঠে। অন্যের অতুল ঐশ্বৰ্য্য সন্দর্শন করিয়া অমরলোকস্থ জনগণের যে অসন্তোষ ও পরিতাপ জন্মে, ইহা অপেক্ষা ক্লেশজনক আর কি আছে? কণ্ঠবিলম্বিত মাল্য ম্লান হইলে পতনোন্মুখ ব্যক্তির অন্তঃকরণে ভয়ের সঞ্চার হয় এবং পতনকালে তিনি রজোগুণাক্রান্ত ও তাঁহার বুদ্ধি বিমোহিত হইয়া যায়। ব্ৰহ্মভবন পৰ্যন্ত এই সমস্ত দারুণ দোষ দৃষ্ট হইয়া থাকে।
সুরলোকবাসে লক্ষ লক্ষবিধ গুণসমূহ লক্ষিত হয়, কিন্তু স্বর্গভ্রষ্ট মনুষ্যদিগের এই একমাত্র গুণ দৃষ্ট হয় যে, তাহারা অন্য কোন অধম গতি প্রাপ্ত না হইয়া অতীত শুভদৃষ্ট স্মরণ ও অনুতাপপূর্ব্বক কেবল মনুষ্যলোকেই জন্মগ্রহণ করেন। সেই মহাভাগ সে স্থানেও সুখে কালাতিপাত করিতে পারেন; কিন্তু যদি সম্যক বিবেচনাপূর্ব্বক কাৰ্য্য না করেন, তাহা হইলে পরিশেষে তিনি নীচতা প্রাপ্ত হয়েন; কারণ, পৃথিবী কর্ম্মভূমি, আর স্বর্গ ফলভূমি; ইহলোকে কর্ম্মকরিলে পরলোকে তাহার ফলভোগ হয়। হে মহর্ষে! আপনি যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমি তৎসমুদয় কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে আর বিলম্ব করিতে পারি না, অতএব অনুমতি করুন, আমি স্বচ্ছন্দে গমন করি।”
“মুনিবার এই কথা শ্রবণানন্তর সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া কহিলেন, “হে দেবদূত! তুমি যে মহাদোষ কীর্ত্তন করিলে, তাহাই আমার আবশ্যক; স্বর্গে বা সুখে প্রয়োজন নাই। স্বর্গভ্রষ্ট হইলে পুনরায় নরলোকে জন্ম পরিগ্রহ করিতে হয় এবং দারুণ দুঃখ ও পরিতাপ সহ্য করিতে হয়; এই নিমিত্ত আমি স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির কামনা করি না। যে স্থানে গমন করিলে পুনরায় পরিভ্রষ্ট হইতে হয় না। এবং শোক, দুঃখ ও মনস্তাপ থাকে না, আমি প্ৰাণপণে সেই স্থানের অন্বেষণ করিব।”
মুদগলের মুক্তি
“দেবদূত কহিল, ‘ব্রহ্মসদনের উর্দ্ধে পরমোৎকৃষ্ট বিশুদ্ধ সনাতন জ্যোতির্ম্ময় বিষ্ণুপদ আছে, লোকে উহাকে পরব্রহ্ম বলিয়া জানেন। হে বিপ্ৰ! সে স্থানে দম্ভ, ক্ৰোধ, লোভ, মোহ ও বিষয়বাসনাপরায়ণ পুরুষেরা গমন করিতে পারে না। নির্ম্মম, নিরহঙ্কার, নিৰ্দ্ধন্দ্ব, জিতেন্দ্ৰিয়, ধ্যান ও যোগ-নিরত মানবেরাই তথায় গমন করিতে সমর্থ হয়েন।’
“অনন্তর ধর্ম্মাত্মা মুনিবর দেবদূতকে বিদায় করিয়া উঞ্ছবৃত্তিদ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া অনুত্তম শমগুণ আশ্রয় করিলেন। তখন তাঁহারা নিন্দা ও স্তুতিবাদ এবং লোষ্ট্র ও কাঞ্চন সমান জ্ঞান হইতে লাগিল। এইরূপে তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগ সহকারে ধ্যানস্থ হইলে তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তি ক্রমে ক্রমে নির্ম্মল হইয়া উঠিল এবং তিনি ধ্যানযোগবলে পরমপুরুষাৰ্থ শাশ্বত মুক্তিপদ লাভ করিলেন। অতএব হে কৌন্তেয়! রাজ্যচ্যুত হইয়াছ বলিয়া তোমার শোক করা অনুচিত; তুমি তপোবলে পুনরায় তাহা প্রাপ্ত হইবে, তন্নিমিত্ত চিন্তা কি? দেখ, সুখ দুঃখ চক্রের ন্যায় নিরন্তর পরিবর্ত্তিত হইতেছে, সুখের অবসানে দুঃখ এবং দুঃখের বিগমে সুখভোগ হইয়া থাকে। ত্ৰয়োদশ বৎসর অতীত হইলে পৈতৃক রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবে; অতএব মনোদুঃখ দূর কর।” ভগবান মহামুনি ব্যাস এই কথা বলিয়া স্বীয় আশ্রমাভিমুখে গমন করিলেন।
ব্রীহিদ্রোণিকপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।