২৫৯তম অধ্যায়
ধৰ্ম্মের স্বরূপ নির্ণয়ে যুধিষ্ঠিরের ভীষ্মনুরোধ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অল্পবুদ্ধি মনুষ্যগণ ধর্ম্মাধর্ম্মনির্ণয়ে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া রহিয়াছে; অতএব ধৰ্ম্ম কি পদার্থ এবং কি হইতেই বা উৎপন্ন হয় ? ইহলোকে মঙ্গললাভের নিমিত্ত যে কার্য্যানুষ্ঠান করা যায় তাহাই কি ধৰ্ম্ম বা পরলোকের নিমিত্ত যাহা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় ? অথবা এই লোেক ও পরলোক এই উভয় লোকের নিমিত্ত যাহা সংসাধিত হইয়া থাকে, তাহাই প্রকৃত ধৰ্ম্ম, আপনি ইহা সবিস্তারে কীৰ্ত্তন করুন।” | ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ। সদাচার, স্মৃতি, বেদ ও অর্থ এই চারি বিষয় ধর্ম্মের জ্ঞাপক। মনুষ্য প্রকৃত ধর্ম্ম নির্ণয় করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করিবে। লোকযাত্রানিৰ্ব্বাহের নিমিত্ত ধৰ্ম্ম সংস্থাপিত হইয়াছে। ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে ইহকাল ও পরকালে সুখরূপ উৎকৃষ্ট ফললাভ হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি প্রকৃত ধর্ম্মোপার্জ্জনে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে, তাহাকে নিশ্চয়ই পাপভোগ করিতে হয়। পাপপরায়ণ পুরুষেরা কদাচ পাপ হইতে বিমুক্ত হয় না। কিন্তু কেহ কেহ আপালে পাপাচরণ করিয়াও নিষ্পাপ হয় এবং মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিয়াও সত্যবাদী ও ধার্ম্মিক বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। আচারই ধৰ্ম্মের আশ্রয়; সেই আচার অবলম্বন করিয়া ধৰ্ম্ম অবগত হইবে। মনুষ্যের স্বভাব এই, তাহারা আপনার অধৰ্ম্ম কিছুতেই প্রকাশ করে না, কিন্তু অন্যের পাপাচার সুপ্রচারিত করিয়া থাকে। দেখ, তস্কর অরাজক রাজ্যে অন্যের অর্থ অপহরণ করিয়া অশঙ্কচিত্তে আপনার ধার্ম্মিকতা প্রকাশ করে। কিন্তু যখন অন্যে তাহার ধন গ্রহণ করে, তখন সে রাজার নিকট গমনপূর্ব্বক তাহার নামে অভিযোগ করিয়া থাকে। সে সময়েও স্বধনসন্তুষ্ট ব্যক্তিবর্গের ধন হরণ করিতে তাহার স্পৃহা জন্মে। যে ব্যক্তি বিশুদ্ধস্বভাব এবং যে আপনাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলিয়া জ্ঞাত আছে, সে নির্ভয়ে রাজদ্বারে গমন করিতে পারে। সত্যবাক্য প্রয়োগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। সত্যে সমস্ত বস্তু প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। পাপপরায়ণ উগ্ৰস্বভাবসম্পন্ন মনুষ্যেরা সত্যপ্রভাবেই নিয়ম স্থাপনপূৰ্ব্বক পরস্পরের অনিষ্ট চিন্তা পরিহার ও পরস্পর একতাবন্ধন করিয়া থাকে; তাহারা যদি নিয়মের শৃঙ্খল হইতে উন্মুক্ত হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পরস্পর বিনষ্ট হইয়া যায়। পরস্বাপহরণ না করাই সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। কোন