২৫৯তম অধ্যায়
মহর্ষি মুদ্গলের উপাখ্যান
ব্যাস কহিলেন, “হে ধর্ম্মানন্দন! মহর্ষি মুদগল এক দ্রোণব্রীহি প্ৰদান করিয়া যে ফল প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে একটি পুরাতন ইতিহাস আছে, শ্রবণ কর।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহর্ষে মহাত্মা মুদগল কিরূপে ব্রীহিদ্রোণ প্ৰদান করেন এবং কোন বিধান অবলম্বনপূর্ব্বক কাহাকে উহা প্ৰদান করিয়াছিলেন, তদ্বিষয় শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, সকল-ধর্ম্মভিজ্ঞ ভগবান ঈশ্বর যে মহাত্মার কর্ম্মে পরিতুষ্ট হইয়াছেন, তিনিই আমার মতে সার্থকজন্মা।
ব্যাস কহিলেন, “কুরুক্ষেত্রে সত্যবাদী অসূয়াশূন্য জিতেন্দ্ৰিয় মুদগলনামে এক ধর্ম্মাত্মা মহর্ষি ছিলেন। তিনি শীল উঞ্ছ[কৃষকের কর্ত্তিতাবশিষ্ট কণামাত্র পরিত্যক্ত ধান্যের সংগ্ৰহ]-বৃত্তি অবলম্বনপূর্ব্বক জীবিকানির্ব্বাহ, অতিথি-সৎকার ও অন্যান্য ধর্ম্মকর্ম্ম সম্পন্ন করিতেন। ঐ মহর্ষি ইষ্টীকৃত ও দর্শপৌর্ণমাস-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে নিয়ত তৎপর থাকিতেন; তিনি কপোতবৃত্তি [অত্যল্প মাত্র সংগ্রহপ্রবৃত্তি] অবলম্বন করিয়া এক পক্ষে এক দ্রোণবীহি উপার্জ্জন করিতেন এবং পক্ষান্তে তদ্বারা দেবতা ও অতিথিগণের পূজা করিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিত, পুত্ৰকলাত্ৰ-সমভিব্যাহারে তাঁহাই উপযোগ করিয়া জীবন ধারণ করিতেন। ত্ৰিভুবনাধীশ্বর ইন্দ্র দেবগণের সহিত প্রতিপর্ব্বে মহর্ষি-সন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক যজ্ঞভাগ গ্রহণ করিতেন। মহর্ষি মুদগল প্রতিপর্ব্বে প্রফুল্লান্তঃকরণে বিশুদ্ধ-ভাবে অতিথিগণকে অন্নদান করিতেন বলিয়া অতিথিগণ সমাগত হইবামাত্র তাঁহার ব্রীহিদ্রোণ বৰ্দ্ধিত হইত; সুতরাং তিনি অনায়াসেই শত শত ব্ৰাহ্মণকে ভোজন করাইতেন।
“মহর্ষি দুর্ব্বাসা পরমধার্ম্মিক ব্ৰতপরায়ণ মুদগলের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া উন্মত্তের ন্যায় দিগম্বর ও কেশবিহীন হইয়া বিবিধ পরুষবাক্য প্রয়োগ করিতে করিতে মহর্ষি মুদগলের সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে দ্বিজসত্তম! আমি অন্নার্থী হইয়া তোমার নিকট আগমন করিয়াছি।” মহর্ষি মুদগল অকপট ভক্তি-সহকারে সেই উন্মত্তবেশধারী ক্ষুধিত দুর্ব্বাসাকে স্বাগত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং পাদ্য, অর্ঘ্য ও উত্তম অন্ন প্ৰদান করিলেন। সাতিশয় ক্ষুধিত দুর্ব্বাসা ক্ৰমে ক্ৰমে মুদগলের গৃহস্থিত সমুদয় অন্ন ভক্ষণ করিলেন। ভোজনাবসানে উচ্ছিষ্ট অন্ন সমুদয় অঙ্গে লেপনপূর্ব্বক স্বাভিলষিত স্থানে প্ৰস্থান করিলেন। তিনি তাহার পর-পর্ব্বাহেও তথায় আগমনপূর্ব্বক সমুদয় অন্ন ভক্ষণ করিলেন।
