২৬০তম অধ্যায়
ধৰ্ম্মর্সন্দেহসূচনা—ধর্ম্ম ও আচারের আলোচনা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি যেরূপ সূক্ষ্ম বেদবাধিত ধৰ্ম্মলক্ষণ কীৰ্ত্তন করিলেন, আমার হৃদয়ে তাহা স্ফুৰ্ত্তি পাইতেছে, আমি অনুমান আশ্রয় করিয়া তাহা প্রকাশ করিতে পারি। আপনি আমার হৃদগত প্রায় সমুদয় প্রশ্নই কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, এক্ষণে আমি কুতর্ক পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আর একটি প্রশ্ন করিতেছি, শ্রবণ করুন। যে ধৰ্ম্মপ্রভাবে প্রাণীগণের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ হইতেছে, কেবল শাস্ত্রপাঠদ্বারা কখনই তাহা জ্ঞাত হওয়া যায় না, অবিপন্ন ব্যক্তির ধর্ম্ম যেরূপ, বিপন্ন ব্যক্তির ধর্ম্ম সেরূপ নহে। আপদ্ অসংখ্য, সুতরাং আপদ্ধৰ্ম্মও বিবিধ প্রকার। অতএব শাস্ত্রপাঠদ্বারা সমুদয় আপদ্ধৰ্ম্ম কিরূপে বোধগম্য হইতে পারে? শাস্ত্রে সাধুদিগের আচারকে ধর্ম্ম ও ধৰ্ম্মানুষ্ঠানপরতন্ত্র ব্যক্তিকে সাধু বলিয়া নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। এই লক্ষণদ্বারা ইহা স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে যে, ধর্ম্ম ও সাধু ইহারা পরস্পরসাপেক্ষ; সুতরাং উহাদ্বারা কে সাধু ও ধর্ম্ম কি, তাহা নিরূপণ করা যায় না। দেখুন, শূদ্রগণ মুমুক্ষু হইয়া ধৰ্ম্মবৃদ্ধির নিমিত্ত বেদান্তাদি শ্রবণ করাতে তাঁহাদের অধৰ্ম্ম হইতেছে এবং অগস্ত্যাদি মহর্ষিগণ যজ্ঞার্থে বিবিধ হিংসাকর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করাতেও তাঁহাদের ধর্ম্ম হইতেছে। সুতরাং ধৰ্ম্ম কিরূপে নির্ণয় করা যাইতে পারে? আর দেখুন, বেদসমুদয়ের প্রতিযুগেই হ্রাস হইয়া থাকে, তন্নিবন্ধন সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারি যুগে পৃথক পৃথক ধৰ্ম্ম অনুষ্ঠিত হয়। এইরূপে যখন কালভেদে বৈদিক কৰ্ম্মের ভিন্নভাব হইল, তখন বেদবাক্য যে যথার্থ বলিয়া পরিগণিত হয়, ইহা কেবল লোকরঞ্জন মাত্র। বেদ হইতে সমুদয় স্মৃতি সমুদ্ভূত হইয়াছে; অতএব যদি বেদশাস্ত্র অপ্রমাণ হইল, তবে তৎসম্ভূত স্মৃতিশাস্ত্রকেও অপ্রমাণ বলিতে হইবে। আবার অনেক সময়ে এরূপ ঘটিয়া থাকে যে, ধার্ম্মিকেরা কোন ধর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে বলবান্ দুরাত্মারা উহার যে অংশে ব্যাঘাত উৎপাদন করে, সেই অংশ অবধি একেবারে উন্মূলিত হইয়া যায়। সুতরাং ধর্ম্মতত্ত্ব নির্ণয় করা নিতান্ত সহজ নহে। ফলতঃ আমরা অবগত থাকি বা না থাকি এবং অন্যকর্ত্তৃক উপদিষ্ট হইয়াও বুঝিতে পারি বা না পারি, ধৰ্ম্মতত্ত্ব যে ক্ষুরধার অপেক্ষাও সূক্ষ্ম এবং পর্ব্বত অপেক্ষাও গুরুতর, তাহার আর সন্দেহ নাই।
“যজ্ঞাদি ধৰ্ম্ম প্রথমতঃ গন্ধৰ্ব্বগণের ন্যায় অদ্ভুতরূপে লক্ষিত হয়, কিন্তু যখন পণ্ডিতেরা উহাকে অনিত্য বলিয়া পৰ্য্যালোচনা করেন, তখন তাঁহাদের উহা নিতান্ত তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইয়া থাকে। মনুষ্যেরা গোসমূহের জলপানাৰ্থ ক্ষুদ্র খাত ও ক্ষেত্রে জলসেক করিবার নিমিত্ত কৃত্রিম নদী প্রস্তুত করিলে যেমন ঐ সমুদয় ক্রমে শুষ্ক হয়, তদ্রূপ বেদবোধিত ধৰ্ম্ম যুগে যুগে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া কলিযুগে একেবারে নিঃশেষিত হইয়া যায়। অসাধু ব্যক্তিরা লোকের অগ্নিহোত্রাদি কাৰ্য্যসমাধান, বেতনগ্রহণসহকারে অধ্যাপনাকাৰ্য্য সম্পাদন ও অন্যান্য কাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত মিথ্যা আচার অবলম্বন করিয়া থাকে। সাধু ব্যক্তিরা যাহা ধৰ্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন, মূঢ় ব্যক্তিরা তাহা প্রলাপ বোধ করিয়া সাধুদিগকে উন্মত্ত বলিয়া অবজ্ঞা করে। দেখুন, দ্রোণাদি মহাত্মাও স্বধৰ্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্ষাত্ৰধৰ্ম্ম আশ্রয় করিয়াছিলেন; অতএব সৰ্ব্বজনহিতকারী আচার কুত্রাপি ব্যবহৃত হয় না। কোন কোন ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের আচার অবলম্বনপূৰ্ব্বক ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মচারী ব্রাহ্মণকে নিন্দা করেন এবং কোন কোন ব্রাহ্মণে ব্রহ্মধর্ম্ম ও ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম উভয় বর্ত্তমান থাকে। অতএব সর্ব্বপ্রকার আচারেই ব্যভিচার দৃষ্ট হইতেছে। এক্ষণে আমার এই বোধ হইতেছে, শ্রুতি বা স্মৃতি ধৰ্ম্মের নির্ণায়ক নহে; পূর্ব্বতন পণ্ডিতগণ যাহাকে ধৰ্ম্ম বলিয়া স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, তাহাই অদ্যাপি ধৰ্ম্ম বলিয়া প্রচলিত হইতেছে।”