কোন বলবান ব্যক্তি ‘পরধন অপহরণ করা অকৰ্তব্য’ ইহা দুৰ্ব্বলদিগের বাক্য বলিয়া অনুমান করিয়া থাকে। দৈব তাহাদের পক্ষে নিতান্ত প্রতিকূল, সন্দেহ নাই। এই জীবলোকে কেহই সর্ব্বাপেক্ষা বলবান্ বা সুখী নাই। অতএব সরল ভাব অবলম্বন করা সকলেরই কর্ত্তব্য। যিনি কাহারও অনিষ্ট না করিয়া পবিত্রভাবে নির্ভয়ে অবস্থান করেন, তাঁহাকে আর অসাধু, তস্কর বা ভূপাল হইতে কিছুমাত্র শঙ্কিত হইতে হয় না। তস্কর নগরপ্রবিষ্ট মৃগের ন্যায় সকল লোক হইতেই ভীত হইয়া থাকে এবং আপনার ন্যায় অন্যকে পাপপরায়ণ বলিয়া বিবেচনা করে। যে ব্যক্তি বিশুদ্ধস্বভাব, সে প্রফুল্লমনে নির্ভয়ে সৰ্ব্বত্র বিচরণ করিয়া থাকে এবং কদাপি অন্য হইতে আপনার অনিষ্টাশঙ্কা করে না।
“যাঁহারা প্রাণীগণের হিতানুষ্ঠাননিরত, তাঁহারাই দানধৰ্ম্মের বিধি প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন। ধনীরা দৈবের প্রতিকূলতাবশতঃ ঐ বিধিকে দরিদ্রনির্দ্দিষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। কিন্তু তাহাদের ইহা বিবেচনা করা উচিত, এই জীবলোকে কাহারও সৰ্ব্বাপেক্ষা ধনবান বা সুখী হইবার সম্ভাবনা নাই। যে ব্যক্তি অন্যে তাহার অনিষ্ট করিলে সহ্য করিতে পারে না, অন্যের অনিষ্টাচরণ করা কি তাহার উচিত? যে ব্যক্তি স্বয়ং কোন রমণীর উপপতি হয়, অন্যের দোষ সহ্য করা তাহার অবশ্য কর্ত্তব্য; কিন্তু সে প্রায়ই অন্যকে সেই রমণীর উপপতি হইতে দেখিলে তাহার সেই দোষ সহ্য করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি স্বয়ং জীবিত থাকিতে অভিলাষ করে, অন্যের প্রাণসংহার করা তাহার কদাচ কৰ্ত্তব্য নহে। যাহা আপনার হিতকর বলিয়া বোধ করিবে, তাহা অন্যের প্রিয়কর জ্ঞান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। আপনার প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন নির্দ্ধন দরিদ্রদিগকে প্রদান করিবে। এই কারণেই ধনবৃদ্ধির নিমিত্ত কুসীদবৃত্তি প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। যে পথ অবলম্বন করিলে দেবগণের সাক্ষাৎকারলাভ হয়, সতত সেই পথ আশ্রয় করা উচিত। যদি কিছুমাত্র স্বার্থ না থাকে, তথাচ ধৰ্ম্মপথে বিচরণ করাই কর্ত্তব্য। মনীষিগণ হিংসা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শান্তিমার্গ অবলম্বন করাকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্ণয় করিয়া গিয়াছেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে আমি যেমন ধৰ্ম্মাধর্ম্মের লক্ষণ কীৰ্ত্তন করিলাম, তুমি তাহাতেই স্থিরনিশ্চয় হও। পূৰ্ব্বে বিধাতা ধৰ্ম্মকে দয়াপ্রধান বলিয়া নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন। সাধু ব্যক্তিরা সেই পরমধর্ম্মলাভের নিমিত্তই সতত সচেষ্ট হইয়া থাকেন। এই আমি তোমার নিকট ধৰ্ম্মের স্বরূপ কীৰ্ত্তন করিলাম, তুমি ইহা অনুধাবন করিয়া সরলতা অবলম্বন কর, কদাচ কপট কার্য্যের অনুষ্ঠান করিও না।”