দানপুণ্যে মুদগলের স্বৰ্গগমনবিধান
“মহর্ষি মুদগল নিরাহারে পুত্রকলত্র-সমভিব্যাহারে পুনরায় উঞ্ছবৃত্তি অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। কি ক্ষুধা, কি ক্ৰোধ, কি মাৎসৰ্য্য, কি অবমাননা, কি সম্ভ্রম, কিছুতেই তাঁহাকে ক্ষুণ্ন করিতে পারিল না। তিনি এইরূপে ক্ষুধা-তৃষ্ণা পরিহারপূর্ব্বক উঞ্ছবৃত্তির অনুশীলন করিতে লাগিলেন। মহাতপঃ দুর্ব্বাসাও পর্ব্বে পর্ব্বে আগমন-পূর্ব্বক তাঁহার সমুদয় অন্ন ভক্ষণ করিয়া যাইতে লাগিলেন। মহর্ষি দুর্ব্বাসা ক্ৰমে ক্ৰমে ছয়বার মুদগলের সমস্ত অন্ন ভোজন করিলেও তাঁহার কিছুমাত্র মনঃক্ষোভ নিরীক্ষণ করিলেন না; প্রত্যুত সতত তাঁহাকে বিশুদ্ধমনাই দেখিতেন।
“তখন মহর্ষি দুর্ব্বাসা পরমপ্রীত হইয়া কহিলেন, “হে মহাত্মন মুদগল! ইহলোকে তোমার সমান মাৎসৰ্য্যবিবর্জ্জিত দাতা আর দৃষ্টিগোচর হয় না। হে মহর্ষে ক্ষুধা ধর্ম্ম জ্ঞান ও ধৈৰ্য্য নাশ করে; রসনা রসের দিকেই সতত ধাবমান হয়; প্ৰাণ আহার প্রভাবেই দেহে অবস্থান করে; মন অতিচঞ্চল, দুর্নিবার, তাহাকে বশীভূত করা অতি কঠিন। ইন্দ্ৰিয়গণ ও মনের একাগ্ৰতাই তপস্যা; তাহা কেবল তোমাতেই বিদ্যমান দেখিতেছি। হে মহাত্মন! শ্রমোপার্জ্জিত দ্রব্য পরিত্যাগ করা নিতান্ত দুষ্কর; কিন্তু তুমি অনায়াসেই তাহা করিতেছ। আমি তোমার সহিত একত্ৰ মিলিত হইয়া পরমপ্রীতি ও অনুগৃহীত হইলাম। ইন্দ্ৰিয়সংযম, ধৈৰ্য্য, সংবিভাগ, দম, শম, দযা, সত্য ও ধর্ম্ম এই সমুদয়ই তোমাতে বর্ত্তমান আছে। তুমি কর্ম্মদ্বারা সমুদয় লোক জয় এবং উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়াছ। স্বৰ্গবাসীরাও তোমার যশঃকীর্ত্তন করিতেছেন, তুমি অচিরাৎ সশরীরে স্বর্গে গমন করিবে।”
স্বৰ্গগমনে মুদগলের অনিচ্ছা!
“মহর্ষি দুর্ব্বাসা এই কথা কহিবামাত্র এক দেবদূত হংসসারসযুক্ত কিঙ্কিণীজালজড়িত কামচারী বিচিত্ৰ বিমান লইয়া মহাতপাঃ মুদগলের সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিল, “হে মহর্ষে। আপনার সিদ্ধিলাভ হইয়াছে, আপনি স্বীয় কর্ম্মপ্ৰভাবে এই বিমান প্ৰাপ্ত হইয়াছেন, অতএব ইহাতে আরোহণ করুন।”
“মহর্ষি মুদগল দেবদূতের বাক্য-শ্রবণানন্তর কহিলেন, “হে দেবদূত! তুমি স্বৰ্গনিবাসিগণের গুণ, তপস্যা, নিয়ম, সুখ এবং দোষই বা কিরূপ, ইহা কীর্ত্তন কর। কুলোচিত সৎপুরুষগণ সাধুদিগের মিত্রকে সপ্তপদ বলিয়া কীর্ত্তন করেন, আমি সেই মিত্ৰতা অবলম্বন করিয়া তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি এ বিষয়ে কর্ত্তব্যকর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া আমাকে সৎপরামর্শ প্রদান কর, আমি তোমার বাক্যানুসারে কার্য্য করিব তাহাতে সন্দেহ নাই।”